ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪

সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ধান কিনেই তিনি মজা পান

প্রকাশিত : ০৮:৫২, ২৮ জুন ২০১৯

চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন যশোরের শার্শা উপজেলার কৃষকসহ চেয়ারম্যানরা।

কৃষকরা সরাসরি তাদের ধান উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসে বিক্রি করতে পারছে না। শুধু সিন্ডিকেটের দালালরাই সেখানে ধান বিক্রি করতে পারছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।

এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত কৃষকরা। এ উপজেলায় গত ২৬ মে থেকে সরকারিভাবে বোরো ধান সংগ্রহ শুরু হয় এবং আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ করা হবে।

শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল বলেন, আমার দায়িত্ব শুধু প্রকৃত কৃষকদের নামের তালিকা তৈরি করা। সে হিসাবে আমি ৯ ধাপে প্রায় তিন হাজার ২০০ কৃষকের তালিকা উপজেলা খাদ্য অফিসে পাঠিয়েছি।

৬শ‘ ৫২ মেট্রিক টন ধান কেনার কথা। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত ১শ‘ ৫০ মেট্রিক টন কিনেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে ধান কেনার কথা কিন্তু তারা ইউনিয়ন পর্যায়ে যাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান ও নিরাপত্তা প্রহরী হারুনের সহযোগিতায় প্রতি ইউনিয়ন থেকে কয়েকজন ধান ব্যবসায়ী (আড়ৎদার) ও সরকারি দলের প্রভাবশালী কিছু লোকের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা কৃষকদের মিথ্যা কথায় ম্যানেজ করে তাদের ভর্তুকির কৃষি কার্ড সংগ্রহ করছে।

কৃষকের নিকট থেকে কম মূল্যে ধান কিনে ঐ কৃষি কার্ড ব্যবহার করে সরকারি খাদ্য গুদামে মণ প্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছে। কার্ড প্রদানকারী সহজসরল এ কৃষকদের ঐ সিন্ডিকেট শান্তনা স্বরুপ দিচ্ছে ৩০০/৩৫০ টাকা। সিন্ডিকেটের বাহিরে কোন কৃষক ধান বিক্রি করার জন্য খাদ্য গুদামে গেলে কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিচ্ছে ধান কেনা শেষ হয়ে গেছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শার্শা উপজেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৬শ‘ ৫২ মেট্রিক টন এবং প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে তালিকাভূক্ত কৃষকদের নিকট থেকে মাঠ পর্যায়ে সরাসরি ধান কেনার কথা। একজন প্রকৃত কৃষকের নিকট থেকে সর্বোচ্চ তিন মেট্রিক টন ধান কেনার বিধান থাকলেও এ দফতর ঘোষণা দিয়েছে প্রতি কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ১৫ মণ ধান কেনা হবে।

ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধান সংগ্রহের বিধান থাকলেও এ দফতরের কর্তা-ব্যক্তিরা তা মানছেন না।

তালিকাভূক্ত কোনো কৃষক ধান নিয়ে গেলে ধানে ‘ময়েশ্চার’ বেশি, চিটা আছে বলে ফেরত দিচ্ছে। কিন্তু ঐ কৃষক পরক্ষণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান জমা দিলে অফিস ধান কিনে নিচ্ছে।

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একজন কৃষক ১৫ মণ ধান বিক্রি করে যে টাকা লাভ করবে, সেই লাভের টাকা দিতে হবে ধান পরিবহনের জন্য ভ্যান চালককে। অথচ ‘সিন্ডিকেট’ সদস্যরা অফিসের সহযোগিতায় বাজারের কৃষকের নিকট থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা দিয়ে হীরা ধান কিনে কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সরকারি গুদামে সরবরাহ করছে।

মে মাসের প্রথম দিকে সরকারি গুদামে যদি ধান কেনা হত তাহলে কৃষকরা লাভবান হতো। এদিকে আবহাওয়া ভাল থাকায় কৃষকেরা বোরো ধান কাটা ও মাড়াই আগেই শেষ করেছে। জমি চাষ, সেচ, সার, কীটনাশক ও ধান কাটার খরচ মেটাতে তারা বাধ্য হয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছেন।

সরকারি দাম ভালো থাকলেও সঠিক সময়ে সংগ্রহ শুরু না হওয়ায় তারা ধান দিতে পারেনি।

‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেট’ চক্রের ভয়ে ভীত হয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ বুরুজ বাগান গ্রামের জনৈক কৃষক বলেন, ‘সরকার ঘোষণা করেছে যে সকল কৃষকের ভর্তুকির কার্ড আছে তাদের নিকট থেকে এক হাজার ৪০ টাকা মণ দরে ধান সংগ্রহ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী অফিসে গেলে লেবার ও কর্মকর্তারা বলেন, ধান নেওয়া শেষ হয়ে গেছে। তাই আমাকে ফিরে যেতে হল। আমি ধান দিতে পারিনি। কিন্তু এখনও ধান নিচ্ছে।’

কন্দর্পপুর গ্রামের জনৈক কৃষক জানান, এক হাজার ৪০ টাকা দরে অফিসের সহযোগিতায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে। অফিসের লোকজন ও দালালের মাধ্যম ছাড়া কৃষকের পক্ষে ধান বিক্রি করা সম্ভব না। এ সময় কৃষকরা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে এসে ধান কেনার জন্য সরকারের কাছে দাবি করেন।

নিজামপুরের জনৈক কৃষক জানান, যাদের কোনো জমিজমা নেই কিন্তু ভর্তুকির কার্ড আছে। এই কার্ড এক শ্রেণির লোক ধান সংগ্রহ করে উপজেলা খাদ্য অফিসে ধান বিক্রি করছে কিন্তু বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।

বৃহস্পতিবার শার্শা উপজেলা মাসিক সভায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে কেন ধান কেনা হচ্ছেনা ইউপি চেয়ারম্যানরা  অভিযোগ করলে রীতিমত সভায় হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডল খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাকে ইউনিয়ন থেকে ধান কেনা ও  বর্তমানে ধান কেনা ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই প্রশ্ন করলে খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন থেকে কিছু ধান কিনেছিলাম। আমার দফতরে জনবল কম থাকায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে ধান কিনা সম্ভব হয়নি। আর সিন্ডিকেট বলতে অনেকের হয়ত আত্মীয়-স্বজন আছে।

শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলক কুমার মন্ডল জানান, খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ধান সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বারদের কৃষকরা যাতে সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করলে সমস্যাটা আর থাকবে না। আমরা কোনোভাবেই ধান সংগ্রহের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট হতে দেব না।

এদিকে শার্শা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মঞ্জু জানান, সরকার চাচ্ছে মাঠ পর্যায় থেকে ধান কিনতে। সেখানে না কিনলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবেনা।

খাদ্য নিয়ন্ত্রক গুদামে যা করা হচ্ছে তা আদৌ কাম্য নয়। নাভারণে কিছু সিন্ডিকেট আছে এবং কে কে থাকে, কারা নিরুৎসায়িত করে আমি তাদের নাম জানি। এরা দীর্ঘদিন যাবৎ এগুলো করে আসছে। সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের বলে সরকারি গোডাউনে আপনারা ধান সাপ্লাই দিতে পারবেন না। কেন ঝামেলায় যাবেন এ ধরনের ব্যবহার করে আমি জানি আমার কাছে রিপোর্ট আছে।

আই/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি