সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়েও বড় বিজয়
প্রকাশিত : ১৬:৩৮, ১৯ মে ২০২০
পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে।
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে।
চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। এবার সপ্তম পর্বে জানবেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান।
নাজিল হলো কেবলা পরিবর্তনের আয়াত- ‘যেখান থেকেই তুমি বের হও না কেন, নামাজের সময় মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফেরাও। নিশ্চয়ই এ তোমার প্রতিপালকের নির্দেশ। তোমরা যা-ই করো আল্লাহ তা জানেন। যেখান থেকেই যাত্রা করো না কেন, মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফেরাবে। আর যেখানেই থাকো না কেন, নামাজের সময় মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। যাতে করে অহেতুক কোনো বিতর্কে জড়াতে না হয়। অবশ্য জালেমদের মুখ কখনো বন্ধ হবে না। আর ওদেরকে ভয় করার কিছু নেই। শুধু আল্লাহর (বিরাগভাজন হওয়াকে) ভয় করো। যাতে আমি আমার নেয়ামত পুরোপুরি দিতে পারি এবং তোমরা সৎপথে পরিচালিত হতে পারো।’ (সূরা বাকারা: ১৪৯-১৫০)
এই আয়াত নাজিলের পরই জেরুজালেমের পরিবর্তে মক্কার কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায় শুরু হলো। জামাতে নামাজের গুরুত্বের পাশাপাশি কর্মের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো স্পষ্ট ভাষায়। নামাজ শেষ করে বিশ্রাম নিতে না বলে নির্দেশ দেয়া হলো কর্মে ডুবে যাওয়ার, আল্লাহর অনুগ্রহ সম্পদ অনুসন্ধানের, ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন জুমআর নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন তোমরা কেনাবেচা বন্ধ করে আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও। এটা তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যেই, যদি তোমরা বুঝতে! নামাজ শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ-সম্পদ অনুসন্ধান করো। আর বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো, তাহলেই তোমরা সফল হবে। (সূরা জুমআ : ৯-১০)
সালমান ফারসির ইসলাম গ্রহণ: সত্যের সন্ধান করলে সত্য নিজেই ধরা দেয়। কীভাবে ধরা দেয়, তারই জ্বলন্ত উদাহরণ সালমানের জীবন। জন্ম তার পারস্যের ইস্পাহানের জায়ান শহরে এক বিত্তশালী পরিবারে। বাবা ছিলেন শহরপ্রধান ও পুরোহিত। অগ্নি-উপাসক হিসেবেই বেড়ে ওঠেন তিনি। একদিন এক চার্চের প্রার্থনায় অংশ নিয়ে তার ভালো লাগে। খ্রিষ্টানরা তাকে জানায়, ধর্ম সম্পর্কে আরো জানতে হলে বড় বিশপের কাছে যেতে হবে। তিনি থাকেন দামেস্কে। সালমানের পিতা বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি ছিলেন গোঁড়া অগ্নি-উপাসক। তাই তিনি ঘরে শিকল দিয়ে বন্দি করে রাখেন সালমানকে।
সালমান একদিন শিকল ভেঙে বেরিয়ে পড়েন। সিরিয়াগামী এক কাফেলার সাথে দামেস্কে পৌঁছান। বিশপের কাছে দীক্ষা নিয়ে খ্রিষ্টান হয়ে যান। সালমান দীর্ঘদিন বিশপের সেবা করেন। কিন্তু পরে দেখতে পান বিশপ অত্যন্ত লোভী ও দুর্নীতিবাজ। বিশপের মৃত্যুর পর সালমান পুরো বিষয়টি ফাঁস করে দেন। আত্মসাৎকৃত বিশাল বিশাল পাত্র বোঝাই স্বর্ণ-রৌপ্য তার অনুসারীদের সামনে উপস্থাপিত করেন। জনসাধারণ এরপর একজন সত্যিকার ধর্মানুরাগীকে তাদের বিশপ মনোনয়ন করেন।
নতুন বিশপ যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সালমান তাকে জিজ্ঞেস করেন, এরপর আমি কার সেবা করব? তিনি বললেন, মসুলে যাও, সেখানে আরেকজন ধর্মপরায়ণের সাক্ষাৎ পাবে। সালমান মসুলে গিয়ে তার সন্ধান পান। তার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি চতুর্থ বিশপের কাছে সালমানকে প্রেরণ করেন। চতুর্থ বিশপ তাকে প্রেরণ করেন আমুরিয়ায় (বর্তমান প্যালেস্টাইনে) আরেক বিশপের কাছে। আমুরিয়ার বিশপ মৃত্যুশয্যায় সালমানকে বলেন, আরবে বহু খেজুর বাগান শোভিত শহরে একজন নবী আসবেন। তুমি সেখানে যাও।
সালমান তাকে আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আমুরিয়ার এক আরব গোত্র কালবের কিছু লোককে টাকা দিলেন। কিন্তু তারা চুক্তিভঙ্গ করে তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে এক ইহুদির কাছে তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিল। ইহুদি বনু কোরায়জার এক আত্মীয়ের কাছে সালমানকে বিক্রি করল। নতুন মালিক তাকে মদিনায় নিয়ে এলো দাস শ্রমিক হিসেবে খেজুর বাগানে কাজ করার জন্যে। মদিনায় নবীজীর আগমনের কথা শুনে সালমান উল্লসিত হয়ে উঠলেন। অনেক ঝামেলার পর তিনি নবীজীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন।
প্রথম সাক্ষাতে সদকা বা দান হিসেবে কিছু খেজুর তাঁকে দিলেন। নবীজী তা না খেয়ে অন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন। কয়েকদিন পর আবার কিছু খেজুর হাদিয়া বা উপহার হিসেবে নবীজীর হাতে দিলেন। নবীজী তা গ্রহণ করে নিজে খেলেন এবং অন্যদের মধ্যে বিতরণ করলেন। বিশপ সালমানকে বলে দিয়েছিলেন সত্যিকার নবী চেনার উপায়। সত্যিকার নবী নিজে কখনো সদকা বা দান গ্রহণ করেন না, তবে উপহার বা হাদিয়া গ্রহণ করেন।
‘নবী’ পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সালমান নবীর পায়ের কাছে পড়ে গেলেন, পায়ে চুমু খেলেন এবং কাঁদতে শুরু করলেন। সালমান তখনই ইসলাম গ্রহণ করলেন। সালমান মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হওয়ার পর সবসময় নবীজীর কাছেই থাকতেন। সালমান মোহাজির না আনসারদের অন্তর্ভুক্ত হবেন, এ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে টানাটানি শুরু হলে নবীজী হেসে বলেন, সে আহলে বায়াতের। প্রাজ্ঞ সালমান ছিলেন মদিনা সুরক্ষায় খন্দক খননের পরামর্শদাতা। নবীজীর সাথে সকল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
ইরাক জয়ের সময় তিনি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের সাথে ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে পারস্যের গভর্নর ও ৩০ হাজার সৈন্যের সেনাপতি হয়েছিলেন। বেতন ছিল ৫০০০ দিরহাম, যা তিনি পুরোটাই দান করে দিতেন। চলতেন নিজের শ্রমার্জিত অর্থে। তার নিজের কোনো বাড়িঘর ছিল না। এক কাপড়েই থাকতেন। ঘুমাতেনও সেই কাপড়ে। বিশ্রাম নিতেন গাছের ছায়ায়। সালমান জেন্দাবেস্তা, বাইবেল এবং কোরআন তিন ধর্মগ্রন্থেই পন্ডিত ছিলেন। কোরআনের প্রথম ফার্সি অনুবাদ তিনিই করেন।
এদিকে, মদিনার উপকণ্ঠে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করল প্রভাবশালী ইহুদি গোত্রপতি কারজ বিন জাবির ফিহরী। সে তার দলবল নিয়ে মুসলমানদের ফলবান বৃক্ষগুলো কেটে ফেলল এবং তাদের ছাগল-ভেড়া ও গবাদি পশু লুট করে নিয়ে গেল। অন্যদিকে, ইহুদি ও মুনাফেকরা মক্কার পৌত্তলিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু করল। কোরাইশদের আশ্বস্ত করল যে, মুসলমানদের আক্রমণ করলে তারা কোরাইশদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
একক কমান্ডের অধীন স্বেচ্ছাসৈনিকদের প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি নবীজী (স) কূটনৈতিক তৎপরতাকে জোরদার করলেন। এক এক করে মদিনার চারপাশে বিভিন্ন গোত্রের কাছে গেলেন। গোত্রের গণ্যমান্যদের বোঝালেন, যদিও তোমরা স্বাধীন, কিন্তু একা। যে-কোনো বহিঃ আক্রমণের মুখে তোমরা কারো সাহায্য পাবে না। আসো, আমরা পারস্পরিক মৈত্রী চুক্তি করি। তাহলে বাইরের যে-কোনো আক্রমণের মুখে আমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারব। অতঃপর মদিনার চারপাশের অমুসলিম গোত্রগুলো ক্রমান্বয়ে মৈত্রী চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠল। বনু জুহায়না, দামরা, গিফার, খুজাদের বনু আমর ও বনি মুদলিজ গোত্রের সাথে পারস্পরিক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হলো।
হিজরি দ্বিতীয় বছরে মদিনার বাইরের বন্ধু গোত্রগুলোর একটা কার্যকর নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেন তিনি। এটি একটি সুদূরপ্রসারী সাফল্য, যা মদিনার নিরাপত্তাকে সংহত করল। কোরাইশদের রণপ্রস্তুতির খবর বিভিন্নভাবে মদিনায় আসতে শুরু করল। কোরাইশরা ইতোমধ্যেই আরবীয় রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মক্কায় রেখে আসা মুসলমানদের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দখল করে নিয়েছে। এখন মদিনায় সামরিক অভিযানের উদ্যোগ মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল।
তাদের মনে প্রশ্নের অনুরণন- আর কতো মুখ বুঁজে অত্যাচার সইব! মদিনায়ও যদি শান্তিতে থাকতে না দেয়, তবে কেন প্রতিরোধ নয়? এই প্রেক্ষাপটে নাজিল হলো নতুন নির্দেশ- ‘যারা অন্যায়ভাবে আক্রান্ত ও অত্যাচারিত হয়েছে, আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হলো। ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’-একথা বলার জন্যে যাদেরকে ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করতে সক্ষম। আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অন্যদল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে বিহার (ছাওয়ামিউ), গির্জা, সিনাগগ আর সেই মসজিদগুলো, যেখানে আল্লাহর নাম বেশি বেশি স্মরণ করা হয়-সবই ধ্বংস হয়ে যেত। যে আল্লাহর (ধর্মের) সাহায্যে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই সাহায্য করেন।....’(সূরা হজ: ৩৯-৪০)
কোরাইশদের তৎপরতার ওপর নজর রাখার ও খবরাখবর সংগ্রহের জন্যে আবদুল্লাহ ইবনে জাহশের নেতৃত্বে আট জনের একটি দলকে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী স্থান নাখলায় প্রেরণ করা হলো। কিন্তু সেখানে পৌঁছার পরই আবদুল্লাহ মক্কার একটা ছোট দলকে দেখতে পেলেন। তাদেরকে তিনি গুপ্তচর বলে সন্দেহ করে একজনকে হত্যা করলেন এবং দুজনকে বন্দি করলেন। দুজন বন্দি ও কাফেলার মালামালসহ তিনি মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
নির্দেশনা অমান্য করে সংঘাতে জড়ানোর ঘটনায় নবীজী বিরক্ত হলেন। মদিনা থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে এই গেরিলা তৎপরতা সামরিক সক্ষমতার প্রকাশ ঘটালেও অনেকে বিরক্ত হলেন ঘটনাটি আরবে যুদ্ধনিষিদ্ধ রজব মাসে সংঘটিত হওয়ায়। আবদুল্লাহ ইবনে জাহশের দলও এক বিড়ম্বনাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন।
এই প্রেক্ষাপটে আয়াত নাজিল হলো- ‘পবিত্র মাসে যুদ্ধ সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তাদের বলো, ‘যুদ্ধ নিশ্চয়ই একটা ভয়ংকর বিষয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে আল্লাহর পথে মানুষকে বাধা দেয়া, আল্লাহকে অস্বীকার করা, কাবা শরিফে ইবাদত করতে বাধা দেয়া, সেখানকার অধিবাসীদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া। আসলে ফেতনা (জুলুম-নিপীড়ন) হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। যদি ওদের পক্ষে সম্ভব হতো, তাহলে তোমরা সত্যধর্ম ত্যাগের ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত ওরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেত। কিন্তু তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি সত্যধর্ম ত্যাগের ঘোষণা দাও এবং সত্য অস্বীকারকারী হিসেবে মারা যাও, তাহলে তার সকল কর্ম নিষ্ফল হবে। জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা। সেখানেই সে থাকবে চিরকাল।’ (সূরা বাকারা : ২১৭)
রমজান সম্পর্কে কোরআন
শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতার লক্ষ্যে সংযমের গুরুত্বের জন্যে রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হয়। রোজা-সংক্রান্ত আয়াতে পরিষ্কার বলা হয়: ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বসূরিদের ওপর। যাতে তোমরা আল্লাহ-সচেতন থাকতে পারো। রোজা নির্দিষ্ট সংখ্যক দিনের জন্যে। কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময়ে সমসংখ্যক দিন রোজা রাখবে। আর রোজা রাখা যাদের জন্যে খুব কষ্টকর, তাদের সামর্থ্য থাকলে ‘ফিদিয়া’ (বিনিময়) অর্থাৎ একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করবে।
আর যদি কেউ আনন্দিতচিত্তে আরো বেশি সৎকর্ম (বেশি সংখ্যক অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান) করে, তবে তা তার জন্যে অতিরিক্ত কল্যাণ বয়ে আনবে। তবে রোজা রাখা তোমাদের জন্যে সবচেয়ে বেশি কল্যাণের, যদি তোমরা জানতে! (সূরা বাকারা : ১৮৩-১৮৪)
‘রমজান মাসেই কোরআন নাজিল হয়েছে। আর কোরআন হচ্ছে মানুষের জন্যে সঠিক জীবনদৃষ্টি ও সত্যপথের দিশারি এবং ন্যায়-অন্যায়, সত্য ও মিথ্যা নিরূপণের নিরঙ্কুশ মানদন্ড। অতএব এখন থেকে যারাই এ মাস পাবে, তাদের জন্যে পুরো মাস রোজা রাখা অবশ্য কর্তব্য। ...’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার, ধূমপান, দুর্ব্যবহার, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, গীবত-পরচর্চা ও যৌনমিলন থেকে নিজেকে পুরোপুরি সংযত রাখাই রোজার বিশেষত্ব। আত্মশুদ্ধির জন্যে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর বছরে একমাস বাধ্যতামূলক রোজার অনুশীলনে নবীজীর অনুসারীরা দৈহিক কষ্ট সহ্য করার ক্ষেত্রে অনেকটা অতিমানবীয় পর্যায়ে উপনীত হন। রোজা যে শুধু দেহের টক্সিন বা আবর্জনা-পরিষ্কারক তা নয়, তা মনের টক্সিন বা আবর্জনাও পরিষ্কার করে সমভাবে। মন দূষণমুক্ত হলে একজন মানুষ প্রবৃত্তির দাসত্বের শৃঙ্খল যেমন ছিন্ন করে, তেমনি আত্মিক শক্তির স্ফূরণে হয়ে ওঠে অপরাজেয়।
এদিকে, মদিনার মুসলমানদের ক্রমাগত সংখ্যাবৃদ্ধি, একক কমান্ডের অধীন যোদ্ধাদল গঠন করে চারপাশে টহল, বিভিন্ন বেদুইন গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তি মক্কার কোরাইশদের অসহিষ্ণুতা ও প্রতিহিংসার আগুনে ঘি নিক্ষেপের কাজ করল। তারা নবীজীকে মদিনা থেকে উচ্ছেদের চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নাখলার ঘটনাকে পুঁজি করে তারা সৃষ্টি করল রণ উন্মাদনা। আবু জেহেলের নেতৃত্বে কোরাইশরা ৯৫০ সুসজ্জিত সৈন্য, ৬০০ বর্ম, ১০০ ঘোড়া ও ৭০০ উটের বাহিনী নিয়ে যাত্রা করল। মনোরঞ্জনের জন্যে সাথে ছিল গায়িকা ও নর্তকী দল। আবু জেহেলের নেতৃত্বে বদরের যুদ্ধের নয় দিন আগে মক্কা থেকে যাত্রা করে কোরাইশ বাহিনী।
কোরাইশ বাহিনীর মোকাবেলায় নবীজী মাত্র ৩১৩ জন অনুসারী এবং দুইটি ঘোড়া ও ৭০টি উটের মতো সীমিত উপকরণ নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করলেন যুদ্ধের পাঁচ দিন আগে। যাত্রার গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে উটের গলা থেকে ঘণ্টি খুলে ফেলতে বললেন। ফলে রাতের আঁধারে যাত্রাকালেও ঘণ্টির আওয়াজ না হওয়ায় আশেপাশের কেউ কাফেলার অবস্থান বুঝতে পারে নি।
বাহন হিসেবে প্রতি তিন/চার জনের ভাগে পড়ল একটি উট। পালাক্রমে দুই জন বা একজনকে হাঁটতে হবে। নবীজীর উটের সাথে আলী ও আবু লুবাবা। যখন নবীজীর হাঁটার পালা এলো তখন দুজনই বললেন, আপনার বদলে আমরাই হাঁটব। নবীজী স্মিত হেসে বললেন, ‘হাঁটার ব্যাপারে তোমরা কেউই আমার চেয়ে শক্তিমান নও! আর (সৎকর্মের) পুরস্কারের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে আমার প্রয়োজন কোনো অংশে কম নয়।’
তিনি ১৬০ কিলোমিটার কঙ্করময় মরুপথের পুরোটাই অপর দুই তরুণ সঙ্গীর সাথে পালাক্রমে হাঁটলেন। নবীজী বলতেন, যাত্রাপথে নেতা হচ্ছেন অনুসারীদের সেবক। জীবনের প্রতিটি যাত্রায় তিনি এই ভূমিকা যথাযথভাবেই পালন করেছেন। নবীজী শুধু নিজেই ওয়াদা পূরণ করেন নি। তাঁর অনুসারীরাও যাতে ওয়াদা ভঙ্গ না করে, সে ব্যাপারেও সবসময় তাদেরকে তাগিদ দিয়েছেন।
বদরের প্রান্তরে পৌঁছার আগে হুজাইফা ইবনে ইয়ামন এবং আবু হামীল নবীজীর সাথে দেখা করলেন। তারা বললেন যে, পথে কোরাইশরা আমাদের আটক করে। আমরা আপনার সাথে যুদ্ধে যোগদান করতে যাচ্ছি কিনা জিজ্ঞেস করায় আমরা বলেছি যে, না! আমরা মদিনায় যাচ্ছি। ‘আপনার সাথে এখন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব না’ এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। এখন আমরা কী করব?
ক্ষুদ্র দলের একজন সেনানায়কের জন্যে তখন দুই জন যোদ্ধাও যে কত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তা সহজেই আঁচ করতে পারি। কিন্তু তখনো নবীজী তাদের বললেন, যুদ্ধে অংশ নিয়ে তোমাদের ওয়াদা ভঙ্গ করার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা মদিনায় যাও। আর বিজয়ের জন্যে দোয়া করতে থাকো। আসলে একজন সেনানায়ক কতটা সত্যপ্রেমিক ও আল্লাহ-সচেতন হলে এটা সম্ভব, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।
সংঘাত এড়াবার সর্বশেষ চেষ্টা!
নবীজী যুদ্ধযাত্রার চতুর্থ দিন বদরের উপকণ্ঠে দাফিরানে শিবির স্থাপন করলেন। সেখানে সবাই খবর পেল মক্কা থেকে বিশাল কোরাইশ বাহিনী বদরের কাছাকাছি শিবির গেড়েছে। নবীজী শান্তির জন্যে, সশস্ত্র সংঘাত এড়ানোর জন্যে সর্বশেষ চেষ্টা করলেন। তিনি শান্তি প্রস্তাব দিয়ে ওমর ইবনে খাত্তাবকে দূত হিসেবে পাঠালেন আবু জেহেলের শিবিরে। নবীজীর পক্ষ থেকে তিনি সুস্পষ্টভাবে বললেন, আমি শান্তি চাই। সংঘাত চাই না। আমি চাই না আত্মীয়ের রক্তে আত্মীয়ের হাত রঞ্জিত হোক। আপনি সবাইকে নিয়ে সসম্মানে মক্কায় ফিরে যান।
মক্কার শিবিরের উতবা ইবনে রাবিয়া ও হাকিম ইবনে হিজাম ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। কিন্তু আবু জেহেল তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলল, সমস্যার সমাধান হবে তলোয়ার দিয়েই। এ অবস্থায় নবীজী সাহাবীদের সাথে বৈঠকে পরামর্শ আহ্বান করলেন। আবু বকর, ওমর তাদের বক্তব্য রাখলেন। নবীজী চাচ্ছিলেন আনসারদের মতামত। কারণ আকাবা বায়াতে আনসাররা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, আক্রান্ত হলে তারা নবীজীকে রক্ষায় প্রাণপাত করবে। কিন্তু এখন যুদ্ধ মদিনার বাইরে। অতএব খোলা মনে তাদের মতামত প্রয়োজন।
আল মিকদাদ ইবনে আমরের পর আনসার নেতা সাদ ইবনে মুয়াজ জ্বালাময়ী ভাষায় নবীজীর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা আপনার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনি যা-ই সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা আছি আপনার সাথে। যিনি আপনাকে রসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন, তাঁর শপথ! আপনি যদি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা প্রত্যেকেই সমুদ্রে ঝাঁপ দেবো। আমাদের কোনো ভয় নেই। আগামীকালের যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের সাহসিকতায় আপনি গর্বিত হবেন।’
সাদের বক্তব্য শেষ হতেই নবীজীর চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘এগিয়ে যাও। আশাবাদী হও। আল্লাহর শপথ! ময়দানে আমি শত্রুদের লাশ পড়ে থাকতে দেখছি।’ শিবির তুলে নিয়ে নবীজী অগ্রসর হলেন। সকল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার পর বদরের প্রান্তরে অবস্থান নেয়ার জন্যে থামলেন। তখন যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী আনসার হুবাব ইবনে মুনযির জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে অবস্থান নেয়া কি ওহীর নির্দেশ?’ নবীজী বললেন, ‘না, এটা আমার ব্যক্তিগত চিন্তা।’
তখন হুবাব বললেন, তাহলে হে আল্লাহর রসুল! সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবস্থান নেয়ার যথোপযুক্ত স্থান হবে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে সর্বশেষ সুপেয় পানির কূপের পাশে। সেখানে অবস্থান নিলে কূপটাকে আমরা আমাদের জলাধার বানিয়ে ফেলতে পারব। ফলে শত্রুরাও বঞ্চিত হবে পানির সরবরাহ থেকে। নবীজী বললেন, ‘উত্তম পরামর্শ’। মুসলিম বাহিনী কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সেভাবেই অবস্থান গ্রহণ করল। আসলে, আল্লাহর রসুল হওয়া সত্ত্বেও বাস্তব যে-কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞদের উত্তম পরামর্শ তিনি সবসময় সানন্দচিত্তে গ্রহণ করতেন।
বদরের এ সংঘর্ষে আরবে অপরিচিত রণকৌশল ব্যবহার করলেন নবীজী। যোদ্ধাদের সারিবদ্ধ অবস্থান (প্রথম সারিতে বল্লমধারী, দ্বিতীয় সারিতে তীরন্দাজ, তৃতীয় সারিতে তরবারি যোদ্ধা) এবং আধুনিক যুদ্ধের ন্যায় কমান্ড পোস্ট পেছনে স্থাপন করলেন। নিজে সরাসরি রণক্ষেত্রে অবস্থান না করে একটু উঁচু স্থানে তাঁবু স্থাপন করে সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ৩১৩ জন বিভিন্ন বয়সের স্বেচ্ছাযোদ্ধা ও সীমিত যুদ্ধ উপকরণ নিয়ে বদর প্রান্তরে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করলেন তিনি।
যুদ্ধের আগে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ঘোরতর সংঘর্ষের সময় দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে ফরিয়াদ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আজকে যদি বিশ্বাসীদের এই ছোট দলটি পরাজিত হয়, তবে এ ভূখন্ডে তোমার ইবাদত করার কেউ থাকবে না।’
সত্যের জন্যে, কল্যাণের জন্যে যখন সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ নিজেদের উৎসর্গ করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তাদের সহায় হন। বদরের প্রান্তরে আবু জেহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়েবা ইবনে রাবিয়া, আল ওয়ালিদ ইবনে উতবা, উমাইয়া ইবনে খালাফ, উকবা ইবনে আবু মুয়িত, ওমর ইবনে আল ওয়ালিদ, আবুল বাখতারি প্রমুখ ২৪ জন কোরাইশ নেতাসহ ৭০ জন নিহত হন। বন্দি হন ৭০ জন। মুসলিমদের পক্ষে ১৪ জন শহিদ হন। প্রতিপক্ষ রণেভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলে মুহাম্মদ প্রথম ১৪ জন শহিদকে কবরস্থ করেন।
তারপর নিজ তত্ত্বাবধানে এক এক করে কোরাইশ ২৪ নেতার লাশ একটা বড় গর্তে নামানোর ব্যবস্থা করেন। প্রত্যেকের নাম ধরে তিনি আক্ষেপ করেন ‘হায়! তোমরা কী পরিণতির শিকার হলে!’ ৭০ জনের লাশ গর্তে নামানোর পর ভালো করে মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে কোনো বন্যপ্রাণী লাশের অমর্যাদা করতে না পারে। যারা তাঁকে ১৫ বছর কষ্ট দিয়েছে, নির্যাতন করেছে, যারা মক্কায় রেখে আসা সকল সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে, যারা তাঁকে হত্যা ও ধ্বংস করার জন্যে বদর পর্যন্ত ছুটে এসেছে, তাদের লাশেরও কোনো অমর্যাদা তিনি হতে দেন নি।
কেন এ বিজয়!
তিন গুণ সুসজ্জিত শত্রুর বিরুদ্ধে এই অসমযুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের মূল কারণ ছিল তাদের মহৎ লক্ষ্য। গোত্রীয় প্রতিশোধ বা ব্যক্তির গৌরবগাথা নির্মাণের জন্যে তারা লড়াই করেন নি। তারা লড়াই করেছিলেন বঞ্চিতের অধিকার রক্ষার জন্যে। শোষকদের শোষণের অবসান ঘটানোর জন্যে, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে। নিজেদের স্বাধীন ধর্মপালনের অধিকারকে সমুন্নত রাখার জন্যে।
একীভূত কমান্ডের অধীনে সুশৃঙ্খল নিবেদিতপ্রাণ স্বল্পসংখ্যক জনযোদ্ধা ইতিহাসের গতিপথ কীভাবে পাল্টে দিতে পারে, বদর হচ্ছে তারই প্রমাণ। বদরের পুরো অভিযান একজন ক্ষণজন্মা সমরবিদের নিখুঁত ছক। সীমিত উপকরণ ও স্বল্প লোকবল নিয়ে বৃহৎ আগ্রাসী শত্রুকে কীভাবে ফাঁদে ফেলতে হয় বদর হচ্ছে তার উদাহরণ। এমনকি একটি যুদ্ধের পরিকল্পনা বা লক্ষ্যের গোপনীয়তা কীভাবে বজায় রাখতে হয়, তাও বোঝা যায় বদরের যুদ্ধযাত্রা থেকে।
অন্যদিকে, কোরাইশদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে ফিরে আসছিল বিপুল অস্ত্রসম্ভার ও মালামাল নিয়ে। নেতৃত্বে ছিলেন ধূর্ত ও ঝানু ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান। বাণিজ্য কাফেলা ফেরত যাচ্ছে মদিনা বা মক্কায় এ কথা সবারই জানা। নবীজীর যুদ্ধযাত্রা থেকে সৈন্যদলের সবাই স্বাভাবিকভাবে ধরে নিল বাণিজ্য কাফেলা হচ্ছে লক্ষ্য। (অধিকাংশ সীরাতকারও এই বিবরণই দিয়েছেন।) বাস্তবে তিনি লক্ষ্য সম্পর্কে মৌনতা অবলম্বন করলেন। কারণ তিনি চাচ্ছিলেন মক্কার কোরাইশ বাহিনীকে মোকাবেলা করতে।
তিনি গণ-মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানতেন যে, বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া আর সুসজ্জিত বিশাল শত্রু শক্তির সাথে মুখোমুখি সমরে উৎসাহী হওয়া এক কথা নয়। তবে একবার ময়দানে নেমে পড়লে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া সহজ। ঘটনার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, অভিযানের লক্ষ্য যদি আবু সুফিয়ানের কাফেলা হতো, তবে তিনি মক্কার দিকে না এগিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়ার দিকে যেতেন। বদরের দিকেও তিনি সহজ পথে দ্রুত না গিয়ে আঁকাবাঁকা জটিল পথে থেমে থেমে অগ্রসর হয়েছেন। এর কারণ একটাই হতে পারে, বাণিজ্য কাফেলা যাতে খবর পেয়ে ভিন্ন পথে চলে যেতে পারে।
কারণ তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, কাফেলার মালামাল দখলে নেয়ার পর বিক্ষিপ্ত যোদ্ধারা কোরাইশদের মোকাবেলায় ঝরা পাতার মতো ঝরে পড়বে। তাই তিনি কাফেলাকে চলে যাওয়ার সুযোগ করে রাখেন।
প্রশ্ন আসতে পারে, কাফেলার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে কোরাইশরা তো আর অগ্রসর না হয়ে ফিরেও যেতে পারত? না, তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল কম। কারণ, আবু জেহেল মক্কা থেকে বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেছিলেন নবীজী মদিনা থেকে রওয়ানা হওয়ারও চার দিন আগে। উদ্দেশ্য কাফেলা রক্ষা নয়, উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বিনাশ করা। নবীজী আবু জেহেলের মনস্তত্ত্ব খুব ভালোভাবেই জানতেন।
আবু জেহেল মনে করেন, মুসলমানদের ধ্বংস করার এমন চমৎকার সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। তাই এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চান নি। কারণ একবার খালি হাতে ফিরে গেলে দ্বিতীয়বার সবাইকে জড়ো করে যুদ্ধযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়বে। হলোও তাই। আবু জেহেল ফাঁদে পা দিলেন। পরিণতিতে মক্কার নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, যা ছিল বদর যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
নবীজী যুদ্ধের আগের বিকেলেই বদর প্রান্তরে কোথায় কোথায় কোরাইশদের কোন কোন নেতার লাশ পড়ে থাকবে তা সঙ্গীদের বলেছেন। যুদ্ধের টার্গেট সম্পর্কে এর চেয়ে ভালো নির্দেশনা আর কীভাবে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া বদর অভিযানের লক্ষ্য যে বাণিজ্য কাফেলা ছিল না, তা বোঝা যায় আরেকটি বিষয় থেকে। তা হচ্ছে ইতঃপূর্বে সকল অভিযাত্রা ছিল মূলত মোহাজিরদের নিয়ে, যাদের যুদ্ধের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। এবারই অভিযাত্রায় প্রথম মদিনার আনসার আউস ও খাজরাজ গোত্রের দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা যুক্ত হন।
আনসারদের একজন নেতা হুবাবের পরামর্শ অনুসারেই নবীজী বদর প্রান্তরে সেনা অবস্থান পরিবর্তন করেন। যুদ্ধ জয়ের অন্যতম সহায়ক ছিল এই কৌশলগত অবস্থান। আপনার মনে হতে পারে পুরো বিষয়টি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অবশ্যই। আর বিজয়ের জন্যে প্রয়োজন কৌশল ও ঝুঁকি নেয়ার সাহস।
বদরের যুদ্ধবন্দিদের সাথে কী আচরণ করা হয়েছিল, তা সবচেয়ে বিদ্বেষভাবাপন্ন নবী-জীবনীকার স্যার উইলিয়াম মুরের ভাষায়- ‘মুহাম্মদের নির্দেশ অনুসারে মদিনার অধিবাসীদের যাদের ঘর রয়েছে তাদের কাছে যুদ্ধবন্দিদের ভাগ করে দেয়া হয়। তারা এদের পর্যাপ্ত যত্ন নেয়।’ একজন বন্দির শপথ করা উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লেখেন, ‘মদিনার লোকেরা আমাদের উটের পিঠে বসিয়ে নিয়েছে, যেখানে তারা নিজেরা হেঁটেছে। রুটি থাকলে আমাদের রুটি দিয়েছে, তারা খেজুর খেয়েই তৃপ্ত থেকেছে।
বিত্তবান বন্দিরা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। আর যারা লেখাপড়া জানত, তারা ১০ জন শিশুকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। এই শিক্ষাদানই ছিল মুক্তিপণ।’ এই প্রক্রিয়ায় মক্কার ৬০ জন যুদ্ধবন্দি মদিনার ৬০০ জন কিশোর ও নিরক্ষরকে লিখতে ও পড়তে শেখান। এদের কাছে শিক্ষিত জায়েদ ইবনে সাবিত পরবর্তীতে ওহী লেখক হিসেবে বিখ্যাত হন। মসহাফে উসমানীর লিপিকরও ছিলেন তিনি। এ থেকে বোঝা যায়, শুধু নামমাত্র নয়, কার্যকরী শিক্ষা গ্রহণকে নবীজী কত গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও তিনি মুশরিকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
যুদ্ধবন্দিদের নির্মমভাবে হত্যা করাই ছিল যে আরবীয় প্রথা, সেখানে মুক্ত করে দিতে বললেন নবীজী যুদ্ধবন্দিদের প্রতি আচরণ কতটা মানবিক হওয়া সম্ভব, বদর হচ্ছে তার আলোকোজ্জ্বল উদাহরণ। যুদ্ধবন্দিদের নির্মমভাবে হত্যা করা ছিল তখনকার আরবীয় প্রথা। এত বন্দি নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হলো। সাদ ইবনে মুয়াজ এবং ওমর ইবনে খাত্তাব বললেন, ‘এদের সবাইকে হত্যা করা হোক।’
বন্দিদের মধ্যে সুহাইল ইবনে আমর-এর মতো নেতৃস্থানীয় কোরাইশরাও ছিল। সুহাইল কোরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বাগ্মী। কোরাইশ যোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার পেছনে তার ভূমিকাও ছিল প্রবল। ওমর সুহাইলকে কঠিন শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব করলেন। নবীজী বললেন, ‘ওমর ওকে ছেড়ে দাও। একদিন হয়তো তার কথাই তোমাকে তৃপ্তি দেবে।’ ক্রুদ্ধ ওমর নীরবে তরবারি কোষবদ্ধ করলেন।
নবীজীর ওফাতের পর যখন পুরো আরবভূমিতে প্রতিবিপ্লবীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, মক্কার মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে বিদ্রোহ করার কানাঘুষা শুরু হলো, তখন এই সুহাইল ইবনে আমরই কাবার দরজায় দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ইসলামের পক্ষে তাদের ঐক্যবদ্ধ রাখেন। সুহাইলের এই ঘটনা শোনার পর ওমর ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন, আমি যদি বদরে ঐদিন আমার অস্ত্র সংবরণ না করতাম, তাহলে এই তৃপ্তিদায়ক ঘটনা আমি শুনতে পারতাম না।
সৃষ্টির জন্যে করুণাস্বরূপ যিনি প্রেরিত হয়েছেন, যুদ্ধবন্দিদের সাথে তিনি কীভাবে অমানবিক হতে পারেন! যারা প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে এসেছিল, সমমর্মিতা দিয়ে তিনি তাদের অন্তরকে জয় করার উদ্যোগ নিলেন। প্রথমেই বললেন, সবার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দাও এবং সবার সাথে সম্মানজনক আচরণ করো। বদরে তাঁর সাহাবীদের পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়ের হত্যাকারী বন্দিরা যাতে কোনো নিগ্রহের শিকার না হয়, সেজন্যে তিনি অবলম্বন করলেন বিশেষ সতর্কতা। বন্দিদের দেখাশোনার জন্যে সাহাবীদের এমন সব পরিবারকেই তিনি বেছে নিলেন, যারা তাদের সাথে সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করবে।
তিনি নিহত আবু জেহেলের ভাই খালেদ ইবনে হিশাম এবং উমাইয়া ইবনে আবি হুজাইফার দায়িত্ব অর্পণ করলেন বনু মাখজুম গোত্রভুক্ত তাদেরই চাচাত বোন উম্মে সালমার ওপর। অসাধারণ সমমর্মিতা ও মহানুভবতা দেখে বন্দিদের হৃদয়ও বিগলিত হতে শুরু করল। যারা এসেছিল হত্যা করতে তাদের ১৬ জন অর্থাৎ বন্দিদের ২৩ শতাংশ ইসলাম গ্রহণ করল পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে।
মুক্ত হওয়ার পর বন্দিদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে সুহাইল ইবনে আমর, আকিল ইবনে আবু তালিব, আবু আল আস, খালেদ ইবনে হিশাম, খালেদ ইবনে আসিদ, আদি ইবনে আল খিয়ায়ের, আবু ওয়াদা ইবনে আল সুবিরা, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে খালাফ, সাইব ইবনে আবু হুবাইশ, নাসতাস, আবদ ইবনে যামা, কায়েস ইবনে আল-সাইব, আবু আজিজ ইবনে ওমায়েরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আসলে ক্ষমা ও মমতা সবসময় হৃদয়কে জয় করে।
বদরের যুদ্ধ হয়েছিল ১৭ রমজান, শুক্রবার ২য় হিজরি। বদরের বিজয়ী যোদ্ধারা ফিরে এলে ব্যাপক উল্লাস-ধ্বনির মধ্য দিয়ে তাদের মদিনায় বরণ করা হয়। সর্বত্র শঙ্কামুক্ত হওয়ার আনন্দ। রমজান মাস শেষে প্রথমবারের মতো ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। ঈদের নামাজের আগে দরিদ্রদের মাঝে ফিতরা বিতরণ করা হয়, যাতে সবাই আনন্দের অংশীদার হতে পারে।
সূরা আনফালে এই আনন্দচিত্রের চমৎকার বিবরণ রয়েছে: ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা! যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে কম, তোমাদের গণ্য করা হতো দুর্বল ও শক্তিহীনরূপে। আশঙ্কা করতে কখন প্রতিপক্ষ তোমাদের পাকড়াও ও সর্বস্বান্ত করে। তারপর তিনি তোমাদের আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করলেন, নিজ রহমতে তোমাদের শক্তিশালী করলেন। দান করলেন উত্তম জীবনোপকরণ যাতে তোমরা শোকরগোজার হতে পারো।’ (সূরা আনফাল: ২৬)
মক্কায় ফিরে আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস যখন বদরের বিপর্যয়ের কথা আবু লাহাবকে বলছিলেন, তখন কাছেই ছিলেন আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মুল ফদল ও তার দাস আবু রাফি। তারা দুজনই ছিলেন মুসলমান। আবু রাফি এই খবরে উল্লাস প্রকাশ করলে আবু লাহাব তাকে বেদম প্রহার করলেন। উম্মুল ফদল দাসকে রক্ষা করার জন্যে দৌড়ে গেলেন এবং রাগের মাথায় তাঁবুর একটা আস্ত খুঁটি আবু লাহাবের মাথায় ভাঙলেন। আবু লাহাব গুরুতর আহত হলেন। তার অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটল এবং কয়েকদিন পর তিনি মারা গেলেন।
বদরে পরাজিত হওয়ার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যে কোরাইশরা মরিয়া হয়ে উঠল। তারা আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাসীর দরবারে সেখানে হিজরতকারী মুসলমানদের মক্কায় ফেরত আনার জন্যে এক শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করল। নবীজী এই তৎপরতার খবর পেয়েই আমির ইবনে উমাইয়াকে মুসলমানদের পক্ষে তদবির করার জন্যে রাজা নাজ্জাসীর দরবারে প্রেরণ করলেন।
আমির খুব সফলভাবে মুসলমানদের পক্ষে নাজ্জাসীর দরবারে বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। কোরাইশদের কূটনৈতিক মিশন ব্যর্থ হলো। উল্লেখ্য যে, আমির ইবনে উমাইয়া তখনও পৌত্তলিক ছিলেন এবং বদরের সংঘর্ষে কোরাইশ পক্ষে অংশও নিয়েছিলেন। কিন্তু আমির ইবনে উমাইয়া নবীজীর মক্কার জীবনে ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন এবং তিনি বদরের দুমড়া গোত্রের একজন গোত্রপতি। রাজা নাজ্জাসীর সাথেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ধর্মগোত্র নির্বিশেষে উপযুক্ত মানুষের দক্ষতাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে নবীজী সবসময় অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন।
এনএস/