‘সূরা হুমাযাহ’র মর্মবাণী ও তাফসীর
প্রকাশিত : ১৬:২৬, ১৪ মে ২০২০
মাহে রমজানে আমরা বেশি বেশি কোরআন পাঠ করব। চেষ্টা করব অর্থ বুঝে তবেই পাঠ করার। সব সময় কোরআনের সঙ্গে থাকব। কারণ এ মাসেই আল্লাহ মহা পবিত্র আল কোরআন নাজিল করেছেন। এই কোরআন মানবজাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও মুক্তির দিশারি বা পথপ্রদর্শক।
আজ আমরা পবিত্র কোরআন শরীফের ১০৪ নম্বর সূরা ‘সূরা হুমাজাহ’ পাঠ করব। সেই সঙ্গে জেনেনিব এর ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে।
১০৪. সূরা হুমাজাহ
পারা ৩০, আয়াত ৯, রুকু ১ (মাক্কী)
বাংলা উচ্চারণ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
অইলুল্লি কুল্লি হুমাযাতিল ল্লুমাযাতি। নিল্লাযী জ্বামা’আ মালাও অ’আদ্দাদাহু। ইয়াহসাবু আন্না মা-লাহু আখলাদাহ। কাল্লা লাইয়ুমবাযান্না ফিল হুত্বামাহ। অমা আদরাক্বামাল হুত্বামাহ। না-রুল্লা হিল মূ’ক্বাদাত। আল্লাতী তাত্তায়ালিউ ‘আলাল আফয়িদাহ। ইন্নাহা ‘আলাইহিম মু’ছাদাতুন। ফী ‘আমাদিম মুমাদ্দাদাহ।
মর্মবাণী
দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে সামনাসামনি দুর্ব্যবহার করে এবং পেছনে নিন্দা করে।
২. (দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে) যে (কৃপণের মতো) অর্থ জমায় আর বার বার তা গণনা করে এবং একে নিজের রক্ষাকবচ মনে করে।
৩. সে মনে করে তার অর্থ তাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। ৪. না, কখনো নয়। সে-তো (পরকালে) ‘হুতামা’য় নিক্ষিপ্ত হবে। ৫. তুমি কি জানো ‘হুতামা’ কী? ৬-৯. হুতামা হচ্ছে বিশাল প্রজ্জ্বলিত চুল্লি, যার আগুন হৃদয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দহন করবে। বিশাল স্তম্ভসমূহ পরিবেষ্টিত চুল্লির মুখও ঢেকে দেয়া হবে (দহনযন্ত্রণাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্যে)।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এই সূরায় এমন কিছু নৈতিক অসৎবৃত্তির নিন্দা করা হয়েছে যেগুলো জাহেলী সমাজে অর্থলোলুপ ধনীদের মধ্যে পাওয়া যেতো। প্রত্যেক আরববাসী জানতো, এই অসৎ প্রবণতাগুলো যথাথই তাদের সমাজে সক্রিয় রয়েছে। সবাই এগুলোকে খারাপ মনে করতো। একজনও সৎগুণ মনে করতো না এবং প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতো না। এই জঘন্য প্রবণতাগুলো পেশ করার পর আখেরাতে এই ধরনের চরিত্রের অধিকারী লোকদের পরিণাম কি হবে তা বলা হয়েছে। এই দু’টি বিষয় (অর্থাৎ একদিকে এই চরিত্র এবং অন্যদিকে আখেরাতে তার এই পরিণাম) এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যার ফলে শ্রোতা নিজে নিজেই এই সিদ্ধান্তে পৌছুতে পারেন যে, এই ধরনের কাজের ও চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির পরিণাম এটিই হয়ে থাকে। আর যেহেতু দুনিয়ায় এই ধরনের চরিত্রের লোকেরা কোন শাস্তি পায় না বরং উলটো তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখা যায় তাই আখেরাত অনিবার্যভাবে অনুষ্ঠিত হবেই।
সূরা যিলযাল থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো সূরা চলে এসেছে এই সূরাটিকে সেই ধারাবাহিকতার রেখে বিচার করলে মক্কা মু’আয্যমার প্রথম যুগে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও তার নৈতিক শিক্ষাবলী মানুষের হৃদয়পটে অংকিত করার জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল তা মানুষ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। সূরা যিলযালে বলা হয়েছে, আখেরাতে মানুষের সমগ্র আমলনামা তার সামনে রেখে দেয়া হবে। সে দুনিয়ায় যে সামান্য বালুকণা পরিমাণ নেকী বা গোনাহ করেছিল তা সেখানে তার সামনে আসবে না এমনটি হবে না। সূরা আদিয়াত- এ আরবের চতুর্দিকে যেসব লুটতরাজ, হানাহানি, খুনাখুনি ও দস্যূতা জারী ছিল সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। তারপর আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিগুলোর এহেন অপব্যবহার তাঁর প্রতি বিরাট অকৃজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়, এ অনুভূতি জাগ্রত করার পর লোকদেরকে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারটি এই দুনিয়াতেই শেষ হয়ে যাবে না বরং মৃত্যুর পর আর একটি জীবন শুরু হচ্ছে, সেখানে কেবল তোমাদের সমস্ত কাজেরই নয় বরং নিয়তও যাচাই বা পর্যালোচনা করা হবে।
আর কোন ব্যক্তি কোন ধরনের ব্যবহার লাভের যোগ্য তা তোমাদের রব খুব ভালোভাবেই জানে। সূরা আল কারিয়াহতে কিয়ামতের নকশা পেশ করার পর লোকদেরকে এই মর্মে সর্তক করে দেয়া হয়েছে যে, মানুষের নেকীর পাল্লা ভারী না গোনাহর পাল্লা ভারী হচ্ছে এরি ওপর নির্ভর করবে আখেরাতে তার ভালো বা মন্দ পরিণাম। যে বস্তুবাদী মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত দুনিয়ার লাভ, স্বার্থ, আয়েশ - আরাম, ভোগ ও মর্যাদা বেশী বেশী করে অর্জন করার ও পরস্পর থেকে অগ্রবর্তী হবার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে সূরা তাকাসুরে তার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
তারপর এই গাফলতির অশুভ পরিণতি সস্পর্কে মানুষকে সজাগ করে বলা হয়েছে। এ দুনিয়া কোন লুটের মাল নয় যে, তার ওপর তোমরা ইচ্ছামতো হাত সাফাই করতে থাকবে। বরং এখানে তুমি এর যেসব নিয়ামত পাচ্ছো তার প্রত্যেকটি কিভাবে অর্জন করেছো এবং কিভাবে ব্যবহার করেছো তার জন্য তোমার রবের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সূরা আসর এ একেবারে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে, যদি মানবজাতির ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ঈমান ও সৎকাজ না থাকে এবং তার সমাজ ব্যবস্থায় হক পথ অবলম্বন ও সবর করার উপদেশ দেবার রীতি ব্যাপকতা লাভ না করে, তাহলে তার প্রত্যেক ব্যক্তি, দেশ জাতি এমনকি সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে অবস্থান করবে। এর পরপরই আসছে সূরা ‘আল হুমাযাহ’। এখানে জাহেলী যুগের নেতৃত্বের একটি নমুনা পেশ করে লোকদের সামনে যেন এ প্রশ্ন রাখা হয়েছে যে, এই ধরনের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের অধিকারী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কেন?
তাফসীর
মানুষের মাঝে বিরাজিত তিনটি পাপকে কঠোর ভাষাতে নিন্দা করা হয়েছে :
১) কুৎসা রটনাকারী, যারা মহিলা বা পুরুষদের সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে অথবা কটাক্ষ বা বক্রোক্তি করে অথবা মন্দ আচরণ বা বিদ্রূপ ব্যঙ্গের উদ্দেশ্যে অনুকরণ করে, অথবা অপমান করে ইত্যাদি।
২) গীবতকারী অর্থাৎ যারা পশ্চাতে নিন্দা করে, ব্যক্তির চরিত্রহানি বা মানহানি করে। তাদের বক্তব্য যদি সঠিকও হয়, কিন্তু তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি ব্যক্তির চরিত্র সংশোধন অপেক্ষা ব্যক্তির চরিত্র হননই হয়ে থাকে, তবে তা-ও গীবতের পর্যায়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ্ বিচার করবেন কর্মের উদ্দেশ্য বা নিয়ত দ্বারা কর্ম দ্বারা নয়।
৩) যারা সম্পদের পাহাড় গড়তে ভালোবাসে, কিন্তু তা কখনও জনহিতকর কাজে ব্যয় করে না। এ সব লোকেরা কখনও পরলোকের কথা বা মৃত্যুর কথা চিন্তা করে না। অর্থের আদান -প্রদান ও প্রাপ্তি তাদের পরলোকের জীবনকে ভুলিয়ে দেয়, যেনো তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। অর্থের প্রতি প্রচন্ড মোহ থেকে কৃপণতা স্বভাবের জন্ম হয় যা একটি কুৎসিত মনের প্রকাশ।
‘হুত্বামাহ’ যার অর্থ ধ্বংসকারী বা যা টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দেয়। যে তিনটি সামাজিক পাপের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে তাদেরই প্রকৃত রূপকে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে হুতামা দ্বারা। কুৎসা রটনাকারী ও গীবত কারীরা কখনও কোনও ব্যাপারেই নিজেদের মাঝে সংহতি ও একতা রক্ষা করতে পারবে না। তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে তারা কখনও পারস্পরিক বিশ্বাস রক্ষা করতে পারবে না। অপরের কুৎসা রটনা করা ও গীবত করা একধরণের মানসিক ব্যধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক অবস্থাকেই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে হুতামা শব্দটি দ্বারা। লক্ষ্য করুণ আয়াতটির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সমগ্র বাঙ্গালী জাতিই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত যে কারণে বাঙ্গালীরা জাতি হিসেবে ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংহতি ও একতা রাখতে অক্ষম। তাদের একতা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে।
অপর পক্ষে কৃপণতা ও অর্থের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণও মানসিক ব্যাধির জন্ম দেয়। কৃপণতার ফলে ব্যক্তির মন মানসিকতা এ রূপ ধারণ করে যে, সে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অর্থ সাহায্য করতে বা ব্যয় করতে সব সময়েই কুণ্ঠিত থাকবে ফলে সে মানুষের ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা থেকে বঞ্চিত হবে, মানুষ তাকে কখনও বিশ্বাস করবে না। এদের শেষ পরিণতি ‘হুতামায়’। অর্থাৎ পারস্পরিক বিশ্বাস ও একতার ব্যাপারে এরা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়বে।
হুতামাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, ‘ইহা আল্লাহ্র, ক্রোধের প্রজ্বলিত আগুন বা হুতাশন, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।’ অর্থাৎ কুৎসা রটনাকারী, গীবতকারী ও কৃপণ ব্যক্তিদের মাঝে কখনও সংহতি ও একতা হতে পারে না। তারা কাউকে বিশ্বাস করবে না; অন্য কেউ তাদের বিশ্বাস করবে না। ফলে তাদের অন্তরের মাঝে মানুষের জন্য ভালোবাসা জন্মাবে না, মানুষও তাদের ভালোবাসবে না। অবিশ্বাসে ভরা, ভালোবাসাহীন জীবন তাদের অন্তরের শান্তি নষ্ট করে দেবে এবং অন্তর হুতাশনে ভরিয়ে দেবে যা প্রজ্বলিত আগুনের মত যন্ত্রণাদায়ক মনে হবে। এই আগুনের বর্ণনা হচ্ছে; ‘যা হৃদয়কে গ্রাস করবে।’ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ভাষার প্রকাশকে। আরবীতে হৃদয় শব্দটি দ্বারা বিশাল ভাবের প্রকাশ ঘটানো হয়। আরবীতে ‘হৃদয়’ শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয় স্নেহ, ভালোবাসা, দয়া, করুণা, ইত্যাদি মনের কোমল অনুভূতি সমূহ বা সুকুমার বৃত্তিসমূহ। শুধু তা-ই নয় ব্যপক অর্থে এই শব্দটি দ্বারা বুঝানো হয় অনুভব ও উপলব্ধির ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। চিন্তা করুণ, যে এই নিন্দনীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত তার অন্তরে আল্লাহ্ হুতাশন সৃষ্টি করে দেবেন যার ফলে তার আত্মার কোমল অনুভূতি সমূহ ও আধ্যাত্মিক জগতকে বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে মানুষের দেহ ধারণ করলেও এরা মানসিক ও মানবিক গুণে বঞ্চিত হবে।
যারা এই পাপে আচ্ছন্ন থাকবে তারা আল্লাহ্র শাস্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবে, যা তাদের জন্য হবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। আগুনের দ্বারা পরিবেষ্টিত হলে অক্সিজেনের অভাবে এবং ধোঁয়া দ্বারা যেরূপ শ্বাস রুদ্ধ হয়ে পড়ে, এ সব লোকের অবস্থা হবে তদ্রূপ। শাস্তির আগুনের স্তম্ভ সমূহ তাদের পরিবেষ্টিত করে ফেলবে। এই যন্ত্রণা দায়ক স্তম্ভ, জীবিত অবস্থাতেই হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং হৃদয়ে দহনের তীব্র যন্ত্রণা জীবদ্দশাতেই মানুষ অনুভব করবে। পরলোকের শাস্তি তো ভবিষ্যতের জন্য রইলই।
এসএ/