ঢাকা, মঙ্গলবার   ২২ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’

সে বজ্রকণ্ঠ এখনো নীল হয়ে যায়নি!

এ কে আব্দুল মোমেন

প্রকাশিত : ১৩:১৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১০:০৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

Ekushey Television Ltd.

ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি যে আমাদের এই সুন্দর বিশ্বজগত ধ্বংস হবার আগে খানে দরজ্জালের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন হারুত ও মারুত বিশ্বাসীদের ধ্বংস করে ফেলবে। বিশ্বজগতের কোথাও তখন কোরআনের একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না- তারা সব ধ্বংস করে ফেলবে।

ধর্মগ্রন্থের বাণী সাধারণত এলিগরিকেল হয়- আসল কথা আকার ইঙ্গিতে বুঝানো হয়। এর জন্যেই বুঝি ক্ষেত্র বিশেষে তফসীরের প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশে খালেদা-নিজামী সরকার কি কোরআনের ‘খানে দরজ্জাল’ রাজত্বের এক সাক্ষাৎ উদাহরণ? খানে দরজ্জালের রাজত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে- যে আল্লাহপাকে বিশ্বাস করবে, যে সত্য-সুন্দরে বিশ্বাস করবে, যে সঠিক কথা বলবে, সত্য কথা বলবে তাকে সাথে সাথেই খানে দরজ্জালের সৈন্যসামন্তরা কাতেল বা হত্যা করবে। কোরআনের বাণী সত্য- সুতরাং তারা তা ছিড়ে ফেলবে এবং এর স্থলে মিথ্যা পুস্তক, মিথ্যা তথ্য প্রচার করবে।

তারা ক্ষমতাশালী হবে এবং এক হাতে চন্দ্র, অন্য হাতে সূর্য- এ ধরনের বাহানা এনে জনগণকে, বিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত করবে। বর্তমান খালেদা-নিজামী সরকারের অবস্থান দেখলে তাই মনে হয়। তারা যারা সত্যে বিশ্বাস করে তাদেরকে কাতেল করার ষড়যন্ত্রে রয়েছে এবং সত্য পুস্তক, সত্য তথ্য ধ্বংস করে তার স্থলে মিথ্যা তথ্য ও মিথ্যা পুরস্তক উপহার দিচ্ছে। এর প্রধান উদাহরণ হচ্ছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস’ বিকৃতি। স্বাধীনতার সত্য তথ্য ধ্বংস করে তার স্থলে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের সংযোজনে খালেদা-নিজামী সরকার আধাজল খেয়ে লেগেছে।

স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ নায়ক, বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পুরুষ যার প্রজ্ঞা, নেতৃত্ব, সাহস, বলিষ্ঠতা ও ত্যাগের বিনিময়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা’ সম্ভব হয়েছে তাকে খাটো করার এবং তাঁর অবদানে কালিমা লেপনে বর্তমান খালেদা-নিজামী সরকার বদ্ধপরিকর। এ উদ্দেশে তারা বানোয়াট তথ্য তৈরি করেছে। তারা বলছে খারেদা জিয়ার প্রযাত স্বামী মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউর রহমান নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। তিনিই নাকি ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন সর্ব প্রথম ২৫শে মার্চের দিনগত রাতে। মিথ্যার বেসাতি আর কাকে বলে?

জিয়া সাহেব ২৫শে মার্চের রাতে ঘোষণা দিয়েছেন বলে তাদের দাবি, তাহলে আমি কী অপরাধ করলাম? আমি তো ১লা মার্চে যখন দুপুর বেলার
সংবাদে শুনতে পেলাম যে পাকিস্তানের সামরিক প্রধান প্রেসিডেন্ট এহিয়া খান ঘোষণা দিয়েছেন যে, সংসদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হলো- আমরা তো তখন সাথে সাথেই রাস্তায় নেমে পড়ি এবং জোর গলায় আওয়াজ তুলি স্বাধীন বাংলাদেশের। জিয়া সাহেবের আগেই আমার মতো আরো অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ঐদিন পূর্বানী হোটেলে আমরা যারা উপস্থিত হই সবাই তো স্বাধীনতার ডাক দেন।

জিয়া সাহেব তো ২৫ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন, আমি তো তার আগেই চাকরি ছেড়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি। ২২শে মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে ১৯শে জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চাকরি থেকে পালিয়ে বেড়াই। ১৯শে মার্চ ১৯৭২ সালে ভারতের গৌহাটি থেকে চাকরিতে যোগদানের টেলিগ্রাম পাঠাই। কথা হচ্ছে আমার মতো অনেক অনেক তরুণ, যুবক, অনেক অনেক প্রবীণ নেতৃত্ব ১লা মার্চের পর থেকে “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা” দেন। তবে যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার আইনসম্মত কোনো অধিকার আমাদের ছিল না, আমি নির্বাচিত সাংসদ ছিলাম নাম, বা বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নির্বাচিত নেতা ছিলাম না, সে জন্যে আমাদের ঘোষণা আইনসঙ্গত নয়- নিরর্থক।

বস্তুত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দেয়ার একমাত্র আইনসঙ্গত অধিকার ছিল শুধু একজনেরই এবং তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা, সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশি জনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০টি সংসদ সিটের মধ্যে ২৯৭টিতে জয়লাভ করে।

আমার মনে পড়ে ৩রা মার্চে তৎকালীন বাংলাদেশের সত্যিকার রাষ্ট্রনায়ক যার আদেশে চাকা চলে, গাড়ি ঘোড়া চলে, ব্যাংক চলে, অপিস-আদালত চলে, যার আদেশে লোকজন অফিসে যায়, সেই মহাপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর রোডে যখন উপস্থিত হই তখন অকেনেরই হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত (স্বাধীনতার পর তা পরিবর্তিত হয়) লাল-সবুজ পতাকা এবং অনেকেই তখন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ স্লোগান দিচ্ছিলেন তার সাথে আমরাও সামিল হই। মেজর জিয়া ৩ তারিখ নয়, ২৬ তারিখ রাতে স্বাধীনতার সংগ্রামে শরীক হন। আমাদের অনেক পরে।

৭ই মার্চের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে একটি সমাবেশ হয় এবং তাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দুপুর থেকেই আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্সের বক্তৃতা শোনার জন্যে জমায়েত হই তখন উপরে বার বার সামরিক হেলিকপ্টার ও বিমান চলে এবং আমরা তখন স্থির নিশ্চিত যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেবেন। আমাদের আশা কিন্তু তিনি পূরণ করেন। তার অপূর্ব বলিষ্ঠ ভাষণের প্রতিটি শব্দ আমাদের হৃদয় পুলকিত করে, রক্ত-গরম করে, স্বাধীনতার দৃঢ় প্রত্যয়ে আমরা উজ্জীবিত হই। 

তিনি অর্বাচীনের মতো বলেননি ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম’। তার পরিবর্তে তিনি বলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু তাই বলে তিনি খ্যান্ত হননি। তিনি আরো বলেন, “... আপনারা জানেন ও বুঝেন ... মনে রাখবা আমি যদি তোমাদের হুকুম দিতে না পারি তোমাদের যা যা আছে তাই দিয়েই শত্রুর মোকাবিলা কর। ... ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।” 

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আইনের মারপেচে হুবহু না দিলেও ‘আখলবন্ধ’ স্বাধীনচেতা সংগ্রামী বাঙালিদের কীভাবে কি করতে হবে তার নির্দেশনা দিয়ে যান। “আমি যদি হুকুম দেয়ায় না পারি ...।” বক্তব্যের মধ্যে তিনি জাতিকে সজাগ করে দেন যে, তাকে যদি পাকবাহিনী হত্যা করে বা কারারুদ্ধ করে তখন আমাদের কী করতে হবে। “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ... যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে ... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ... ”। 

আনুষ্ঠানিকভাবে একে “স্বাধীনতার ঘোষণা” না বললেও তাঁর ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে কী কী করা প্রয়োজন তার সব ইঙ্গিত ও নির্দেশনা
এতে রয়েছে। সুতরাং যারা আজ খানে দরজ্জালের মতো এই সত্য বাণীকে, এই সত্য উপলব্ধিকে ঘোলাজলে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন তাদের জাতি কি কখনো ক্ষমা করবে?

১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিলে আমি যখন আমাদের সিলেটের বাসার সামনে পাক-সেনানীর কড়া হুকুম ‘যার বাসার সামনে বেরিকেড তৈরি হবে সে
বাড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হবে’ তা উপেক্ষা করে ব্যারিকেড তৈরি করি তখন জিয়া সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, না হান্নান সাহেব দিয়েছেন, না যদুমধু দিয়েছেন, তা আমাদের মোটেই ধতর্ব্য ছিল না। কেউ না দিলেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতাম। কারণ ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্পষ্টত নির্দেশনা দিয়ে গেছেন- “যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।” 

সিলেট শহরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় আমাদের বাড়ি থেকে ৪ঠা এপ্রিলে, ওই দিন বিকেলে বাড়ি থেকে পাকহানাদার বাহিনীর ওপর গুলি চালালে তারা
আমাদের বাড়িটি মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। তখন আমাদের সাথে উপস্থিত ছিলেন ই-পি-আর বাহিনীর ডজন খানেক বাঙালি বীর সন্তান। এর আগের দিনে তাদের যখন বলা হয় যে, তারা তাদের হাতিয়ার জমা দিতে তখন তারা ই-পি-আর এর ছাউনি থেকে পালিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়- তাদের কেউই তখন জানে না ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ কেউ দিয়েছে কিনা- তবে তারা জানে স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এর পেছনে যার নেতৃত্ব সর্বোচ্চে তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

বঙ্গবন্ধু প্রগাঢ় রাজনৈতিক ধীশক্তি ও প্রজ্ঞা থাকায় তিনি তার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বক্তৃতায় এক অপূর্ব সম্মিলনী সৃষ্টি করেছেন। এই ভাষণের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতাকামী সকল বাঙালি বঙ্গবন্ধুর উপর নির্যাতন হলে বা তাকে বন্দি করলে সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। তবে সরকার যদি তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসাবে চিত্রিত করে ফাঁসি দেয়ার পাঁয়তারা করে তাহলে এ বক্তৃতা তাদের হতাশ করবে। যে সমস্ত বাংলাদেশি যারা পাকিস্তানের স্বপক্ষে ছিলেন তাদের কাছে এ বক্তৃতা “স্বাধীনতার ইঙ্গিত” নয়- তারা তাদের তালে এর তফসীর করে।

১৯৭১ সাল। ২২শে মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, মোল্লা জালাল উদ্দিন, নারায়ণগঞ্জের
গোলাম সারওয়ার প্রমুখ ইমার্জেনসিতে আসেন আহত কর্মীদের দেখতে। মেডিকেল হাসপাতালের বারান্দায় তার সাথে দেখা, জিজ্ঞেস করলাম
কিসের জন্য এসেছেন। বললেন, ‘আহত কর্মীদের দেখতে এসেছেন’। 

তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমানোর জন্যে ‘গোল টেবিল’ বৈঠকের আয়োজন করেন এবং বঙ্গবন্ধু তাতে যোগদান করেন। ছাত্র-জনতার প্রবল দাবির প্রেক্ষিতে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। আমি তখন রাওয়ালপিন্ডিতে ইসলামাবাদ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমরা মাত্র ৬ জন বাংলাদেশি ছাত্র তখন ওখানে। এদের মধ্যে সহপাঠী ড. ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ (পরবর্তিতে কেয়ারটেকার সরকারের উপদেষ্টা), আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (এরশাদের পররাষ্টমন্ত্রী), ড. মাহদুল আলম (বি-আই-ডি-এস) ও এহতেশাম চৌধুরী (শিল্পপতি)। তাছাড়া ছিলেন অংক বিভাগে চাটগাঁর ড. মাসুম ও পদার্থবিদ্যা বিভাগে সিলেটের বদরুজ্জামান। 

বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত সংবর্ধনা দেয়ার জন্যে আমি একটি ব্যানার তৈরি করি এবং তাতে লিখি “স্বাগতম বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান।” এখানে বলা
অসঙ্গত হবে না যে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করার আগে আমি শেখ মুজিব বা তার দল সম্পর্কে পুওর অপিনিয়ন পোষণ করতাম। তবে পাকিস্তানে যাওয়ার পর পাকিস্তানিদের ব্যবহারে আমাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন আমাদের “একমাত্র শক্তি, একমাত্র সাহস”। 

বঙ্গবন্ধুর শত্রুর সংখ্যা তখন পাকিস্তানে অনেক। তাই তার নিরাপত্তার জন্যে তাকে কারগো দিয়ে বের করে নেয়া হয় এবং প্লেনের সদর দরজা দিয়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী বের হন। হাজার হাজার অভ্যাগতরা তাকেই বঙ্গবন্ধু মনে করে স্বাগত জানায়। রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে রাওয়ালপিন্ডির “ইস্ট পাকিস্তান হাউসে” দেখা করি তখন রাওয়ালপিন্ডিতে ঘটা করে ২১শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান করছিলাম এবং এতে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি হতে অনুরোধ করলে তিনি তাৎক্ষণিক রাজি হন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্থানীয় টিভিতে একুশের অনুষ্ঠানের একটি অ্যাড দিতে বাধা প্রাপ্ত হলে অনেকের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হই। 

খাজা শাহাবুদ্দিন তখন তথ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুকে ঘটনাটি বললে তিনি তাৎক্ষণিক খাজা শাহাবুদ্দিনকে ফোন লাগাতে বলেন। পরের দিন সকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম খাজা সাহেবের সাথে আলাপ করলে আমাদের একুশের অ্যাডটি দেয়ার অনুমতি মিলে। রাওয়ালপিণ্ডির গোল টেবিল চলাকালে বঙ্গবন্ধু ও তার দলের সার্বক্ষণিক সহকারী হিসাবে উপস্থিত থাকায় তাজউদ্দিন সাহেবের সাথেও পরিচয় ঘটে ঘনিষ্ঠভাবে। বঙ্গবন্ধুর উদারতা ও বাঙালি প্রেম আমাকে মুগ্ধ করে।

তাজউদ্দিন সাহেব জানালেন যে, এহিয়া-মুজিব আলোচনা খুব উত্তম নয়। তার কথার ইঙ্গিতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, অবস্থা খারাপ হতে পারে তিনি বিশেষ করে বাচ্চাদের ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে উপদেশ দিলেন। সুতরাং পরের দিন ২৩শে মার্চ বড়বোনের বাচ্চাদের নিয়ে সিলেটে পাড়ি দেই এই আশায় যে ঢাকায় যদি আন্দোলন চলে, সিলেটে হয়তো তা কম হবে। তাছাড়া আমার বস ছিলেন তখন এক উর্দুভাষী পাঞ্জাবি- ১লা মার্চের পর থেকেই কাজে ঠিকমতো যাচ্ছি না তার জন্যে তিনি অসন্তুষ্ট ও সন্দেহের চোখে দেখছেন। মূলত ১লা মার্চের পর থেকে অফিস আদালত বাদ দিয়ে আমি তখন সার্বক্ষণিকভাবে সভা-শোভাযাত্রা নিয়েই মহাব্যস্ত।

২৫শে মার্চের বিভীষিকাময় ঢাকার হত্যাযজ্ঞ আমি দেখিনি। তবে পরের দিন সিলেট থম থমে ভাব- ঢাকার খবরাখবর নেয়ার জন্যে আমরা হন্তদন্ত হয়ে অস্থিরতা করছি। ২৭শে মার্চ খবর পেলাম যে বঙ্গবন্ধু পাকসেনার হাতে বন্দী হবার আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং ২৮শে মার্চ সর্ব প্রথম রেডিওতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে শুনতে পেলাম “আমি জিয়া বলছি- আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে ... ”।

আমরা তাতে আনন্দিত হলাম যে, বাঙালি জোয়ানরাও আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছেন। আমি কিন্তু জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছি ২৮শে মার্চে। পরিবর্তিতে আমার বন্ধু তৎকালীন সময়ে চাটগাঁ রেডিও স্টেশনে কর্মরত আব্দুল্লাহ আল-ফারুক এবং স্বয়ং মেজর জিয়া সাহেবের মুখে শুনেছি যে, তিনি ২৭ তারিখে সর্ব প্রথম চাটগাঁ বেতারে ঘোষণাটি দেন। যুদ্ধের সময়ে ও বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তারপর তিনি ডেপুটি চীফ অব স্টাফ এবং পরে ডি-সি-এম-এল-এ থাকাবস্থায় প্রয়াত মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে অনেক- তিনি স্বল্পভাষী ছিলেন, তবে তিনি কখনো নিজে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ ছিলেন তখন তিনি আমার তৎকালীন বস বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেবের কাছে অনেকবারই এসেছেন। তার বিশেষ অনুরোধে আর্মির জন্যে অতিরিক্ত টিভি সেট, রিফ্রেজারেটার, ব্যাটারী ইত্যাদি প্রদানের ব্যবস্থা আমরা করেছি। তাছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে যেহেতু দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেব সিলেট এলাকায় আঞ্চলিক বেসামরিক প্রধান ছিলেন তার ফলে জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

জিয়াউর রহমান জীবিত থাকলে খালেদা-নিজামী সরকারের মিথ্যাচারের তিনিও মর্মাহত হতেন। তাদের মিথ্যাচারে মরহুম জিয়াউর রহমানের আত্মাকে নিশ্চয়ই শাস্তি দিচ্ছে। 

মেজর জিয়াউর রহমানের একটি লেখা যা অধুনালুপ্ত “সাপ্তাহিক বিচিত্রায়” ১৯৭৪ সালের ২৬শে মার্চ প্রকাশিত হয় তাতে তিনি নিজেই কীভাবে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন তা সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করেন। তার একান্ত সচিব কর্নেল (অব.) অলিও কীভাবে তারা
মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন তা সবিস্তারে লিখেছেন। তাদের কারো বক্তব্যে মেজর জিয়া ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে কোনো স্বীকার উক্তি নেই।

বরং কর্নেল (অব.) অলি লেখেন “মেজর জিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৭শে মার্চ বিকেল বেলা দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বিএনপি নেতা মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীও অনুরূপ বক্তব্য রাখেন। মেজর জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার জেড ফোর্স সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হয়েছে। তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা- কাদের সিদ্দিকী, মীর শওকত আলী, কর্নেল অলি, কর্নেল জাফর ইমাম, জেনারেল সফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন খন্দকার, জেনারেল জি আর দত্ত, জেনারেল আব্দুর রব, সর্বোপরি জেনারেল এমএজে ওসমানী- তারা প্রত্যেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাই বলে “স্বাধীনতার জনক বা ঘোষক নয়”। 

স্বাধীনতার জনক একজনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার সাড়ে সাতকোটি জনতা একজনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপ দেয়। তিনি হচ্ছেন বাংলার গৌরব। বাংলার শ্রেষ্ঠ পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৫ই আগস্ট ২০০৪, নিউইয়র্ক

(লেখাটি একে আব্দুল মোমেনের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি