ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

সোলস’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুব্রত বড়ুয়া রনি আর নেই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৩২, ২৬ মে ২০২১

সুব্রত বড়ুয়া রনি

সুব্রত বড়ুয়া রনি

দেশের খ্যাতনামা ব্যান্ড সোলস-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও খ্যাতিমান ড্রামার সুব্রত বড়ুয়া রনি আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারের সাথে লড়াই করে আজ বুধবার ভোর ৫টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

প্রায় দেড় বছর ধরে ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন সোলসের এই খ্যাতিমান ড্রামার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন ‘সোলস’-এর সারথি পার্থ বড়ুয়া।

সুব্রত বড়ুয়া রনি সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন গত পাঁচ দশক ধরে। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের কয়েকজন গান অন্ত-প্রাণ তরুণ সাজিদ, জিলু, নেওয়াজ, সুব্রত বড়ুয়া রনি ও তাজুল মিলে ‘সুরেলা’ নামে একটি গানের দল গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে সেই ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সোলস’।

দীর্ঘ-যাত্রায় সোলস ব্যান্ড ও সুব্রত বড়ুয়া রনির সঙ্গী ছিলেন নকীব খান, পিলু খান, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান, কুমার বিশ্বজিৎ ও আইয়ুব বাচ্চু। আর এখন আছেন পার্থ বড়ুয়া।

সোলস (Souls) মূলত দেশের একটি জনপ্রিয় পপ মিউজিক ব্যান্ড। এটি চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঢাকায় চলে আসে। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যান্ডটি বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছে শ্রোতাদের।

পথচলা
স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর, ১৯৭২ সাল। দেশ তখন সবদিক দিয়েই অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতেও অচলাবস্থা। সে সময় চট্টগ্রামের কয়েকজন গানপাগল তরুণ সাজিদ, জিলু, নেওয়াজ, রনি বড়ুয়া ও তাজুল মিলে গানের দল গঠন করে যাবতীয় অচলাবস্থাকে পাশ কাটাতে চাইলেন। তখনকার সনাতনীয় প্রথাগত মিউজিকের বাইরে গিয়ে বিদেশী ব্যান্ডগুলোর অনুপ্রেরণায় ‘ওয়েস্টার্ন রক’ চর্চার এবং রক-মিউজিকের সাথে দেশের তরুণদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার তাগিদ থেকেই তারা অগ্রসর হন।

স্বাভাবিকভাবে তাদের এই কাজে অগ্রসর হওয়া সহজসাধ্য ছিলো না। বাংলা গান তখন সীমাবদ্ধ ছিলো শাস্ত্রীয়-ফোক, রবীন্দ্র-নজরুল, বাউল-লোকগান-আধুনিক মেলোডিয়াস গানের মধ্যে। শুধুমাত্র মনোবলকে পুঁজি করে নতুন কিছু করার স্পৃহা থেকেই চট্টগ্রামে ১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে ‘সুরেলা’ নামে তারা ব্যান্ডযাত্রা শুরু করেন। তখনকার দিনে বড় বড় ক্লাব-হোটেলে ছাড়া কোথাও গানবাজনা হতো না। আর সেইসব জায়গাতে শুধুমাত্র ইংরেজি গানের কাভার করা হতো, বাংলা গান ছিলো ব্রাত্য। তাই ব্যান্ডগুলোর নামও ইংরেজিতে রাখার চল শুরু হয়েছিলো। এসবকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৭৩ সালে ব্যান্ডের নাম পাল্টে ‘সোলস’ রাখা হলো, বাংলার যার অর্থ হয় ‘আত্মার সমন্বয়ে’।

১৯৭২ সালের শেষদিকে লুলু ব্যান্ড ত্যাগ করায় নকীব খান এই ব্যান্ডে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর নকীবের ছোটো ভাই পিলু খানও যোগ দেন সোলসে। কিছুদিন পর তপন চৌধুরী সোলসে নাম লেখান। তখনও সোলসের তৎপরতা শুধুমাত্র চট্টগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। প্রথম প্রথম শুধু ইংরেজি গান কাভার করলেও তারা একটা সময় নিজেদের গান করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম গানটি কম্পোজ করেছিলেন নকীব খান নিজেই।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে পপ মিউজিকের একটি প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় ‘সোলস’, জিতেও নিয়েছিলো সেরার পুরস্কার। মূলত সেই থেকেই শুরু হয়েছিলো সোলসের জয়যাত্রা। ১৯৭৭ সালে ব্যান্ডটিতে যোগ দিলেন নাসিম আলী খান। কুমার বিশ্বজিৎ এবং গিটারম্যান আইয়ুব বাচ্চু সেসময় ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে ছিলেন। ১৯৮২ সালে সোলসে যোগ দেন এবি। আইয়ুব বাচ্চুকে ব্যান্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পিলু খান। এবি শুরুতে ছিলেন একাধারে গিটারিস্ট-ভোকালিস্ট-লিরিসিস্ট-কম্পোজার। আশির দশককে সোলসের স্বর্ণযুগ বলা হয়, কারণ সে সময়ে তাদের ব্যান্ড লাইনআপ ছিলো দুর্দান্ত।

নকীব খান, পিলু খান, তপন চৌধুরী, নাসিম আলী খান, আইয়ুব বাচ্চু, রনি বড়ুয়া, নেওয়াজ, সাজেদ। নামগুলো পড়লেই তাদের সে সময়ের লাইনআপ সম্পর্কে বুঝতে পারার কথা। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বেইজিস্ট তানিমও কিছুকাল সোলসে বাজিয়েছেন।

সোল্‌স-এর বর্তমান লাইন-আপ হলোঃ
নাসিম আলী খান (কণ্ঠ)
পার্থ বড়ুয়া (লিড গিটার ও কণ্ঠ)
এস.কে আহসানুর রহমান আশিক (ড্রামস্)
জাকের হাসান রানা (বেজ গিটার)
তুষার রঞ্জন দত্ত (পারকিউশন)
মীর শাহরিয়ার হোসেন মাসুম (কিবোর্ড)

অ্যালবাম
১৯৮০ সালে বের হয় সোলসের ১ম এ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। এটিই ছিলো বাংলাদেশের কোনও ব্যান্ডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম, প্রথম রক অ্যালবাম। সেই অ্যালবামের ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবন’ গানগুলো অল-টাইম হিটস।

সোলসের ২য় এ্যালবাম ‘কলেজের করিডোরে’ বের হয় ১৯৮২ সালে। এ্যালবামের ‘কলেজের করিডোরে’, ‘ফরেস্ট হিলের এক দুপুরে’, ‘ফুটবল ফুটবল’ গানগুলো তখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো বলে জানা যায়। এই এ্যালবাম করার পরেই নকীব খান ও পিলু খান ব্যান্ড ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে ‘রেনেসাঁ’ গঠন করেন।

১৯৮৭ সালে ‘মানুষ মাটির কাছাকাছি’ নামে ব্যান্ডের ৩য় এ্যালবাম বের হয়। এই এ্যালবামেই আইয়ুব বাচ্চু প্রথম কোনও গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। গানের শিরোনাম ছিলো ‘হারানো বিকেলের গল্প বলি’।

‘ইষ্ট এন্ড ওয়েস্ট’ নামে সোলস তাদের ৪র্থ এ্যালবাম বের করে ১৯৮৮ সালে। ৬টি বাংলা গানের পাশাপাশি ৬টি ইংরেজি গানও ছিলো এই এ্যালবামে। সেই বছরেই আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে সোলসে আগমণ ঘটে পার্থ বড়ুয়ার, যিনি এখনও সোলসের ভোকালিস্ট হিসেবে আছেন। সোলসে আসার আগে পার্থ বড়ুয়া ছিলেন ‘ম্যাসেজ’ ব্যান্ডের কিবোর্ডিস্ট। পার্থ গিটার শিখেছেন এবির কাছেই। ১৯৮৯ সালে আইয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড ত্যাগ করে আরেকটা নতুন ব্যান্ড ‘এলআরবি’ গঠন করেন।

কিছুদিন বিরতির পর ১৯৯২ সালে ব্যান্ডের ২০ বছর পূর্তিতে বের হয় তাদের ৫ম স্টুডিও এ্যালবাম ‘এ এমন পরিচয়’। বিগত কয়েক বছর ধরে তপন চৌধুরী একক গান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তারা খানিকটা অনিয়মত হয়ে পড়েছিলো। এটা ছিলো তপন চৌধুরীর সাথে সোলসের শেষ এ্যালবাম। এরপর তপন চৌধুরী পুরোপুরিভাবে সলো ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

১৯৯৫ সালে সোলস বের করে তাদের ৬ষ্ঠ এ্যালবাম- ‘আজ দিন কাটুক গানে’। এই এ্যালবামের ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’ গানটি সোলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান বলা যায়। এই এ্যালবাম দিয়ে পার্থ শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিলো।

১৯৯৭ সালে সোলসের ৭ম এ্যালবাম ‘অসময়ের গান’ রিলিজ হয়েছিলো। এ্যালবামের ‘আইওনা আইওনা’ গানটি সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো।

একুস্টিক ভার্শনে তাদের আগের কিছু গান, কিছু নতুন গান আর জনপ্রিয় কয়েকটা গানের কাভার মিলে ২০০০ সালে বের হয় সোলসের ৮ম এ্যালবাম ‘মুখরিত জীবন’। এ্যালবামের টাইটেল গানটা এখনও বেশ জনপ্রিয়। টিভি লাইভে এই গানটার অনুরোধ তাদেরকে সবচেয়ে বেশি করতে হয়।

২০০২ সালে বের হয় তাদের নবম এ্যালবাম ‘তারার উঠোনে’। দশম এ্যালবাম ‘টু-লেট’ রিলিজ হয় ২০০৫ সালে। তাদের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার মবিন-এর মৃত্যুর পূর্বের শেষ কাজ এই এ্যালবামটি। ২০০৬ সালে বের হয় তাদের ১১তম এ্যালবাম ‘ঝুট ঝামেলা’।

সোলসের ১২তম এবং সর্বশেষ এ্যালবাম ‘জ্যাম’ বের হয় ২০১২ সালে। এখানে নির্মলেন্দু গুণ নামে একটা গান জনপ্রিয় হয়। তাছাড়া জ্যাম টাইটেল ট্র্যাকটি বাস্তব ইস্যু হওয়াতে খুব আলোচিত হয়।

জনপ্রিয় গান
কেন এই নিঃসঙ্গতা
আজ দিন কাটুক গানে
বাঁশি শুনে আর কাজ নেই
আমি আর ভাবনা
ব্যস্ততা আমাকে দেয় না
মন শুধু মন ছুঁয়েছে
কলেজের করিডোরে
তুমি রোজ বিকেলে
সাগরের ওই প্রান্তরে
ভালবাসি ওই সবুজ মেলা

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি