ঢাকা, শুক্রবার   ১৪ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

রোহিঙ্গা সংকট

‘স্থায়ী সমাধানে ‍আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:১৯, ১৩ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:১৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন

Ekushey Television Ltd.

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞ আজও বন্ধ হয়নি। নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে এখনও নৌকায়-ভেলায় করে নাফ নদী হয়ে দলবেঁধে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে শত শত রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন উদ্বাস্তু-শরনার্থী প্রবাহ ঠেকাতে তৎপর তখন বাংলাদেশ বিপদগ্রস্ত এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু আশ্রয়ই নয়; তাদের খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরণের সহায়তা দিয়ে আসছে।

লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের কক্সবাজারের লোকজন নিরাপত্তাসহ নানামুখী ঝুঁকিতে আছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ শুরু থেকেই বলে আসছে। এ সংকট সমাধানে দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা আলাপ-আলোচনা ও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানকল্পে ‍আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ‍অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। সম্প্রতি ইটিভি অনলাইনকে দেওয়া ‍একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি ‍একথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইটিভি অনলাইনের প্রতিবেদক তবিবুর রহমান

পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি ইটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

ইটিভি অনলাইন : রোহিঙ্গা সংকটের শুরুটা কোথা থেকে?

ড. দেলোয়ার : মূলত ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতার রাষ্ট্র হিসেবে কাজ শুরু করে। তখন রাষ্ট্রর সব মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে একটি জাতীয় সংবিধান তৈরি করেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের অধিকার দেওয়া হয়। এমনকি রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। এখানে আমরা একটা সুসর্ম্পক লক্ষ্য করি।

কিন্তু হঠাৎ করে দেশটিতে সামরিক শাসন চালু হয়। এরপর ১৯৮২ সালের আইনে “রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়। এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এর পর থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ওপর দমন পীড়ন। সেময় থেকেই মূলত রোহিঙ্গা সংকট তৈরি হয়।

ইটিভি অনলাইন: রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি বলে আপনি মনে করেন ?

ড. দেলোয়ার: নিরাপত্তা বিষয়টি আপেক্ষিক। আমরা যদি সাময়িক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। তাহলে এটা এক ধরনের বিষয়। রোহিঙ্গা শুধু কেন, যেকোনো ধরনের শরণার্থী একটি দেশের ভেতরে থাকলে তা দেশের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি বা ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো আইনগত বিধান নেই। যে রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশেই রাখতে হবে। মানবতার দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এটা দীর্ঘদিন থাকলে দেশ হুমকির মুখে পড়বে।

প্রথম ঝুঁকি পরিবেশগত। দেশের কোনো স্থানে শরনার্থী শিবির স্থাপন করা হলে সেখানকার স্থানীয় পরিবেশের উপর ঝুঁকি তৈরি করে। স্থানীয় অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি করে। কর্মসংস্থানের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা যা আগে থেকে লক্ষ্য করেছি। এখনও করছি। এছাড়া পর্যটন ও বনায়নের দিক থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এসব স্থানে স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সুযোগ দিলে বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুকিও সৃষ্টি হবে।

ইটিভি অনলাইন : রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতায় কোনো ঘাটতি ছিলো  বলে মনে করেন কি?

ড.দেলোয়ার: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল প্রশংসার দাবিদার। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের শেষ বৈঠকে আমরা দেখলাম, ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩টি রাষ্ট্র শক্তভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলেছে। বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশংসা করেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের ভূমিকা অসাধারণ। জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে জাতিগত নিধন চালানো হচ্ছে। এমনকি গণহত্যা করছে মিয়ানমার এমন কথাও বলছে জাতিসংঘ।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সহজ হতো যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকত। নেতৃত্ব না থাকাটা বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলছে। এখনও নয়টি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। তাদের কাছে আমরা কী বা আশা করতে পারি। গত পাঁচ বছরে ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিরাজমান। রোহিঙ্গা সংকটেও তার প্রভাব রয়েছে। আবার ভারত ও চীনের যেসব প্রকল্প আছে, সেগুলোর স্নায়ুকেন্দ্র হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এসব প্রকল্প শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন ও রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় সমাধান চায়। স্থায়ীভাবে সমাধান করতে হলে কফি আনানের সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে।

 ইটিভি অনলাইন: ১০লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা দীর্ঘদিন বহন করা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ নয় কি?

ড.দেলোয়ার হোসেন: রোহিঙ্গা সংকট অনেক দিন যাবৎ চলবে। এখন শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার জন্য ত্রাণ কূটনীতির ব্যর্থ বলবো না। তবে রাজনৈতিক তৎপরতা জোর দিতে হবে। মিয়ানমার যদি বলেও আমরা তাদের নিয়ে যাব, তারপরও অনেক সময় লাগবে। আমাদের একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন: চীন রাশিয়ার মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বনের বিরোধিতার কারণ কি?

ড. দেলোয়ার: চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অনেক বিনিয়োগ করেছে। এসব প্রকল্প শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন ও রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় সমাধান চায়। এ কারণে চীন রাশিয়া চায় না মিয়ানমারে কোনো প্রকার অস্থিরতা তৈরি হয়। এ কারণে চীন রাশিয়া বিরোধিতার মূল কারণ।

ইটিভি অনলাইন : আন্তর্জাতিক চাপে সঙ্কটের সমাধান কতটা মিলবে বলে আপনি মনে করেন?

ড.দেলোয়ার: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ যে চাপ সৃষ্টি করছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটা যেন কোনোভাবেই মানুষের চোখের আড়ালে চলে না যায়। ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে আশা করা যায় এ সংকটের কিছুটা হলেও সমাধান মিলবে। এরইমধ্যে আমরা কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি এর মাধ্যমে আশা করা যায় আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব।

ইটিভি অনলাইন: রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের একটি সাম্পদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করছে

ড. দেলোয়ার : শুধু রোহিঙ্গা ইস্যু নয়। দেশে এক শ্রেণীর মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করে থাকে। বিভিন্ন সময় তাো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। একারণে সমাজের মানুষকে সচেতন হবে হবে। এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে।

ইটিভি অনলাইন: সব রোহিঙ্গাকে কি তাদের নিজ দেশে ফেরানো সম্ভব হবে?

ড. দেলোয়ার : সব রোহিঙ্গা তাদের দেশে ফেরানো কঠিন হবে। কারণ এর আগে যেসব রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে এসেছিল তারা এখনও ফিরে যায়নি। এ কারণে আমাদের আরও অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ইটিভি অনলাইন : চীন রাশিয়া বাদে বিশ্বের প্রায় সব দেশ চায় রোহিঙ্গারা তাদের নিজের দেশে ফিরে যাক, কিন্তু মিয়ানমারের তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাহলে মিয়ানমারের শক্তি জায়গাটা কোনটা ?

ড. দেলোয়ার: চীন ও রাশিয়ার মিয়ানমারে অনেক অর্থনৈতিক ব্যাণিজ্য আছে। এমনকি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে। যে কারণে চীন ও রাশিয়া চায় না মিয়ানমারে কোনো প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি হোক। আর মিয়ানমারের মূল শক্তির বিষয় বলতে গেলে দেশটি ৫৫ বছর সময়িক শাসনে ছিলো। যে কারণে তাদের কিছুটা হলেও শক্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। এছাড়া অন্য কিছু না।

ইটিভি অনলাইন: আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

ড. দেলোয়ার: আপনাকেও ধন্যবাদ। ইটিভি অনলাইনের প্রতি রইল শুভ কামনা। 

‘‘অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ১৯৬৮ সালে। পড়াশোনা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ১৯৮৩ সালে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ১৯৮৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৯৫ সালে।

ড. দেলোয়ার একই বিষয়ে দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর করেন ২০০১ সালে, জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের বৃত্তি নিয়ে। আর মনবুশো বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করেন জাপানেরই ফেরিস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৭ সালে। তার গবেষণার বিষয় ছিল বিশ্বায়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যাপনার পাশাপাশি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ইউজিসি প্রদত্ত শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) পরিচালক। ‘’

 

/এআর /

 

   


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি