ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: স্বাধীনতার অমর বাণী শোনালেন শেখ মুজিব

ড. অখিল পোদ্দার

প্রকাশিত : ০৮:৫৫, ৭ মার্চ ২০২৪ | আপডেট: ০৮:৫৩, ৮ মার্চ ২০২৪

১লা মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বীরবাঙালি। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের এমন আচরণকে বঙ্গবন্ধু গভীর চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন। ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের আহবান জানান শেখ মুজিবুর রহমান। একই সঙ্গে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান অর্থাৎ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, একটি মাইনোরিটি দল অর্থাৎ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির একগুয়েমির কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি হয়েছে। একে বিনা চ্যালেঞ্জে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। 

রেডিও টেলিভিশনে ইয়াহিয়ার অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা এ কান থেকে ও কানে পৌঁছাতেই ফুঁসে ওঠে সবাই। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। প্রতিবাদী জনতা হাতে লাঠি, লোহার রড নিয়ে মিছিল শুরু করে। ঐ প্রথম রাজপথে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার দাবিতে শ্লোগান ওঠে। মিছিলের ভাষা ছিল এমন-ইয়াহিয়ার ঘোষণা, বাঙালিরা মানে না। পাকিস্তানের পতাকা, জ্বালিয়ে দাও-পুড়িয়ে দাও। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। জিন্না মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুরের গোরস্থান। 

ঐ দিনের ঘটনা কাছ থেকে দেখেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমী। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে শহীদ জননী লিখেছেন, একটার সময় স্টেডিয়ামে ছিলাম। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা যে-ই না কানে যাওয়া অমনি কী যে শোরগোল লেগে গেলো চারদিকে। মাঠভর্তি চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার দর্শক সবাই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। ইউনিভার্সিটিতেও একই ঘটনা। রেডিওতে ঘোষণা শোনামাত্রই ছেলেরা সবাই দলে দলে ক্লাস থেকে, হল থেকে বেরিয়ে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করেছে। ছেলেরা পিলপিল করে আসছে চারদিক থেকে। মনে হলো সমূদ্রের একেকটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বটতলায়। ইয়াহিয়ার ঘোষণার এক ঘন্টার মধ্যে পঞ্চাশ-ষাট হাজার লোক বাঁশের লাঠি আর লোহার রড ঘাড়ে নিয়ে পূর্বাণীর সামনে সবগুলা রাস্তা জ্যাম করে ফেললো। সে কী শ্লোগান! পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ আর জিন্নাহর ছবিও পুড়িয়েছে।   

ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পর থেকেই ক্ষোভে বিক্ষোভে উন্মাতাল হয় পূর্ববাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পয়লা মার্চ দিনভর মিছিল মিটিং সমাবেশের পর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল তথা আজকের জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগ নেতারা বৈঠকে বসেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের কাঠামো ও রূপ নিয়ে সভায় কথা বলেন তাঁরা। নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, পরদিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় তাঁরা সভা করবেন। যেখানে পাঠ করা হবে স্বাধীনতার প্রস্তাব। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ অন্যরা। 

ওদিকে গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক আদেশ জারি করেন। তাতে দেশের অখÐতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে কোনো খবর বা ছবি প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। এমনকি আদেশের ব্যত্যয় ঘটলে সামরিক আইন ও বিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদÐ দেয়ার ঘোষণা দেয় ইয়াহিয়ার প্রশাসন।  
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সব ধরণের হুমকি চ্যালেঞ্জ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বটতলার ঐ আয়োজনের খবর পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। 

পয়লা মার্চের পর বিপ্লব বিদ্রোহে পূর্ববাংলা তখন উত্তাল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে গ্রামগঞ্জের মানুষ। ঢাকার রাজপথ ছাড়িয়ে আন্দোলন ক্রমশ চাঙা হতে থাকে মফস্বল শহরেও। ২ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব খানকে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত করেন ইয়াহিয়া সরকার। জারি হয় সামরিক আইন। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা অব্দি কারফিউ ঘোষণা হয়। অতপর কারফিউ ভেঙে আন্দোলন চলতে থাকে লাগাতার। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দুপুর ২ টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালায় পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশ। দুর্বার আন্দোলনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ পর্যন্ত দেশব্যাপী হরতাল পালনের ডাক দেন। এমনকি ৭ মার্চ পল্টন ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার ঘোষণাও দেন। সিদ্ধান্ত একে একে পৌঁছে যায় দেশের সবখানে। সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নামতে শুরু করে।  

১৯৭১ সালের মার্চের ৩ তারিখ। সরকারি, আধাসরকারি কিংবা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, উচ্চ আদালত এবং সচিবালয়ে হরতাল পালিত হয়। এমনকি সড়কপথের যানবাহন, রেল, বিমানসহ যোগাযোগের আর সব মাধ্যম বন্ধ থাকে। অফিসের নিয়ম ভেঙে চলে মিছিল-সমাবেশ। শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঐদিনের হরতালে অচল হয়ে যায়। দেশের বেশ কিছু স্থানে গুলি চালায় পাকিস্তানী দোসরেরা। ঢাকার রাজপথে শহীদ হন ২৩ জন। চট্টগ্রামে সর্বাধিক ৭৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। রংপুর এবং সিলেটে নতুন করে কারফিউ ঘোষণা করে ইয়াহিয়া সরকার। অগ্নিগর্ভ অবস্থার মধ্যেই পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। যাতে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দেয়া হয়। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও স্পষ্ট ছিল ঐ ঘোষণাপত্রে। মার্চের ৩ তারিখে হরতাল ও মিছিলে গুলি করে হত্যার পর দ্রোহের আগুন জ্বলছিল চট্ট্রগ্রামে। প্রচন্ড চাপে ঢাকা শহর থেকে কারফিউ তুলে নিতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকর্তা। কিন্তু অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১৩ নম্বর সামরিক আইন জারি হয়। ৪ মার্চের এ ঘটনা ছাপ ফেলে সারা দেশে। ততোক্ষণে বরেণ্য শিল্পী ও নন্দিত সাংবাদিকেরা চলমান আন্দোলনে সংহতি জানান। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলার মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি তোলেন।  পয়লা মার্চ থেকে লাগাতার আন্দোলন, দুর্বার মিছিল ও উত্তাল সমাবেশ সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে ৪ মার্চ পদত্যাগ করেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। যিনি এক দিন আগেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। 

ইয়াকুবের পলায়নবৃত্তি পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস জোগায়। আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। উত্তাল অবস্থার মধ্যে ৫ মার্চ গাজীপুর ও টঙ্গীতে গুলি চালায় পাকিস্তানী দোসরেরা। শহীদ হন ৪ জন। গুলিতে আহত হন ২৫ জনের অধিক।  একদিন আগে চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর চালানো গুলিতে যাঁরা আহত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আরও ক’জন মারা যান। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৮। রংপুর এবং রাজশাহীতে পুণরায় কারফিউ জারি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের শিক্ষকেরা চলমান আন্দোলনে যোগ দিয়ে খণ্ড খণ্ডভাবে দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হন।     

ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩রা মার্চ। সারাদেশে পাক বাহিনীর ধরপাকড়, গুলি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। আর এভাবেই দেশের শাসনক্ষমতা ক্রমশ শেখ মুজিবের হাতে চলে যাচ্ছিল। মুজিবের নির্দেশ ছাড়া আর কোনো আইন পালন হচ্ছিল না। কার্যত ইয়াহিয়া সরকার আস্তে আস্তে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। দেশের গরিব মেহনতি থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের বিচারপতি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকে সরকারি আদেশ হিসেবে মানতে শুরু করেন। 
এমনকি ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় যে ইশতেহার পাঠ করা হয় তাতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উদ্দেশ্য আবারও পরিষ্কার করে দেন শেখ মুজিব। যেখানে তিনি বলেন, ৫৬ হাজার ৫৭১ বর্গমাইল বিস্তৃত ভোগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম যে রাষ্ট্র হবে তার নাম বাংলাদেশ। 

মার্চের ৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব খান পদত্যাগ করলে ঢাকায় মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে জড়ো হন অবাঙালিরা। আলাদাভাবে তারা জনসভাও করেন। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে সংহতি জানান।  সব মিলিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এরই রেশ ধরে টঙ্গীতে গুলিতে নিহত হন ৪ জন। আহত হন ২৫ জন। চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া গোলাগুলির ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৮। দিগি¦দিক ইয়াহিয়া সরকার রংপুর ও রাজশাহীতে পুণরায় কারফিউ জারি করে। ততোদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মিলে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে নামেন।    
  
১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বত:স্ফুর্ত হরতাল পালিত হয় ঢাকায়। ঐ সময় কারফিউ জারি করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক। সেই থেকে উত্তাল বিক্ষোভ আর মিছিল জনস্রোতে রাতে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবাদে নামে। ভেঙে ফেলে কারফিউ। কোনো বাধাই মানছিল না বাংলার জনগন।  ঢাকায় অগ্নিগর্ভ অবস্থা চলতে থাকে পরবর্তী ক’দিন। মার্চের ৬ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এদিন টিক্কা খানকে পুর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিয়োগ দেন ইয়াহিয়া। 
রাজশাহীতে আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হন ১৪ জন। নিহত হন ১ জন। তুমুল বিক্ষোভ হয় খুলনাতে। মিছিলে গুলি চালায় ইয়াহিয়ার বাহিনী। নিহত হন ১৮ জন। ঐ ঘটনায় আহত হন ৮৬ জন। দেশের অবস্থা যখন অগ্নিগর্ভ তখন ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারের গেট ভেঙে পালিয়ে যায় ৩৫০ জন কয়েদি।  পাকিস্তানের শাসকদের লাগাতার নির্যাতন, গুলি ও হত্যার জের ধরে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় বাঙালির। সম্মুখ প্রতিরোধ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।  

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ-ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। তখনকার রেসকোর্স ময়দানে এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেখানে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত কাঠামো পরিষ্কার হয়। দেশজুড়ে শুরু হয় অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। পাকি শাসকদের হঠাতে সম্মুখ সমরে অংশ নিতে চূড়ান্তভাবে শপথ নেয় বাঙালি।  
১৯৭১ সালের ২ রা মার্চ থেকে ৬ তারিখ অব্দি টানা অগ্নিগর্ভ অবস্থা বিরাজ করে দেশজুড়ে। প্রতারক ইয়াহিয়া খান নতুন করে অধিবেশনের ডাক দেন। কিন্তু মুজিব সাফ জানিয়ে দিলেন, ৪ টি শর্ত পূরণ হলে অধিবেশনে যোগ দিবেন তিনি। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় স্পষ্ট করে শেখ মুজিব বলেন, অবিলম্বে মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত: সামরিক বাহিনীর লোকজনকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। তৃতীয়ত: অবিলম্বে করতে হবে গণহত্যার তদন্ত। আর চতুর্থ শর্ত ছিল-গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ।
তখনকার রেসকোর্স ময়দান তথা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে স্পষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দিকনির্দেশ দেন। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার কথাও বলেন তিনি। সরকারি, আধাসরকারি, সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টসহ অন্যান্য অফিস বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। শুধু অর্থিক লেনদেনের জন্য দু’ঘন্টা করে ব্যাংক খোলা রাখার নিয়ম করে দেন শেখ মুজিব। সামরিক বাহিনী ছাড়া সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য সব ধরণের বাস, ট্রাক, রিক্সা, ট্যাক্সি চলাচলের অনুমতি দেন। 

মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ ঐদিন প্রচার করেনি রেডিও। ঘটনার প্রতিবাদে বেতারের বাঙালি কর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেন। সন্ধ্যা ৭ টায় বেতার ভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা বোমা ফাটায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দিগি¦দিক খেই হারাতে থাকেন। ৭ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীসহ ৫ জনকে সহকারি সামরিক প্রশাসক পদে নিয়োগ দেন ইয়াহিয়া। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য শুরু করেছিলেন দুপুর ২ টা ৪৫ মিনিটে। তাঁর ভাষণ চলে টানা ১৮ মিনিট। অর্থাৎ বিকেল ৩ টা ৩ মিনিটে তা শেষ হয়। 

বহুমাত্রিক কারণেই ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত, শিক্ষণীয় ও রাজনৈতিক গবেষনার বিষয়। ঐতিহাসিক এ ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান শেখ মুজিব। মূলত: স্বাধীনতাযুদ্ধের বীজমন্ত্র বাঙালির মনে গেঁথে দেয়ার জন্য এই ভাষণ ছিল অনন্য, অপরিহার্য। এমনকি হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার ঢেউ জাগিয়েছিল সেদিনের রেসকোর্স। শহর থেকে গঞ্জের মানুষের মনে বাজে মুক্তিযুদ্ধের দামামা। 
মাত্র ১৮ মিনিটের জ্বালাময়ী ভাষণ এ পর্যন্ত ১৩ টির বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এমনকি ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠী মাহাতো সম্প্রদায়ের ভাষা কুড়মালিতেও অনুবাদ হয়েছে এই ভাষণ। এমনকি কুড়মালি ভাষার প্রথম অনুবাদও হচ্ছে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। 

২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো রাজনীতির কবি শেখ মুজিবের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশি বিদেশি লেখক বুদ্ধিজীবীদের কলমে শ্বাশত সত্ত্বা রূপে আখ্যা পায় রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ। বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিব সেই থেকে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রোজ্জ্বল, চিরঞ্জিব-মহান ব্যক্তিত্ব। রেসকোর্স মাঠ ঐদিন ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। শেখ মুজিব উপস্থিত বাঙালিদের উদ্দেশ্যে দেশের সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন। সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিকভাবে হরতাল চলবে। পাশাপাশি পাকিস্তানীদের নিগ্রহ, আক্রমণ ও নির্যাতন প্রতিরোধেরও আহ্বান জানান তিনি। 

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সেদিন প্রচার করেনি পাকিস্তান সরকার। এ ঘটনায় বাঙালিরা নাখোশ হয়ে তুমুল বিক্ষোভ করে। প্রতিবাদের পর রেডিও অফিসে বোমা বিস্ফোরণ হলে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। শেখ মুজিবের ভাষণ না চালাতে রেডিও-টেলিভিশনে আগের থেকেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। এরপরও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেন। আবুল খায়ের ঐ সময় ফরিদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। এদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি ঐতিহাসিক ভাষণের ভিডিও ধারণ করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের। তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার ভাষণের অডিও ধারণ করেন। পরে অডিও রেকর্ডটি এম আবুল খায়েরের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে আর্কাইভ করা হয়। অতপর রেকর্ডটি ভারতে পাঠিয়ে অনুলিপি করে ছড়িয়ে দেয়া হয় বিশ্বব্যাপী। 

মূলত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও পাকিস্তানীরা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে শেখ মুজিবকে চতুর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাদের মতে, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও আমরা কিছুই করতে পারলাম না। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বিদ্যমান অসহযোগ আন্দোলন নতুন রূপ পায়। পরদিন ৮ মার্চ ঐ ভাষণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন সর্বদলীয় ছাত্রনেতারা। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার প্রস্তাব করেন।

(লেখক: ড. অখিল পোদ্দার, প্রধান বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন)   
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি