স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ
প্রকাশিত : ০০:০৭, ২৯ মার্চ ২০১৯ | আপডেট: ১২:০২, ১৬ মে ২০১৯
সর্ব অঙ্গে ব্যথা নামে একটা কথা শুনেছিলাম বিষয়টি আমি এই মুহুর্তে টের পাচ্ছি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে আমার নিজের কাছে কিংবা অন্যের কাছে অভিযোগ করছি না। বরং এই সর্ব অঙ্গে ব্যথা কথাটি আমি ছেলে মানুষের মতো উপভোগ করছি।
আমার মনে হয় বিষয়টা আরো ব্যাখ্যা করা দরকার। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের আগে আগে আমাদের এভারেস্ট বিজয়ী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার আমাকে ফোন করে। স্বাধীনতা দিবসে ভোরবেলা তারা শহীদ মিনার থেকে তাদের অদম্য পদযাত্রা শুরু করবে। যেটা শেষ হবে সাভার স্মৃতিসৌধে। আমি কি তাদের সাথে খানিকটা পথ হাঁটতে পারবো? প্রতিবছরই আমি আনন্দের সাথে রাজি হই এবং তাদের সাথে ঘণ্টা খানেক হাঁটি। আমি তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসি এবং একদল তরুণ-তরুণী কিশোর-কিশোরী বালক বালিকা এমনকি শিশুরা বাংলাদেশে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশাল বিশাল পতাকা ঘাড়ে নিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। দেখে আমার খুব ভালো লাগে।
কাজেই আমি এ বছরও আনন্দের সাথে রাজি হয়েছি। রাতে ঘুমাতে দেরী হয়েছে বলে সকালে ওঠতে একটু দেরী হয়েছে এবং কোনোভাবে তাড়াহুড়ো করে শহীদ মিনারে হাজির হয়েছি। পুরো দলটি ঠিক সেই মুহুর্তে পদযাত্রা শুরু করেছে এবং আমি কোনোভাবেই তাদের পিছনে সামিল হয়েছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে পরের দিন খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হয়েছে,পদযাত্রার শুরুতে আমি একটা ভাষণ দিয়েছি। ভাষণে আমি কি বলেছি সেটাও বানিয়ে বানিয়ে লিখেছে। এটি প্রথম নয়, কিছুদিন আগে প্রথম আলোও ঠিক এই কাজটি করেছে। আমি যেই কথা বলিনি তারা আমার মুখ থেকে সেই কথা বলেছি বলে সংবাদ করেছে। আমি প্রতিবাদ করে একটা ইমেইল করেছিলাম তার কোনো উত্তর আসেনি।
আমার ধারণা ট্রাইবুনালের প্রোসিকিউটর ছিলেন (যিনি বিচারকাজ সমাপ্ত করার পর করাচিতে চল্লিশ বছর জেল হয়েছে। আমি অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, এরকম একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছে বলে মনে করেছিলাম তার নিশ্চয় আরো বয়স হয়েছে। ভদ্র মহিলা হাসলেন আর উত্তর দিলেন আমাকে যে বয়সী দেখায় আসল বয়স তার চেয়ে অনেক বেশী। বিনয়ের কথা, সবসময় দেখেছি পৃথিবীর সব বয়সী মানুষরাই বিনয়ী হয়।
যাই হোক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, নাস্তা করে, গান শুনে, ব্রতচারী নাচ দেখে আমার পদযাত্রা শেষ করে ফিরে আসার কথা। কুমুদিনী থেকে মেয়েরা প্রতিবছরই আসে। কিছু কণ্ঠ আমার খুব প্রিয়। মুক্তির ও মন্দিরে সোপান তলে গানটা শুনিয়েছিল। আমি যখন পদযাত্রা শেষ করে বাসায় ফিরার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন হঠাৎ মনে হলো আর একটু হাঁটলে কেমন হয়?
তাই আবার পদযাত্রীর সাথে নেমে গেলাম। আমি তখন তাদের মতে টকটকে লাল টি শার্ট পড়েছিলাম, সেখানে লেখা ছিল,`শোক থেকে শক্তি,অদম্য পদযাত্রা, ৫২ থেকে৭১ স্বাধীনতার পদরেখায় পদযাত্রা।
আমাকে দেখে শুনে রাখার জন্য আমার পাশে সারাক্ষণ একজন আছে। চৈত্র মাসের কটকটে রোদ। মনে হয় সারা শরীর ঝলসে যাচ্ছে ভাগ্যিস মাথার চুল। পেকে সাদা হয়ে গেছে তাই সূর্যের আলো শোষিত না হয়ে প্রতিফলিত হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেতো। যারা নিয়মিত হাঁটাহাটি করে তারা অনেকেই মাথার উপর গামছা নাড়িয়ে নিয়েছে। আমাদের একেবারেই গ্রামীণ বিষয় হলো গামছা। একজন চাষী শ্রমিক না হয় মুক্তিযুদ্ধের কথা চিন্তা করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মাথায় গামছা বাধা। আমার পরিচিত অনেকেই আছে যারা আমেরিকা যাবার সময় গামছা নিয়ে গিয়েছে, নাম দিয়েছে ফিনফিনে পাতলা তোয়ালে।
আমার সাথে যারা হাটছে তাদের বললাম, পরের বার একটা গামছা নিয়ে আসতে হবে। মুখ থেকে কথাটি বের হওয়ার আগেই একজন তার ব্যাগ থেকে লাল টকটকে একটা গামছা বের করে দিলো। আরেকজন রোদ থেকে বাঁচার জন্য মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে একটা ক্যাপ আমার মাথায় পরিয়ে দিলো। একটা ছোট্ট শিশুকে যেভাবে সবাই দেখে শুনে রাখে আমার অবস্হাটা অনেকটা সেই রকম। সবাই আমাকে জেনে শুনে রাখছে যেন কষ্ট না হয়। চৈত্র মাসের বিখ্যাত কটকটে রোদে হেঁটে হেঁটে আমরা মীরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে পৌছেছি। দেখবো দেখবো করে ঢাকাতে থেকেও এইটি আগে দেখা হয়নি। সবার সাথে হেঁটে হেঁটে জল্লাদখানা বধ্যভূমিটি দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্ববধানে এটাকে তৈরী করা হয়েছে। উপস্হাপনাটি সব মিলিয়ে অসাধারন। ৭১`সালে এটি মূল জনবসতি থেকে কিছুটা দূরে ছিলো বলে সাধারন মানুষদের ধরে নিয়ে এসে এখানে জবাই করে পেলে দেওয়া হতো। ৭১ সালে আমাদের দেশে যে ভয়াবহ গনহত্যা হয়েছে বাংলাদেশ এখন তার একটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার ধারনা জল্লাদ খানার মতো দু একটি বধ্যভুমি দেখলেই এই দেশে সংঘঠিত পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম জেনোসাইড নিয়ে কারো কোনে সন্দেহ থাকবে না।
জল্লাদখানা থেকে সবাই বোটানিক্যাল গার্ডেনেরর ভিতর দিয়ে চটবাড়ী ঘাট পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে ঘন্টা খানেক পথ নৌকায়। বোটানিক্যাল গার্ডেনে কখনো যায়নি,সবাই আমাদের বললো এর ভিতরের পথটুকু খুবই সুন্দর। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা,পুরো এলাকা ফুলে ফুলে ঢাকা। দেখার লোভ হলো, কিন্তু আমাদের অনভ্যস্ত শরীর ততক্ষণে বিদ্রোহ ঘোষনা শুরু করেছে বিশেষ করে করে চৈত্র মাসের গনগনে রোদে মনে হচ্ছে সবকিছু ঝলসে দিবে। একজন বুদ্ধি দিলো শহরের কিছুটা পথ আমরা গাড়ী দিয়ে পাড়ি দিতে পারি।
শেষ পর্যন্ত তাই করলাম,তরুন-তরুনী, কিশোর-কিশোরীরা যখন বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের পতাকা নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে আমি তখন খানিকটা পথ গাড়ি দিয়ে চলে এসেছি। বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছগাছালির ছায়ায় অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং কিছুক্ষনের মাঝেই পুরো দলটা চলে এলো। আমি আবার তাদের সাথে হাঁটতে শুরু করেছি, বোটানিক্যাল গার্ডেনের ছায়া ঢাকা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় চটবাড়ী ঘাট নামে নৌকাঘাটে পৌছেছি। সেখানে আমাদের নেওয়ার জন্য তিনটি বড় বড় ট্রলার অপেক্ষা করছে। নদীর কালো বিষাক্ত পানির ভিতর দিয়ে ট্রলারগুলো যেতে থাকে এবং আমি নিজের ভেতর একধরনের বেদনা অনুভব করি। বাংলাদেশের নদীর মতো এতো সুন্দর নদী পৃথিবীর কোথাও নেই অথচ এখন এই নদীগুলার কি ভয়াবহ করুণ অবস্হা। দেশের উন্নয়নের জন্য এখানে কলকারখানা দরকার,সেই কলকারখানা তার বর্জ্য পেলার জন্য নদীগুলাকে ব্যবহার করছে। এক সময় আমরা দরিদ্র ছিলাম,আমাদের কিছু করার ছিলো না,আমরা সহ্য করেছি। কিন্তু এখন তো দেশ দরিদ্র নয়,এখন কেন আমরা পরিবেশের দিকে নজর দিই না? কল কারখানার মালিকদের কেন বুঝাই না যে তারা একটুখানি কম মুনাফা করে কেন পরিবেশটুকু রক্ষা করে না?
আপনজন যখন ক্যান্সারে মারা যায় তার জন্যে সে নিজেই হয়তো দায়ী? তার কারখানার বর্জ্য নদীর পানি থেকে ঘুরে-ফিরে তার আপনজনের দেহে এই ভয়াবহ রোগের বীজ বপন করেছে?
আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করার জন্য তাদেরকে প্রায় মানুষের সম্মান দিয়ে আইন পাশ হয়েছে। নদীগুলো যেহেতু নিজেরা কথা বলতে পারে না, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাতর কণ্ঠে আর্তনাদ করতে পারে না তাই মানুষেরা এখন তাদের পক্ষে আইনী সহায়তা চাইতে পারবে। আমাদের বিচার বিভাগের কী অসাধারণ একটি অবদান। কবে আমরা তার সুফল পাইতে শুরু করব?
যাই হোক, তিনটি নৌকা পাশাপাশি যেতে থাকে। যারা গান গাইতে পারে প্রত্যেকটি নৌকা তাদের নিয়ে টানাটানি করেছে, সৌভাগ্যক্রম তারা আমাদের নৌকায় জায়গা পেয়েছে। কাজেই পুরো পথটুকু তারা গান গাইতে গাইতে এসেছে। পতাকাগুলো নৌকাগুলোতে উচু করে ধরে রেখেছে অনেক দূর থেকে দেখা যায় সেগুলো উড়ছে। দূরে একটা নৌকায় মুক্তিযুদ্ধের পতাকা, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তো এভাবেই নৌকা করে যুদ্ধ করতে যেতো। যদি এই তরুণ-তরুণীগুলির একাত্তরে জন্ম হতো তারা নিশ্চয়ই সবাই মুক্তিযুদ্ধ করতে যেতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই। কিন্তু দেশের জন্যে ভালোবাসা প্রকাশ করার যে সুযোগটা পেয়েছে সেটা দিয়েই প্রকাশ করছে।
এক সময় নৌকা ঘাটে থেমেছে। আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে আবার হাঁটতে শুরু করেছি। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম পথের দুই পাশে বিস্তৃত গোলাপ বাগান। নেদারল্যান্ডে টিউলিপ বাগানের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু আমাদের নিজের দেশেই যে এরকম বিশাল গোলাপ বাগান আছে কে জানতো?
হেঁটে হেঁটে দুটি স্কুল পার হয়েছি। একটি স্কুলের বাচ্চা ছেলেরা নাড়ু-মুড়কি আর সরবত তৈরি করে অপেক্ষা করছে। দ্বিতীয় স্কুলটিতে দুপুরের খাবারে আয়োজন। এর মাঝে কতো কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে কে জানে, কিন্তু অনেকেই ক্লান্ত হতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়ছে।
দুপুরে খাবার পর আবার হাঁটা শুরু হলো। এবারে গন্তব্য জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার লোক প্রশাসন বিভাগের কম বয়সী বিভাগীয় প্রধানও আমাদের সাথে আছে। তার উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলে-মেয়ে এই অভিযাত্রী দলটিকে অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে।
কাঠফাটা রোদ দেখে আমি হেঁটে যাবার সাহস পেলাম না। গাড়ী করে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অন্য সবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক খোলামেলা, বড় বড় গাছ, বড় বড় দিঘী দিয়ে ঢাকা। আমি যতবার এসেছি ততবার মুগ্ধ হয়েছি।
বসে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে সময় কাটাচ্ছি। বাচ্চা কাচ্চাদের জন্যে লেখালেখি করেছি বলে এই প্রজন্মের অনেকেই আমার লেখা কিছু একটা পড়ে বড় হয়েছে, সে জন্যে আমার জন্যে তাদের এক ধরনের মমতা আছে, কথা বলার সময় আমি সেটা টের পাই।
ততক্ষনে সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে। রোদের তীব্রতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অপেক্ষা করতে করতে এক সময় বিশাল পতাকা হাতে অভিযাত্রী বাহিনীটিকে দেখতে লেলাম। তারা পতাকা উড়িয়ে উড়িয়ে আসছে। শহীদ মিনারে খানিকক্ষন সময় কাটিয়ে সবাই স্মৃতিসৌধের দিকে রওনা দিল।
সারাদিন এই তরুণ তরুণীর সাথে কাটিয়ে তাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। গত ছয় বছর থেকে তারা এই অদম্য পথযাত্রা করে যাচ্ছে। এই বছর শুধু ঢাকায় নয় জামালপুরের অভিযাত্রীরা পিটি আই বধ্যভূমি থেকে শুরু করে প্রায় একুশ কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রা করে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরে যাচ্ছে। এই অভিযাত্রী দলের পদযাত্রায় স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের খরচ থাকে কিন্তু তারা কখনোই কর্পোরেট স্পন্সরদের মুখাপেক্ষি হয়নি এবং হবেও না। তারা নিজেরা সবাই মিলে এই খবরটি বহন করে। তাদের এই পদযাত্রায় যোগ দেবার জন্যে সারা দেশ থেকে ছেলে মেয়েরা আসে। গত বছর পাঁচ ছয় বছরের একটি শিশু পুরো পথটি হেঁটে অত্রিক্রম করেছে।
যাই হোক, রোদ কমেছে বলে আমার সাহস বেড়েছে। আমি এবারে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। পথটুকু আর কতো কিলোমিটার জিজ্ঞেস করে লাভ নেই কারণ এতক্ষনে আমি আবিষ্কার করেছি এই অভিযাত্রী দলের সদস্যদের কাছে দূরত্বের কোনো অনুভূতি নেই। তারা যে কোনো দূরত্ব হেসে খেলে পার হয়ে যায়। অন্ধকার হওয়ার পর যখন স্মৃতি সৌধে কেউ থাকে না তখন তারা নিরিবিলি সেখানে পৌঁছে। এই স্মৃতি সৌধটি তাদের জন্যে একটি আবেগের জায়গা। সেখানে পৌঁছে তারা হই হুল্লোড় করে না, চুপচাপ অন্ধকারে বসে থাকে।
কাজেই আবার হাঁটছি। হাঁটছি এবং হাঁটছি। কনা নামের যে মেয়েটি সারাক্ষণ আমাকে একটা শিশুর মতো দেখে রাখছে সেও এক মুহুর্তের জন্যেও আমাকে চোখের আড়াল করেনি। এভাবেই বিজয়ী নিশাত মাঝে মাঝেই আমার খবর নিচ্ছে। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার কী অবস্থা। আমি বললাম, আমি ভালোই আছি। শুধু হাঁটু দুটো আমার কথা শুনতে চাইছে না। বিদ্রোহ করতে চাইছে। সে বল্ল আমি চাইলে আমাকে মোটর বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি বললাম, মনে হয় তার প্রয়োজন হবে না।
এক সময় আমরা স্মৃতি সৌধে পৌঁচেছি, তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মতো বাজে। বাইরে অনেক মানুষের ভীড়, ভেতরে অন্ধকার, নিরিবিলি এবং ফাঁকা। শুধু এক পাশে দূরে গান বাজনা হচ্ছে, না হলেই ভালো হতো।
স্মৃতি সৌধের ভাবগাম্ভির্যে্যর সাথে এই গান বাজনা মানায় না। হেঁটে হেঁটে স্মৃতি সৌধের কাছাকাছি সবাই বসে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, ইলেকট্রিসিটি নিয়ে হয়তো একটু সমস্যা রয়েছে। স্মৃতি সৌধটিও অন্ধকারে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে স্মৃতি সৌধের আলেঅ জ্বলে উঠল। বিশাল স্মৃতি সৌধটি তার পুরে ভাবগাম্ভীর্য্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। যতবার আমি স্মৃতি সৌধটি দেখি ততবার মনে হয় এই বিশাল স্মৃতিসৌধের একটুখানি আমার, মুক্তিযুদ্ধে আমার যে আপনজন, আমার যে বন্ধুরা শহীদ হয়েছে তাদের অধিকারে স্মৃতিসৌধের একটুখানিও আমার নিজস্ব হয়ে গেছে। একান্তভাবেই আমার।
অভিযাত্রী দল এখানে এসে একটা শপথ নেয়, শপথ নেয়ার আগে তারা আমাকে কিছু বলতে বলল। আমি কি বলব? যেটা অনুভব করি সেটাই বললাম। আমি বললাম, তোমরা কেউ নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখনি। সেই কবে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেছে এতোদিন পরে তোমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যেতে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু কী আশ্বার্য! মুক্তিযুদ্ধের জন্যে আমাদের ভেতর যে আবেগ, তোমাদের ভেতরেও সেই আবেগ। সেই ভালোবাসা।
তারপর তারা শপথ পাঠ করল। এই শপথ বাক্যগুলো এতো সুন্দর যে সেগুলো লেখার জন্যই আমি আগের পুরো লেখাটুকু ভূমিকা হিসেবে লিখেছি। তাদের কথা শুনে মনে হলো স্মৃতিসৌধটি বুঝি পাথর এবং কংক্রীটের একটি বস্তু নয়। এই সৌধটির ছদ্মবেশে লক্ষ লক্ষ শহীদ, লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সামনে নি:শব্দে দাঁড়িয়ে আছে, আর িএই তরুণ তরুণী কিশোর কিশোরীরা তাদের কাছে শপথ করছে। তারা বলল,“ হে আমার মহান অগ্রজেরা, তোমাদের উপর অর্পিত কর্তব্য তোমরা পালন করেছো অসীম সাহসিকতায়, বিরল ভালোবাসায় আর নিপুন নিষ্ঠায়। কর্তব্যের সময় িএবার আমাদের।
জীবন উৎসর্গকারী হে শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, তোমাদের সাহস, ভালোবাসা, ও নিষ্ঠা সঞ্চারিত হোক আমাদের হৃদয়ে। মস্তিষ্কে শহীদের রক্তের মত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠুক আমাদের মেধা মনন, শিল্পবোধ ও রুচি। অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা, জ্ঞান-দক্ষতা ও সাধনা শক্তিতে সমাজ হয়ে উঠুক বলীয়ান।
যে মহান আত্মত্যাগে আমরা আজ উচ্চ শির স্বাধীন, সেই ত্যাগ স্মরণ করে শপথ নিই। তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেবো না। যে শক্ত ভিত্তির পত্তন তোমরা করেছো, তারই উপর নির্মাণ করবো সৌধের পর সৌধ। সমৃ্দ্ধ সাংস্কৃতিক সৌধ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সৌধ, সম্প্রীতির সৌধ, আর জাতির নব জাগরণের সৌধ।”
শপথ শেষ করে সবাই নি:শব্দে বসে রইল অনেকক্ষণ। আমি যখন চরে আসছি তখন আট নয় বছরের ছোট একটি মেয়ে আমার কাছে ছুটে এসে বলল, “ স্যার, আজকে ্ ামি পুরো পথটি নিজে নিজে হেঁটে এসেছি।” আমি শিশুটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। যে দেশে এ রকম শিশু জন্মায় সেই দেশ নিয়ে আমাদের ভয় কী?
হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমার সর্ব অঙ্গে ব্যথা। বসলে দাঁড়াতে পারি না। দাঁড়ারে বসতে পারি না। কিন্তু আমার মুখে এগাল ওগাল জোড়া হাঁসি। হঠাৎ করে এরকম অসাধারণভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারলে কার না আনন্দ হবে?
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।