ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

স্বাবলম্বী হওয়ার অপেক্ষায় দক্ষিণের তরুণরা

মুনতাকিম আশরাফ

প্রকাশিত : ২৩:৩৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

এক সময়ের নৌপথ নির্ভর বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। বাংলাদেশের কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতু আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। বিস্তৃর্ণ পদ্মার বুকে সকলের দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মার তীর থেকেই দেখা যাচ্ছে- দেশের দীর্ঘতম সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো। 

গত ১০ ডিসেম্বর ৪১তম স্প্যান (ইস্পাতের কাঠামো) বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে পুরো সেতু। আর এরইসঙ্গে পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘ সেতুর অবস্থান দখল করলো পদ্মা সেতু। এর মাধ্যমে যুক্ত হলো পদ্মা নদীর দুই পাড়ের মানুষ। এ গর্ব পুরো বাংলাদেশের। বাংলাদেশের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থায় এ এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। 

পদ্মাসেতুর স্বপ্নটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়ালো দেশের দীর্ঘতম এ সেতু।

পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্রই বদলে দেবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন ও কর্মের ওপর ফেলবে নানা ইতিবাচক প্রভাব। দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে। সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করবে। 

আরও বিশদভাবে বলতে গেলে- এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনও সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। 

সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পুরো জীবনযাত্রাই পাল্টে যাবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বহুকাল ধরে কৃষিতে উন্নত। নানা ধরনের কৃষিপণ্যের প্রাচুর্য থাকার পরও সঠিক বাজারজাতকরণের সমস্যায় ভুগতো এতকাল এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনকারীরা। পদ্মাসেতু চালু হয়ে গেলে এ অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সঠিক দামে কৃষিপণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়বে কৃষকের। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। 

কোনও বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশই উঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর ভূমিকা থাকবে বিরাট।

তবে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি কোনওভাবেই সহজ ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ও দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই এমন একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশ। 

বহু বছর ধরে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদীনির্ভর। নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান পথ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সড়ক যোগাযোগ গুরুত্ব পেতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও বাধা ছিল নদ-নদী। যে কোনও সড়ক তৈরি করতে গেলেই ছোট-বড় নদী অতিক্রম করতে হতো। এজন্য চালু ছিল অনেক ফেরি। ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সে সময়েই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। 

১৯৯৮ থেকে ২০০০ এই সময়ে পূর্ব সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে বাঙালীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় শেখ হাসিনার সরকার। 

শুরুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মাসেতু নির্মাণে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে যায় এবং একে একে এডিবি, জাইকা, আইডিবিও চলে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তো হেরে যাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব নন। 

দৃঢ় কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, পদ্মা সেতু হবে এবং সেটা দেশের নিজস্ব অর্থায়নে। বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর পশ্চাৎপসরণে সৃষ্টি হওয়া জটিল পরিস্থিতি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় মোকাবেলা করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনা। স্পষ্ট জানিয়ে দেন- বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নয়; দেশের নিজস্ব অর্থায়নেই হবে আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতু! 

১২ ডিসেম্বর ২০১৫ সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতুর মূল অংশের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তিনি। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে সেতু ও নদীশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ ও কাজ তদারক করার জন্য আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিযুক্ত করেন। ২০১৪ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা দেশের যে দুটি উন্নয়ন প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন, তার মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প একটি। শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় পদ্মা সেতু বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ববাসীর সামনে আজ দৃশ্যমান! এখন শুধু কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষা।

পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ১.২ শতাংশ হারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহের প্রাক্কলন অনুযায়ী- পদ্মা সেতু দেশের প্রতিবছর ১.৯ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ৩১ বছরের মধ্যে জিডিপি ৬০০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩২ সালের পর বাৎসরিক রিটার্ন ৩০০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। 

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ শক্তিশালী হবে বা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে। ফলে ঐ অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ন, জীবনমান বৃদ্ধি পাবে যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে। বিসিআইএমের রুটের সাথে কানেক্ট থাকায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। 

পদ্মা সেতু ও উভয় পাড়ের পর্যটন থেকেই প্রতিবছর কয়েক’শ কোটি টাকা আয় হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণকালীন নদী শাসনের ফলে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ৯ হাজার হেক্টর জমি নদী ভাঙ্গন থেকে রেহাই পাবে। পাশাপাশি বন্যার কবল থেকেও রক্ষা পাবে কয়েক লক্ষ মানুষ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ৫০% ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখা ফেরি সার্ভিসের প্রয়োজন পড়বে না। 

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় এ সেতু থেকে আদায়কৃত টোল সম্পূর্ণরুপে সরকার পাবে। ফলে প্রতিবছর সরকারের আয় বাড়বে প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ডলার। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহের সাথে বিভিন্ন জেলার সাথে সরাসরি যোগাযোগ শ্রমের গতিশীলতা বাড়বে। পদ্মা সেতুর সুফল হিসেবে প্রায় ২ কোটির অধিক বেকারের কর্মসংস্থান ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেতুর উভয় পাশেই ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ও নগরায়ন ঘটবে যা সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের সাথে এরইমধ্যে পরামর্শ শুরু করেছে সরকার। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে এখানে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উত্তরের বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের চেয়ে পিছিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা ও বরিশাল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী, ওই বছর দেশে মোট অর্থনৈতিক স্থাপনা ছিল ৭৮ লাখের কিছু বেশি। এর মধ্যে তখনকার সাতটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে কম স্থাপনা ছিল সিলেট, বরিশাল ও খুলনায়। 

যেমন- রংপুরে অর্থনৈতিক স্থাপনার সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি। বরিশালে তা ছিল সাড়ে ৩ লাখের মতো। অবশ্য পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা খুলনা-যশোর অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার সমৃদ্ধ সুন্দরবন ও সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অভাবনীয় সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশাল পর্যটন শিল্প। 

শিল্পায়ন ও পর্যটনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে আধুনিক নগরায়ন। পদ্মা পাড়ে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের প্রজাপতি জাদুঘর, সিঙ্গাপুরের আদলে অলিম্পিক ভিলেজ। সেতুর পাশেই ক্রীড়াপল্লী ও অলিম্পিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মার চরে সবরকম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রীড়াপল্লী নির্মাণসহ সুবিশাল অলিম্পিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমাদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণ আরও এগিয়ে যাবে। 

স্থানীয়রা পদ্মাপাড়ে আধুনিক শহর গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কারণে বাস্তুচ্যুত ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণকে আশপাশের এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

পদ্মার ওপারে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬টি জেলা, ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, পোপালগঞ্জ জেলাসহ মোট ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষ এ সেতুর ফলে সরাসরি উপকৃত হবে। বদলে যাব দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনৈতিক চিত্র। এর ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের পদ্মার ওপারে বিনিয়োগের ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। গার্মেন্ট, পাট, হিমায়িত খাদ্য, পর্যটন শিল্পে বিনিয়াগের দুয়ার খুলে যাবে। 

পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিনদিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। এতে রফতানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রফতানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের চলাচল বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়- ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের মধ্যে খুলনা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে মোট আমানতের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের সাড়ে ৪ শতাংশ। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ শতাংশ। 

পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে ওপারে বিনিয়াগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে, তখন ঋণের প্রবাহও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশি সচল হবে এবং নতুন নতুন খাত যুক্ত হলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন সঞ্চয়ও বাড়বে, যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়- পদ্মা সেতু চালু হলে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ৩৫ হাজার। এ থেকে রাজস্ব আয় হবে ৮২২ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে তা বেড়ে ৩৯ হাজারে দাঁড়াবে। রাজস্ব আয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৫৮ হাজার যানবাহন চলবে। রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০৩৫ সালে তা আরও বেড়ে ৬৬ হাজার যানবাহন এবং রাজস্ব আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০৫০ সালে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে ৭৬ হাজার। রাজস্ব আয় বাড়বে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং তাদের এক সমীক্ষায় বলছে- সেতুটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। এ সমীক্ষায় রেল সংযোগের বিষয়টি ছিল না। পরে রেল সংযুক্ত হওয়ায় সেতুটি আরও বাড়তি সুবিধা নিয়ে আসবে বলার অপেক্ষা রাখে না। পদ্মা সেতু চালু হলে উত্তরের মতো ফসলের বাড়তি দাম পাওয়া যাবে বলে মনে করেন দক্ষিণের কৃষকেরা। 

তাঁদের এই আশার দিকটি উঠে এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত মে মাসের এক সমীক্ষায়। সমীক্ষা বলছে- এতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেয় আইএমইডি, যাঁদের ৯৫ শতাংশ বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিপণ্যের পরিবহন সহজ হবে। 

এডিবি গত সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়- সেতুটি দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াবে শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। সেতু চালু হলে কৃষকরা প্রতিদিন সহজে শস্য, সবজি ও মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারবেন। উদ্যোক্তারা অপেক্ষায় পুঁজি নিয়ে, কাঁচামাল ও পণ্য আনা-নেওয়া সহজ হলে তাঁরা কারখানা করবেন। 

তরুণদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। পরিবহন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বাস-ট্রাক নামাতে পারবেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, এই সেতু শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করবে না, অর্থনৈতিক সুফল পাবে ২১ জেলার মানুষ। জিডিপি বাড়বে ১.২৩%।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পদ্মা সেতুর সংযোজন শেখ হাসিনা সরকারের এক অবিস্মরণীয় অবদান। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পদ্মা সেতু বিরাট ভূমিকা রাখবে। দেশের তরুণ সমাজের সামনে উপস্থাপিত হবে এক নতুন বাংলাদেশ।

লেখক- সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই। 

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি