ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি

কৃষিবিদ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর

প্রকাশিত : ১৬:৩৫, ২ জুলাই ২০২৪ | আপডেট: ১৭:০৪, ২ জুলাই ২০২৪

কৃষিবিদ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর

কৃষিবিদ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ধান ও অন্যান্য শস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষককে উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রদানের মাধ্যমে টেকসই কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। ফসল রোপণ থেকে কাটা পর্যন্ত কৃষিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার এবং ন্যানো প্রযুক্তির সার উৎপাদন খরচ কমিয়ে কৃষিতে পরিবর্তন আনতে পারে।

১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৬ লাখ টন ইউরিয়া, ১০ লাখ টন ট্রিপল সুপারফসফেট (টিএসপি) এবং ১৬ লাখ টন ডাই এমোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। 
রাসায়নিক সারের ধারাবাহিক প্রয়োগে উপকারী অণুজীব এবং মাটির গুনাগুন কমছে।

মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। সার ব্যবহারের তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে ইউরিয়া সার অন্যান্য সারের তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলে মাটির জৈব উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ুপরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষিকে একটি সংকটজনক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে ক্রমবর্ধমান সমস্যা মেটাতে এবং খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চাহিদা অনুযায়ী নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। ন্যানো প্রযুক্তি হলো তার মধ্যে একটি। ন্যানো প্রযুক্তি বর্তমান শিল্প বিল্পবের পিছনে মূল শক্তি। গ্রীক শব্দ "ন্যানোস", যা আক্ষরিক অর্থে"ছোট" বুঝায়।

কৃষিতে ন্যানো সার গাছের শিকড়ের পুষ্টি শোষণের ক্ষমতা উন্নত করতে পারে। যেহেতু ন্যানো পার্টিকেলগুলো অন্যান্য পার্টিকেলের আকারের তুলনায় একটুবড় পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট; তারা গাছের শিকড়ের সাথে আরও বেশি যোগাযোগ করতে পারে এবং নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম, ফসফরাস এবং আরও অনেক কিছুর মতো অন্যান্য পুষ্টির গ্রহণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ন্যানো সারের আয়নগুলোর ধীর এবং সঠিক নির্গমন এর ফলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব এবং পুষ্টি অপচয় কম হয়। ন্যানো সার ব্যবহারে সারের অপচয় কমে এবং পুষ্টির দক্ষতা বাড়াতে
পারে, যা পরিবেশ দূষণ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

দানাদার ইউরিয়ার ৫০% ন্যানো ইউরিয়া দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, যা গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনকে প্রায় ৫০% কমাতে পারে। ন্যানো ইউরিয়া হল একটি ন্যানো প্রযুক্তি ভিত্তিক ফার্টিলাইজার যা উদ্ভিদকে নাইট্রোজেন প্রদান করে। ন্যানো ইউরিয়া সারের পার্টিকেল সাইজ হচ্ছে ২০-৫০ ন্যানোমিটার এবং পৃষ্ঠ ক্ষেত্রফল অনেক বেশি (একটি ১ মিলিমিটার দানাদার ইউরিয়া থেকে ১০,০০০ গুন বেশি) সাধারণত ৫০ কেজি ইউরিয়া ব্যাগে ৪৬% নাইট্রোজেন থাকে, যেখানে সামগ্রিক নাইট্রোজেনের পরিমাণ (৫০ী০.৪৬) ২৩ কেজি। গবেষণায় দেখা যায় যে উদ্ভিদ সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নাইট্রোজেন শোষণ করতে পারে। ফলে ৫০ কেজির ইউরিয়ার ব্যাগ থেকে গাছ সর্বোচ্চ (২৩ী০.৩০) ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন শোষণ করতে পারে। দানাদার ইউরিয়াতে সমষ্টিগত গড় আকার ১০,০০০ ন্যানোমিটার, যেখানে ন্যানো ইউরিয়াতে সমষ্টিগত গড় আকার প্রায় ২৫ ন্যানোমিটার। তাই (১০,০০০/২৫) ৪২০ মাইক্রো ইউরিয়া সমষ্টি একটি দানাদার ইউরিয়া সমষ্টির সমান। ৫০০ মিলি ন্যানো সারের একটি বোতলে ৪% নাইট্রোজেন থাকে। গণনা অনুসারে, একটি ৫০০-মিলি বোতলে ২০ গ্রাম নাইট্রোজেন রয়েছে। ন্যানো ইউরিয়ার কার্যদক্ষতা ৯০% হওয়ায় ৫০০ মিলি বোতলের ১৮ গ্রাম নাইট্রোজেন গাছ শোষন করতে পারে।

সুতরাং, নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা ন্যানো ইউরিয়ার জন্য (৪২০ী১৮.০) ৭৫০০ গ্রাম বা ৭.৫ কেজি যা একটি ৫০ কেজি প্রচলিত ইউরিয়া ব্যাগের সমতুল্য। দেশে বহুল ব্যবহৃত সার ইউরিয়া। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রায় ২৬ লক্ষ টন, কিন্তু দেশীয় উৎপাদন হয় মাত্র ১০ লক্ষ টন; বাকি ১৬ লক্ষ টন আমদানি করতে হবে। প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের আমদানি মূল্য ৮১ টাকা বিবেচনা করলে ৫০ কেজি ইউরিয়ার দাম ৪,০৫০ টাকা। সর্বমোট ২৬ লক্ষ টন ইউরিয়ার চাহিদা পূরণের জন্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। কৃষক প্রতি কেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা দরে ৫০ কেজির ১ বস্তা সার ১৩৫০ টাকায় ক্রয় করে। হিসাব অনুযায়ী চাহিদকৃত ২৬ লক্ষ টন সারের জন্য কৃষক পরিশোধ করে ৭ হাজার কোটি টাকা এবং সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। তবে, ৫০০ মিলি ন্যানো ইউরিয়া (৫০ কেজি ইউরিয়ার সমতুল্য) ব্যবহারে খরচ দানাদার ইউরিয়া থেকে ৫০% কম হবে। যদি ন্যানো ইউরিয়াতে দানাদার ইউরিয়ার সমান সরকারি ভর্তুকি দেয়া হয় তাহলে ইউরিয়া সার আমদানি খরচ কমবে প্রায় ৫৮% এবং সরকারি ভর্তুকি হ্রাস পাবে প্রায় ৮৭%।

সম্প্রতি ভারতে তৈরি IFFCO ন্যানো লিকুইড ফার্টিলাইজারের অনেক দেশে চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে। ন্যানো তরল ইউরিয়া সারের কার্যকারিতার জন্য বৈজ্ঞানিক বিশ্ব ব্যাপক উৎসাহ প্রকাশ করেছে এবং ভারতে তাদের বাণিজ্যিক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে তরল সার ব্যবহারের অনুমতি নেই, অন্যান্য অনেক এগ্রো ক্যামিকেল কোম্পানির মতো বাংলামার্ক লিমিটেড ইফকো ন্যানো ইউরিয়ার ল্যাব টেস্ট এবং ফিল্ড ট্রায়াল শুরু করেছে এবং একই সাথে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য কাজ করছে।

লেখক: কৃষিবিদ মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, ডেপুটি ম্যানেজার, বাংলামার্ক লিমিটেড।

কে আই// 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি