ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

স্মার্ট বাংলাদেশঃ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক সংস্করণ

মোঃ নাহিদ হোসেন

প্রকাশিত : ১৯:৫৮, ৩০ জুলাই ২০২৩

ডিজিটাল প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ ধরে আসা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিজয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকার বহুমাত্রিক পরিকল্পনা-কর্মকৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।ইতোমধ্যে সরকারের প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে সরকারের নতুন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার। “স্মার্ট বাংলাদেশ/ভিশন ২০৪১” হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার পথে পরবর্তী বড় পদক্ষেপ।

স্মার্ট বাংলাদেশ (Smart Bangladesh) বাংলাদেশ সরকারের একটি পরিকল্পনা বা রূপরেখা যা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে বোঝায় মূলত প্রযুক্তিনির্ভর জীবন ব্যবস্থা, যেখানে সব ধরনের নাগরিক সেবা থেকে শুরু করে সবকিছুই হবে স্মার্টলি। কোনরকম ভোগান্তি ছাড়াই প্রতিটি নাগরিক পাবে তথ্যের নিশ্চয়তা এবং নাগরিক সুবিধা।স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চ-গতির ইন্টারনেট, শক্তিশালী ডিজিটালঅবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং (ML) এর মতো প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী,টেকসই,জ্ঞানভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং উদ্ভাবনী। অর্থাৎ সব কাজই হবে স্মার্ট।

স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি প্রধান স্তম্ভ হলো: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্ণমেন্ট, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটি।

নাগরিকেরা যখন একটি টেকসই ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে নিজেদের তথ্য আদান-প্রদানে দক্ষ ও সক্ষম হয়, তখনই তাদেরকে ‘স্মার্ট সিটিজেন’ বলা হয়। স্মার্ট সিটিজেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে তথ্য এবং পরিষেবায় সহজবোধ্যে এক্সেস, শ্রমবাজারে অবাধ সুযোগ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং আজীবন ব্যবহারযোগ্য স্মার্ট অবকাঠামো নিশ্চিত করা। স্মার্ট গভর্ণমেন্ট বলতে বোঝায় একটি জবাবদিহিতামূলক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা। স্মার্ট বাংলাদেশ এমন একটি সরকারকে কল্পনা করে যেটি হবে স্বচ্ছ, দক্ষ এবং জবাবদিহিমূলক, এবং যেটি নাগরিকদের উন্নত পরিষেবা প্রদানের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্মার্ট সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল  ই-গভর্নেন্স নিশ্চিত করা, যার লক্ষ্য সরকারি পরিষেবা এবং তথ্যে উন্মুক্ত অনলাইন অ্যাক্সেস প্রদান। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রচার করা। স্মার্ট অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে একটি বিশ্বমানের প্রযুক্তি পার্ক  এবং আইসিটি বিজনেস ইনকিউবেটর তৈরি করা, যা প্রযুক্তি স্টার্টআপের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

স্মার্ট অর্থনীতি একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে। স্মার্ট অর্থনীতিতে নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সম্পদের দক্ষতা, স্থায়িত্ব এবং উচ্চ সামাজিক কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে একটি টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি এমনভাবে দাঁড় করানো হয়, যেখানে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। সমাজের মানুষ যখন তাদের দৈনন্দিন সকল কাজ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে সম্পন্ন করে, তখন সে সমাজকে স্মার্ট সোসাইটি বলে। স্মার্ট সমাজ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত করবে, সহজেই সমাজে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করবে। স্মার্ট নাগরিকেরাই হবে স্মার্ট সমাজের প্রতিনিধি। স্মার্ট সমাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না। এ সমাজ সকল নাগরিকের কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আর এই স্তম্ভগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি সমৃদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা এবং পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভালনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ) উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের।সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে। সবাই প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। 

তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা’ সব কিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে। ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সব কিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা তা করা সক্ষম হব এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ চলছে।আমাদের তরুণ সম্প্রদায় যত বেশি এই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা শিখবে, তারা তত দ্রুত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নানা অনুষঙ্গ ধারণ করে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ধরনের ৫৭টি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ৬৪টি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবিশন সেন্টার স্থাপন এবং ১০টি ডিজিটাল ভিলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের নির্মাণ করা হচ্ছে। সারা দেশে ছয় হাজার ৬৮৬টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ১৩০০০ বেশি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে।

গত ৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে ডিজিটালগত ৭ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গঠিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ এর ৩য় সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় বাস্তবায়ন করা হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।সরকার ইতোমধ্যে সারাদেশে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি দিয়েছে এবং স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করেছে মহাকাশে। বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষের হাতে ১৮ কোটি মোবাইল সিম ব্যবহৃত হচ্ছে। কল সেন্টারভিত্তিক সেবাপ্রাপ্তিতে ৯৯৯, যে কোনো তথ্য জানার জন্য ৩৩৩, কৃষক বন্ধু সেবা প্রাপ্তিতে ৩৩৩১সহ টেলিমিডিসিন সেবা এবং ব্লেন্ডেড লার্নিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। বাংলাদেশের এই রূপান্তরের নেপথ্য কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্র তথ্য ও যোগাযোগ উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ৪০ শতাংশ বিদ্যুতের  দেশ আজ শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। যেখানে লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল,সেখানে দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি  এবং  মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির ওপরে।।আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ এর যুগোপযোগী পরিকল্পনায় ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

চলছে চতুর্থ বিপ্লবের সময়কাল। যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের বুদ্ধি ও ইচ্ছা শক্তি, কারখানার উৎপাদন, কৃষিকাজসহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম ও বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেরও পিছিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই। প্রস্তুতি চালাতে হবে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট হিসেবে বাংলাদেশে তৈরির। কিন্তু স্মার্ট যন্ত্র ও প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদেরও চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিতে হতে হবে স্মার্ট। প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের অজান্তে অনেক ভুল-ত্রুটি, অনিয়ম, অন্যায় ও অবিচার করে থাকি, যা একটু ইচ্ছা করলেই সংশোধন করা যায়। অবদান রাখতে পারি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে। স্মার্ট বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাননীয় তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক মন্তব্য করেন, "আজকের শিক্ষার্থীরাই একদিন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।'

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে।২০৪১ সাল নাগাদ  সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনী সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ। সেই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে, মেট্রোরেলসহ সমন্বিত আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ।মনে রাখতে হবে, স্মার্ট  বাংলাদেশ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়, বাংলাদেশের ১৮কোটি মানুষের ধ্যানজ্ঞান এবং চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে সেই সাথে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক-সায়েন্টিফিক এ্যাসিস্ট্যান্ট-১ ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সায়েন্স (আইসিএস), বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি