স্মৃতিতে সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ঐতিহাসিক নির্বাচন
প্রকাশিত : ১৩:২৪, ১২ নভেম্বর ২০১৮
১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। বেদনাবিধুর সেই দিনটির কথা বারবার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে।
সেদিন আমি ছিলাম জন্মস্থান ভোলায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কয়েক দিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া ছিল। বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে ছিল ঝড়ো বাতাস।
আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ভোলা থানা, দৌলতখাঁ থানা, তজুমদ্দীন থানা। মনপুরার তিনটি ইউনিয়নও আমার নির্বাচনী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন ভোলায় রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট কিছুই ছিল না।
বঙ্গবন্ধু ১৭০০ টাকা দিয়ে একটা মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন। ভোলার মনপুরার সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারের মহান ব্যক্তি বসরতউল্লাহ চৌধুরী; আমরা যাকে শাহজাদা ভাই বলে শ্রদ্ধা জানাতাম, তার একটি জিপ ছিল।
জিপটি তিনি আমার নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। ভোলায় তার বাড়িটি ছিল আমার নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র। তখন ভোলায় আমার বাসাবাড়ি ছিল না।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন। তার ২৫ দিন আগে ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড উপকূলীয় অঞ্চল। আমি তখন নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লিপ্ত। এদিন আমার জনসভা ছিল তজুমদ্দীনের দাসের হাট।
পথে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। মধ্যরাতে শুরু হয় তুমুল ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। সকালবেলা আমি ও মোশারেফ হোসেন শাহজাহান নদীর পাড়ে গিয়ে বিস্মিত হলাম। শুধু কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ। আমরা দিশেহারা হয়ে গেলাম।
এখনও স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিবপুর ইউনিয়নে রতনপুর বাজারের পুকুরপাড়ে শত শত লোককে দাফন করার দৃশ্য! এত মৃতদেহ যে, দাফন করে আর কুলাতে পারছি না। শুধু মানুষের হাহাকার আর ক্রন্দন। তজুমদ্দীনের খবর পাই- ৪০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হয়েছে। যে দাসের হাটে জনসভা করার কথা ছিল, সেখানে কিছুই নেই। দাসের হাটে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন, তারা সবাই সর্বস্বান্ত। আমি দাসের হাট, তজুমদ্দীনে গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অবাক হলাম।
বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচনী গণসংযোগে সাতক্ষীরায় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে বার্তা পাঠালেন, আমি যেন সর্বত্র দুর্গত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করি এবং শুকনো খাবার, বিশেষ করে চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছে দিই। আমি যখন রাস্তা দিয়ে যেতাম, হাট-বাজার ভেঙে মানুষ ছুটে আসত। সন্ধ্যাবেলায় এমন হতো যে, মানুষ আমার মুখের ওপর হারিকেন ধরত আমাকে একনজর দেখার জন্য।
মানুষজন ভোলার আঞ্চলিক ভাষায় বলত, `ছ্যামরাকে দেখি। ছ্যামরাকে দেখলে ছওয়াব হবে। আমাদের জন্য ও এত কাজ করে!` ১৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। যখন মনপুরায় গেলাম, দেখি, বহু লোকের ভিড়ে একজন সল্ফ্ভ্রান্ত মানুষ খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে তার স্রেফ একটা লুঙ্গি। আমি লঞ্চ থেকে নেমেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি শ্রদ্ধাভাজন শাহজাদা ভাই।
বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে টেনে আদর করলেন। লঞ্চের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর যে পাজামা-পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট ছিল, সেগুলো তিনি শাহজাদা ভাইকে দিলেন।
উপকূলীয় দুর্গত এলাকা ভোলা, রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ সফর শেষে হোটেল শাহবাগে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, `দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। এভাবে আমরা মানুষকে মরতে দিতে পারি না।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনও দুর্গত এলাকায় আসেননি। আমরা যে কত অসহায়- এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে। একবার পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে; আরেকবার এই ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রমাণিত হলো। এভাবে আর জীবন দিতে চাই না। আমরা স্বাধিকারের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করতে চাই।`
আমি তখন উদয়াস্ত কাজ করছি। দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এলেন ভোলায়। আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে গাড়িতে তুলে নিলেন। ১৪ দিন পর অর্থাৎ ২৬ নভেম্বর সি প্লেনে চেপে ভোলায় এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। নামলেন চকিঘাটে। আমি চকিঘাটে গেলাম। চকিঘাট থেকে তিনি দৌলতখাঁ গেলেন। চারদিকে হাজার হাজার লোক।
প্রেসিডেন্টের গাড়িতে ছিলেন সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক; আর ছিলেন গভর্নর আহসান। আমাকে প্রথমে ঘটনাস্থলে যেতে দিতে চাইছিলেন না। মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তাদের দাবির মুখে আমাকে যেতে দেওয়া হয়। পরে সাহেবজাদা ইয়াকুব খান আমাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বললেন- `হি ইজ মিস্টার তোফায়েল আহমেদ।` জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন, `হু ইজ তোফায়েল? স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল!` তিনি বললেন, `ইয়েস; স্টুডেন্ট লিডার তোফায়েল।`
ইয়াহিয়া খান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, `তোমাদের জন্য কী করতে পারি?` বলেছিলাম, প্রেসিডেন্ট, দুর্গত এলাকায় এসেছেন ঘটনার ১৪ দিন পর। আপনি এখনও নদীতে ভাসমান ও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের মৃতদেহ দেখতে পাবেন।
তিনি বললেন, `আমার পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।` বললাম, আমি কেন ঘোষণা দেব? তখন প্রবেশনারি অফিসার সাদাত হুসাইন, যিনি পরে কেবিনেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন; ঘোষণা করলেন- `পাকিস্তানের মহামান্য প্রেসিডেন্ট আপনাদের জন্য ২৫ হাজার টাকা সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ করেছেন।` সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনসাধারণ চিৎকার দিয়ে উঠল :`না- না- না।`
আমার নির্বাচন হয় ১৭ জানুয়ারি `৭১-এ। ফল ঘোষণার পর জানলাম, ৭২ হাজার ভোট পেয়েছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ৬ হাজার ভোট। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম যান ভোলা। `৭০-এ তিনি দেখে এসেছিলেন জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত ভোলা। যে জায়গায় বেড়িবাঁধ ছিল না, সেই স্থানকে জিরো পয়েন্ট বলতাম আমরা।
সেখান দিয়েই প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করেছে এবং নিমেষের মধ্যে সব তলিয়ে গেছে। ভোলা গিয়ে সেই জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু মাটি কেটেছেন এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। ভোলা থেকে তিনি রামগতি গিয়েছেন এবং সেখানেও তিনি বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্বোধন করেছেন। আজকে বেড়িবাঁধ দিয়ে আমরা জলোচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। ঘূর্ণিঝড় হলে আমরা এখন সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ করি।
আগে এই সাইক্লোন শেল্টারকে বলা হতো `মুজিব কেল্লা`। এটা বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু চর কুকরী-মুকরী গেছেন; সেখানে সাইক্লোন শেল্টার করেছেন। সেখানে জনসাধারণকে ডিপ টিউবওয়েল দিয়েছেন; বনায়ন করেছেন।
জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর জন্য উপকূলীয় এলাকায় বঙ্গবন্ধু বনায়ন করেছিলেন, যেটা আজকে ফরেস্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ভোলাকে খুব পছন্দ করতেন। মনপুরায় তিনি `চিন্তানিবাস` নামে একটি আবাসস্থল করতে চেয়েছিলেন। তার কাজও শুরু হয়েছিল।
বসরতউল্লাহ সাহেব একটি দীঘি কেটে মাটি ভরাট করে এই কাজটি শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি মার্শাল টিটো একটা দ্বীপে থাকতেন। দ্বীপটার নাম ছিল ‘বিরুনি’। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধু মনে করলেন- আমার ভোলায় অনেক দ্বীপ।
একটা দ্বীপে আমি এ রকম একটা আবাসস্থল করব, যেখানে বিদেশিরা গেলে তাদের সঙ্গে মিটিং করব। কিন্তু তিনি এটা করে যেতে পারেননি। মনপুরায় অবকাশ যাপন কেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। `৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সবকিছু স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি পোস্টার হয়েছিল `সোনার বাংলা শ্মশান কেন?` এই পোস্টারটিতে `৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের কথাই ব্যক্ত হয়েছিল। দুটি ঘটনা বাংলার মানুষকে পথ দেখিয়েছে। এক. `৬৫-এর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ। যখন আমরা ছিলাম `অরক্ষিত`। আর `৭০-এর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস; যখন আমরা ছিলাম `অসহায়`। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছিলেন; তার মূল লক্ষ্য ছিল শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
সেই দায়িত্বটা এখন বর্তেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্কন্ধে। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রতি বছর আগে বাংলাদেশে লাখ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করত, ঘরবাড়ি হারাত। সেসব এখন আর নেই। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশে এখনও প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আগে হতো, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গৃহীত পদক্ষেপের কারণে আগের মতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এটাই হলো স্বাধীনতার সফলতা।
আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার tofailahmed69@gmail.com
এমএইচ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।