স্মৃতি বহন করে বাহাদুর শাহ পার্ক
প্রকাশিত : ২৩:২০, ২৭ জুলাই ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৩৮, ২০ আগস্ট ২০১৮
পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্কটি সিপাহী বিপ্লবের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে আছে। ইংরেজ শাসন-শোষণের ইতিহাস ও বর্বরতা এবং স্বাধীনচেতা সেনাদের আত্মত্যাগের সাক্ষী এ বাহাদুর শাহ পার্ক। পার্কটি ঢাকার সদরঘাট এলাকার প্রবেশমুখে লক্ষ্মীবাজারের মাথায় অবস্থিত। পার্কটিকে ঘিরে ৭টি রাস্তা একত্রিত হয়েছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে ইংরেজরা। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ইংরেজদের শোসন নিপিড়ণ বন্ধের প্রশ্নে অসংখ্যবার বিদ্রোহ করে বাংলার স্বাধীনতাকামি বাংলার জনগণ। তেমনি একটি বিদ্রোহ হলো ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব। ১৮৫৭ সালে সম্রাট বাহাদুর শাহকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ হয়।
ইংরেজ মেরিন সেনারা বাংলার সেনাদের নিরস্ত্র করার জন্য ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বরে ঢাকার লালবাগ কেল্লায় আক্রমণ চালায়। স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী সৈন্যরা তাতে বাধা দিলে যুদ্ধ বেধে যায়। আহত ও পলাতক সেনাদের গ্রেফতার করা হয়। পরে এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ সামরিক আদালতে ১১ বিপ্লবীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে বাহাদুর শাহ পার্কে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। পরে জনগণকে বিদ্রোহ না করার জন্য ভীতি প্রদর্শন করাতে লাশগুলো গাছে টাঙ্গিয়ে প্রদর্শন করা হয়। ইংরেজদের এই নিষ্ঠুর কার্যকলাপ ও সেনাদের আত্মত্যাগের সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে চলেছে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক।
আঠার শতকের শেষের দিকে পুরান ঢাকায় আর্মেনীয়রা বিলিয়ার্ড ক্লাব তৈরি করে। যেটি স্থানীয়দের কাছে আন্টাঘর নামে পরিচিত ছিল। ক্লাব ঘরের সঙ্গেই ছিল একটি মাঠ যেটিকে বলা হতো আন্টাঘর ময়দান। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার নেওয়ার পর মাঠ সংক্রান্ত একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করার মাধ্যমে এই স্থানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। পরবর্তীতে এ স্থানের নাম ভিক্টেরিয়া পার্ক পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
ঊনিশ শতকে এ পার্কের উন্নয়নে নওয়াব আব্দুল গণির ব্যক্তিগত অবদান ছিল অনেক। তার নাতি খাজা হাফিজুাল্লহর মৃত্যুর পর তার ইংরেজ বন্ধুরা হাফিজুল্লাহর স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদা তুলে ১৮৮৪ সালে এখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে। শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতিরক্ষার্থে উত্তর দিকে একটি সুউচ্চ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। উঁচু বেদির ওপর নির্মিত চার স্তম্ভের গোলাকার আচ্ছাদনে ঘেরা সৌধটি।
পার্কটি ডিম্বাকৃতির এবং লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। পূর্ব এবং পশ্চিম পাশে দুটো প্রধান গেট রয়েছে। পার্কটির ভেতরে রেলিংয়ের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা আছে। পার্কটি ঢাকার অন্যতম প্রধান নৌবন্দর সদরঘাট এলাকায় ঢুকতেই লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত।
পার্কটিকে ঘিরে চারপাশে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বেশ কিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকার কারণে এটি পুরান ঢাকার একটি অন্যতম এলাকা হিসেবে পরিচিত। পার্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরপাশে রয়েছে সেন্ট থমাস চার্চ, একই পাশেই অবস্থিত ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি পানির ট্যাংক। উত্তর-পূর্ব কোণে আছে ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ইসলামিয়া হাইস্কুল, পূর্ব পাশে রয়েছে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারি মুসলিম হাইস্কুল। ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশেই রয়েছে ঢাকার জজকোর্ট। এছাড়া, বাংলা বাজার, ইসলামপুর, শাঁখারী বাজার থেকে বর্তমান ঢাকার নতুন এলাকায় আসতে এ পার্ক এলাকার রাস্তাটি প্রধান সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৬১ অনুযায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনাভুক্ত স্থাপনা হিসেবে ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিবেচনায় বাহাদুর শাহ পার্ককে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু পার্কের উত্তরের রাস্তায় ডাস্টবিন, ময়লার ছড়াছড়ি। উত্তর-দক্ষিণের ফুটপাতে দোকান এবং রিকশার জট। নষ্ট হচ্ছে পার্কের সৌন্দর্য। পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখা হয়। পূর্ব দিকেরটা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে।
এখানে স্থানীয়ভাবে প্রাতঃভ্রমণকারী সংঘ গড়ে তোলা হয়েছে। এ সংঘের সদস্যরা সকাল, বিকেল এবং সন্ধ্যায় শারীরিক ব্যায়াম করেন। এছাড়া, নানা পেশা ও চাকরিজীবী, পথচারী, ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণের নিত্যপদচারণা রয়েছে কালের সাক্ষী এ পার্কে।
পার্কে প্রবেশের জন্য কোন টিকিট কাটতে হয় না। এখনে সব জনসাধারণ প্রবেশ করতে পারে। ঢাকার যে কোন স্থান হতে সদরঘাটগামী বাস, সিএনজি, মোটরবাইক ও রিকশাযোগে আসা যায়।
এসএইচ/