সৎকর্মই মানুষকে অনন্য মানুষে উন্নীত করে
প্রকাশিত : ১৮:০৯, ৪ মে ২০১৯
সৎকর্ম বা ‘আমলে সালেহ’ এর গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ স্বভাবতই খাওয়া দাওয়া ভোগবিলাস ও প্রকৃতির চাহিদা পূরণে ঘূর্ণায়মান চক্রে আবর্তিত হয়। এমতাবস্থায় একজন মানুষের জীবন যাপনকে একটি পশুর জীবন যাপন থেকে আলাদা করা যায় না। আমলে সালেহ বা সৎকর্ম মানুষকে জৈবিক চক্রে আবর্তিত হয়ে পশুর মত জীবন যাপন করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। সৎকর্ম মানুষকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বের করে জনকল্যাণের রাজপথে নিয়ে আসে। সৎকর্মই সাধারণ মানুষকে অনন্য মানুষে উন্নীত করে।
১. সৎকর্মের মাধ্যমে মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিপূর্ণতা পায়:
যে কোন আবিষ্কার বা সৃষ্টি তখনই সার্থকতা লাভ করে যখন তার মাধ্যমে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। টেলিভিশন বানানো তখনই সার্থক হয় যখন তার মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখা সম্ভব হয়। আম গাছ লাগানো তখনই সার্থক হয়, যখন তাতে আম ধরে। নৌকা বানানো তখনই সার্থক হয় যখন তাতে আরোহন করে পানির উপরে যাতায়ত করা যায়। মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য তখনই সার্থক হয় যখন সে সৎকর্ম করে, কেননা মানুষকে সৎকর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা মুলক (১-২) এ ঘোষণা করেন, ‘তিনি মহিমান্বিত যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। যিনি সর্বশক্তিমান। তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যে কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম। তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশালী।’ অর্থাৎ একমাত্র সৎকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিপূর্ণতা লাভ করে।
২. সৎকর্ম অমরত্ব দান করে:
মানবজীবন লক্ষ কোটি মুহূর্তের সমষ্টি। যে মুহূর্তটি জীবন থেকে চলে যায় তা আর কখনই ফিরে আসে না। ব্যবসার পুঁজি হলো টাকা পয়সা। টাকা পয়সা খরচ না করে মাটির নিচে পুতে রাখলে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর টাকা পয়সা খরচ করলে মুনাফা বাড়বে। মানবজীবন হলো পুঁজির সময়। তাই যেটুকু সময় সৎকর্মে ব্যয় হবে তাই ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে যাবে এবং চিরস্থায়ী প্রবৃদ্ধির অংশ হয়ে যাবে। আর যতটুকু সময় সৎকর্মে ব্যয় না করে শুধু নিজের স্বার্থে, ভোগ বিলাসে বা শুধু ক্ষমতার বাহাদুরী দেখানোর উদ্দেশ্যে বা শুধু আত্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যয় হবে তা বস্তুবাদী দৃষ্টিকোন থেকে সুখকর স্মৃতির সঞ্চয় হিসাবে জমা থাকলেও সত্যিকার অর্থে খরচের খাতায় চলে যাবে ও কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ সুরা আল আসর’এ (১-৩) বলেন, ‘যুগের বা কালের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতিতে নিমজ্জিত কিন্তু তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে ও ধৈর্য্যরে উপদেশ দিয়েছে।’
মোট কথা প্রশান্তি প্রত্যয়, সৃষ্টার প্রতি অবিচল বিশ্বাস, সৎকর্ম, সত্যের প্রতি আহবান, ধৈর্য্য ও সৎসঙ্গ মানুষকে কালের ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারে-দিতে পারে অন্তহীন সফলতা।
৩. সৎকর্ম সর্বোত্তম পাথেয়:
মানুষের জীবন নিরবচ্ছিন্ন যার একটি অংশ পৃথিবীর জীবনে আর অন্য অংশ মৃত্যুর পর পরজীবনে বিস্তৃত। তাই বুদ্ধিমান মানুষের এমন কাজ করা উচিত যার ফসল যে মৃত্যুর পরও তুলতে পারবে। সৎকর্ম এমন এক বিনিয়োগ যার ফল মানুষ মুত্যুর পরও ভোগ করতে পারে।
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘বন্ধু তিন ধরনে। এক ধরনের বন্ধু তোমাকে বলে-তুমি কবরে যাওয়া পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকবো (এ হলো মানুষ বন্ধু)।
দ্বিতীয় ধরনের বন্ধু তোমাকে বলে, তুমি গরিব লোককে যা দান করেছো সেটুকুই তোমার অংশ আর যা তুমি দান করোনি বরং নিজের কাছে রেখেছো তা তোমার নয় বরং তোমার উত্তারাধিকারীদের (এ হচ্ছে তোমার সম্পদ)।
তৃতীয় ধরনের বন্ধু তোমাকে বলে, তুমি যেখানে প্রবেশ করবে অর্থাৎ কবরে এবং কবর থেকে বেরিয়ে যেখানেই তুমি যাবে, সেখানেই তোমার সঙ্গে থাকবো। এ বন্ধুর নাম হচ্ছে ‘আমল’ বা সৎকর্ম।’
মানুষ অবাক হয়ে আমলকে বলবে আল্লাহর শপথ, আমি তিন বন্ধুর মধ্যে তোমাকেই হীন ও অতি সাধারণ মনে করতাম। অর্থাৎ সৎকর্মই মানুষের সর্বোত্তম ও স্থায়ী পাথেয়। অথচ এটিকেই মানুষ অবহেলা আর অবজ্ঞা করে।
৪. সৎকর্ম মানুষকে অনন্য মানুষে উন্নীত করে:
বস্তুর উপর যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ক্রিয়াশীল থাকে তেমনি মানুষের উপর প্রবৃত্তির শক্তি ক্রিয়াশীল। মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলেও সে কার্যত স্বাধীন থাকে না, প্রবৃত্তির হাতে বন্দী হয়ে যায় ও লাগামহীন চাওয়া পাওয়ার নেশায় বুদ হয়ে যায়। সে প্রবৃত্তির চাহিদা বা জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রবৃত্তির চাহিদা যত পূরণ করা হয় ততো তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরিণামে সে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সীমালঙ্ঘন করে। একমাত্র মুক্ত বিশ্বাস, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির লালন ও সৎকর্ম মানুষকে জৈবিকতার ক্ষুদ্র চাওয়ার শৃংখল থেকে মুক্ত করে এবং ভোগ করার আনন্দকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে নিঃস্বার্থ সেবার স্বর্গীয় আনন্দে রূপান্তরিত করে। ফলে মানুষ প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বের হয়ে উন্নত হয় অনন্য মানুষের স্তরে।
আল্লাহ সূরা তীন (৪-৬) এ বলেন, ‘তীন, যায়তুন ও সিনাই প্রান্তরে অবস্থিত তুরের কসম। আর এই নিরাপদ নগরীর কসম। আমি তো সৃষ্টি করিয়াছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে। অতঃপর আমি উহাকে হীনতাগ্রস্তদের হীনতমে পরিণত করি কিন্তু তাহাদিগকে নহে যাহারা বিশ্বাসী ও সৎকর্ম পরায়ন। ইহাদের জন্য তো আছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।’
৫. সৎকর্ম নফল ইবাদাতের চাইতেও উত্তম:
আমাদের দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের কথা বলা হলেই এমন একদল লোকের চেহারা মানসপটে ভেসে উঠে যারা রাতদিন নামায, রোযা, তসবীহ তাহলীল, কোরান তেলাওয়াত ও দোয়া দরূদে ব্যস্ত থাকেন এবং সমাজ সেবামূলক ও সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত হবার সময় পান না। তারা মনে করেন, শুধুমাত্র নামায রোযা তসবীহ তাহলীল করার মাধ্যমে তারা বেশি সওয়াব অর্জন করতে পারবেন ও বেশি বেশি আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করে পরকালে সাফল্যের উচ্চ শিখারে পৌঁছে যেতে পারবেন। যারা মানুষের সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় রাত দিন ব্যস্ত থাকে তাদেরকে বলা হয় দুনিয়াদার অর্থাৎ আখেরাতে তাদের কোন অংশ নেই। বিষয়টি মোটেও তেমন নয়।
৬. সৎকর্ম স্রষ্টাকে পাওয়ার হাইওয়ে:
আল্লাহ তায়ালা কারো মুখাপেক্ষি নন এবং অভাবশূণ্য। তাকে রাতদিন ডাকার জন্য অগণিত ফেরেশতা আছেন। তাই তসবীহ তাহলীল পাঠ করার মাধ্যমে মানুষ ফেরেশতাকে অতিক্রম করতে পারবে না। সমস্ত জাগতিগ কাজকর্ম বাদ দিয়ে শুধু রাতদিন ডাকলেও স্রষ্টাকে ভালোবাসেন। যখনই কেউ আল্লাহ সৃষ্টিকে ভালোবাসবে আল্লাহ তাকে ভালোবাসবেন।
৭. সৎকর্ম শ্রেষ্ঠ সম্পদ:
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এই পৃথিবীর জীবনই সবকিছু। এরপর অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোন জীবন নাই। এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা সাবাই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে টাকা পয়সা, জমিজমা, সন্তানসন্ততিকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মনে করি। প্রকৃত সত্য হলো মানবজীবন নিরবচ্ছিন্ন। দুনিয়ার জীবন একটি অধ্যায় এবং পরজীবন অপর একটি অধ্যায়। পরকালীন বিশাল জীবনের তুলণায় পৃথিবীর জীবনের সমস্ত অর্জন একটি মাছির ডানার চাইতে বেশি মূল্যবান নয়। প্রকৃত পক্ষে তাকেই সম্পদ বলা উচিত যা শুধুমাত্র ইহকালে নয় বরং ইহকাল ও পরকালে মানুষকে সুখ দেবে। সৎকর্ম এমন এক সম্পদ যা সর্বাবস্থায় মানুষের সাথে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা সুরা কাহাফ’এ (৪৬) বলেন, ‘ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা এবং সৎকর্ম যার ফল স্থায়ী তা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা লাভের জন্য উত্তম।’
সূত্র- ‘সৎকর্ম: প্রাশান্তি ও প্রাচুর্যের সোপান’ -ডা. আহমদ মরতুজা চৌধুরী
এমএস//