৪ দশক দলের সভাপতি হাসিনা
হাঁটেননি খালেদা, সনিয়াদের পথে
প্রকাশিত : ১১:৪০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২
গত অক্টোবরে ভারতের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। ২৪ বছর পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে বসেছেন গান্ধী পরিবারের বাইরের মানুষ মল্লিকার্জুন খাড়্গে। আগের ২৪ বছরের মধ্যে দু-দফা মিলিয়ে প্রায় ২২ বছর সভাপতি ছিলেন গান্ধী পরিবারের বধূ সনিয়া। বাকি দু’ বছর ছিলেন তাঁর পুত্র রাহুল।
শাসক দল বিজেপি গান্ধী পরিবারকে নিশানা করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্র কায়েমের অভিযোগে লাগাতার সরব না হলে অশীতিপর মল্লিকার্জুন খাড়্গে কংগ্রেসের সভাপতি হতেন কিনা সংশয় আছে। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে পরাজয়ের দায় নিয়ে সরে যাওয়া রাহুল গান্ধীই ফের সভাপতি হবেন। এক-দু’জন বাদে দলের সকলে সেটাই চাইছিলেন।
বিজেপি সরব না হলে রাহুলের জায়গায় হয়তো এতদিনে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও সভাপতি হয়ে যেতেন। তাঁকে সভাপতি করার দাবিও দীর্ঘদিনের। ২০১৭-তে রাহুল সভাপতি হয়েই বোন প্রিয়ঙ্কাকে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন। সনিয়া দলের কথায় রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু রাহুল, প্রিয়ঙ্কাদের রাজনীতিতে এনে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেওয়াটা ছিল একেবারে তাঁর ব্যক্তিগত হুকুমদারী।
ভারতের শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেসের নেতৃত্ব বদলের প্রসঙ্গ মনে এল আজ বাংলাদেশের ৭৩ বছর বয়সী দল আওয়ামী লিগের ২২ তম সম্মেলন উপলক্ষ্যে। ভারতের কংগ্রেসের মতো আওয়ামী লিগও সবচেয়ে পুরনো দল এবং দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার কৃতিত্ব আছে তাদেরও। উপ মহাদেশে তারা একমাত্র দল যারা দেশকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছে।
শেখ হাসিনার সেই দলের সভাপতি হওয়ার কাহিনি উপমহাদেশের কারও অজানা নয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা পরবর্তী অস্থির পরিস্থিতি, অরাজকতা, নিরাপত্তাহীনতার কথা বিবেচনায় রেখে কংগ্রেসের নেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে ভারতে বছর ছয় থেকেছিলেন মুজিব কন্যা। ভারতে থাকাকালেই আওয়ামী লিগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। যা একই সঙ্গে নজির ও সম্মানের। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যাই আওয়ামী লিগের সভাপতি, টানা ৪১ বছর। যে নজির কমই আছে। আজ শেখ হাসিনার পুনরায় সভাপতি হওয়াও সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে।
হাসিনা শুধু দলের শীর্ষ পদে থাকাতেই নয়, বাংলাদেশে রেকর্ড গড়ে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। বিগত কয়েকটি সম্মেলনের মতো এবারও এপারে চর্চা আছে দল ও সরকারে মুজিব কন্যার উত্তরসূরি কে? ২২তম সম্নেলনে থেকে এই দুই বিষয়ে কোনও আভাস মেলার প্রশ্ন ওঠে না, জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাঁর কথায়, শেখ হাসিনা আওয়ামী লিগ এবং বাংলাদেশের ঐক্য ও প্রগতির প্রতীক।
বাংলাদেশের অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির চেয়ারপারসন পদে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও আছেন টানা ৩৭ বছর। বেশ কিছু বছর যাবৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ।
সনিয়ার কথায় ফিরি। শাশুড়ি ইন্দিরা এবং স্বামী রাজীব আততায়ির হাতে নিহত হওয়ার পর আচমকাই কংগ্রেস নেত্রীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বদলে গিয়েছিল গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ায়। সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে বলতে গেলে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন রাজীব পত্নী।
অন্যদিকে, শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হওয়ার পর বিদেশ সফরে থাকা কন্যা শেখ হাসিনাও অকুলপাথাড়ে পড়েন। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ান ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা আর বঙ্গবন্ধুর লড়াইয়ের স্মৃতিকে পুঁজি করে।
সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল রাজনীতিতে খালেদার অভিষেক। সামরিক প্রশাসক থেকে রাজনৈতিক দল গড়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব হাতে নেন খালেদা। রাজনীতি, গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দূরে থাক, কোনও সম্পর্কই যাঁর ছিল না।
লক্ষণীয় হল, হাসিনা ও সনিয়া দলের ইচ্ছায়, বস্তুত পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বাকিদের জোরাজুরিতে শীর্ষপদে বসেছেন। শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিঞা তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, ১৯৭৯-৮০ নাগাদ আওয়ামী লিগের বেশ কিছু নেতা দিল্লিতে হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দলের হাল ধরতে আর্জি জানান।
১৯৮১-র গোড়ায় হাসিনা দিল্লিতে বসে দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ পান বিবিসি-র খবর শুনে। ওই বইতেই ওয়াজেদ মিঞা সে বছর ১৭ মে হাসিনার স্বদেশের মাটিতে পা রাখার দিনটির সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঐদিন বিকেলে ঢাকায় একটু একটু ঝড়বৃষ্টি হয়। যাহোক, ঢাকায় পৌঁছেই রাত এগারোটার দিকে হাসিনা আমাকে টেলিফোনে জানায় যে, সেদিন সভাস্থল মানিক মিয়া এভিনিউ হতে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ছিল লোকে লোকারণ্য।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ঐদিন তাকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্য ১০-১২ লাখ লোকের সমাগম হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সূত্রে বলা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মতে, ওই দিন ঢাকায় অন্যূন ১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল।’
৭৩ বছর বয়সী দল আওয়ামী লিগে শেখ হাসিনার মতোই শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের দীর্ঘতম সময় সভাপতি পদে থাকার রেকর্ড সনিয়া গান্ধীর দখলে। তবে অমিলের জায়গাটি হল, সনিয়া যেভাবে রাহুল ও প্রিয়ঙ্কাকে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন, হাসিনা সে পথে হাঁটেননি। পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় এবং মেয়ে সাইমা ওয়াজেদ পুতুলকে আওয়ামী লিগের সাংগঠনিক কোনও পদে বসাননি তিনি। সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্তও নন তাঁরা।
সর্বদা দিদির পাশে থাকলেও বোন রেহানাও সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেননি। সজিব বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা। গোটা বিশ্বে প্রশংসিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কৃতিত্ব অনেকটাই তাঁর। আর সাইমা হলেন শিশু স্নায়ু বিশেষজ্ঞ। অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন তিনি।
অন্যদিকে, রাজনীতিতে হাসিনার প্রধান প্রতিপক্ষ খালেদা নিজের দলের সভাপতি আর কার্যনির্বাহী সভাপতির পদে বসিয়েছেন পুত্র তারেক রহমানকে। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক বর্তমানে লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদাও। যিনি আপাতত গৃহবন্দি।
(লেখক: কলকাতার দ্যা ওয়াল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক।)
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।