ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:০৬, ২৩ মে ২০২০

পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে। 

প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে। চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। 

পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। নবম পর্বে জেনেছেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান। দশম পর্বে আপনারা জেনেছেন বিপর্যয় থেকে বিজয়ে উত্তরণের কাহিনী। এবার একাদশ পর্বে আপনারা জানবেন- হাজার বছরের শোষণের অবসান ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের বিবরণ।

ওহুদের যুদ্ধের পর নবীজী অনুধাবন করলেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা বংশানুক্রমিক অভ্যাসের বৃত্ত ভাঙতে হলে জীবনে সর্বমুখী শৃঙ্খলা আনতে হবে। তাহলেই অনুসারীরা ভারসাম্যপূর্ণ অর্থবহ জীবনের স্বাদ পাবে। ইবাদত, কাজ ও পরিবারকে দেয়া সময়ের সুসমন্বয়ের মাধ্যমেই কাটাতে হবে দিন। তাই করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে থাকতে হবে সুস্পষ্ট ধারণা। চেতনার বাস্তব প্রকাশ ঘটাতে হবে কর্মে। এজন্যে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে জীবনের মৌলিক দিকগুলো নিয়ে নাজিল হতে থাকল একের পর এক নির্দেশনা।

সুদ নিষিদ্ধ, দাস-শ্রমিকের শোষণ প্রক্রিয়ার অবসান: 
১. পুঁজিবাদী বেনিয়া নিষ্পেষণের মূল অস্ত্র ঋণ-ক্ষুদ্রঋণ। নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক সাধারণ মানুষকে বিয়ে, শ্রাদ্ধ ও নানা সামাজিকতায় ধুমধাম ও অপচয়ে প্ররোচিত করে বেনিয়া মহাজনেরা ঋণ নিতে মানসিকভাবে বাধ্য করত। ঋণের সুদের হার থাকত চড়া, বর্তমান ক্রেডিট কার্ডের মতো। তারপর চক্রবৃদ্ধি হারে। ঋণের কিস্তি দিতে দিতেই খাতকের অর্থাৎ ঋণগ্রহীতার জীবন শেষ। চক্রবৃদ্ধির ফাঁদে পড়ে বা ফসল ফলন বা আয় না হলে এই ঋণ তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব হতো না। প্রথমে সে জায়গাজমি, সহায়সম্বল বিক্রি করে ঋণশোধ করার চেষ্টা করত। তাতেও না হলে তখন সে বাধ্য হতো মহাজনের বাড়িতে, বাগানে, কারখানায় দাস শ্রমিক (Bonded Labour) হিসেবে কাজ করতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা বংশানুক্রমিকভাবেই দাস শ্রমিকে পরিণত হতো। মিশর, গ্রিস, রোম, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, ভারত, চীন সর্বত্র ছিল এই অবস্থা।

ঋণের এই জাঁতাকল থেকে মুক্তির জন্যে কোরআন সুদ নিষিদ্ধ করল। সুদখোরদের ‘শয়তানের স্পর্শে সহজাত বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষ’ বলে ঘোষণা করল। ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না। বরং তোমরা আল্লাহ-সচেতন হও। তাহলেই তোমরা সফলকাম ও সুখী হবে।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩০)। 

‘যারা সুদ (রিবা) খায় তাদের অবস্থা হচ্ছে শয়তানের স্পর্শে সহজাত বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়া ব্যক্তির মতো। এজন্যেই তারা বলে ব্যবসা তো সুদের মতোই, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যার নিকট তার প্রতিপালকের বিধান পৌঁছেছে এবং সুদ খাওয়া থেকে বিরত থেকেছে, তার অতীতের বিষয় সম্পূর্ণতই আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু যারা বিধান জানার পরও সুদ খেতে থাকবে, জাহান্নামই হবে তাদের নিবাস। সেখানেই থাকবে তারা চিরকাল। সুদি অর্থ আল্লাহর রহমত থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত থাকে আর সৎদান তাঁর অনুগ্রহসিক্ত হয়ে বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়। যারা অকৃতজ্ঞ এবং ক্রমাগত পাপে লিপ্ত, আল্লাহ তাদের অপছন্দ করেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫-২৭৬)

‘হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ-সচেতন থেকো। সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি সত্যি সত্যি তোমরা বিশ্বাসী হয়ে থাকো। যদি তোমরা সুদ না ছাড়ো তবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা করো এবং সুদ পরিত্যাগ করো তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই প্রাপ্য হবে। তোমরা জুলুম কোরো না এবং তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না। যদি খাতক অভাবী হয়, তবে সচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত তাকে ছাড় দাও। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরো কল্যাণের, যদি তোমরা তা জানতে!’ (সূরা বাকারা: ২৭৮-২৮০)

নবীজী মুক্ত মানুষকে দাস শ্রমিক বানানোর এই শোষণ প্রক্রিয়ার অবসানে বাস্তব পদক্ষেপ নেন। তিনি সুদ খাওয়াকে মায়ের সাথে ৭০ বার জেনা (অর্থাৎ অবৈধ যৌনাচার) করার সমান অপরাধ বলে ঘোষণা করেন।

কল্যাণ-সমাজ ও সামাজিক সুবিচার
২. নতুন কল্যাণ-সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কোরআনের নির্দেশের আলোকে নবীজী বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ‘হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহর বিধানকে অনুসরণ করো এবং সত্যের সাক্ষ্যদানে অবিচল থেকো। কারো প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাকে সুবিচার থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো পাপে নিমজ্জিত না করে। সবসময় ন্যায়বিচারে দৃঢ় থাকবে- এটাই আল্লাহ-সচেতনতার ফলিত রূপ। তাই সবসময় আল্লাহ-সচেতন থেকো। ...’ (সূরা মায়েদা : ৮)

‘তারা তোমাকে প্রশ্ন করবে, আমরা অন্যের জন্যে কী প্রক্রিয়ায় ব্যয় করব? (হে নবী!) তুমি বলো, তোমাদের অর্থসম্পত্তি প্রথমত মা-বাবা, তারপর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবী ও মুসাফিরদের জন্যে ব্যয় করবে। তোমরা যে সৎকর্মই করো না কেন, আল্লাহ তা সবই জানেন। (সূরা বাকারা : ২১৫)

পারিবারিক মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য
সূরা বনি ইসরাইলে পারিবারিক মানবিক সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্যকে, করণীয়-বর্জনীয়কে আরো সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পরিষ্কারভাবে বলা হয়- ‘আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, (এক) তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করবে না। (দুই) বাবা-মার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তোমার জীবদ্দশায় তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবুও তাদের ব্যাপারে ‘উহ-আহ’ কোরো না, তাদের ধমক দিও না বা অবজ্ঞা কোরো না, তাদের সাথে আদবের সাথে কথা বলো। (তিন) আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রাপ্য অধিকার দেবে এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরের হকও আদায় করবে। (চার) তোমরা সম্পত্তির অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি চূড়ান্ত অকৃতজ্ঞ। (পাঁচ) নিজেই প্রতিপালকের অনুগ্রহ-সম্পদ অনুসন্ধানরত ও তাঁর কাছে প্রত্যাশী হওয়ার কারণে (অর্থাৎ নিজেই অভাবগ্রস্ত হওয়ার কারণে) যদি কোনো সাহায্যপ্রত্যাশীকে সাহায্য করতে না পারো, তবে তার সাথে সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলো (সদুপদেশ দিও)।

(ছয়) ব্যয়ের ক্ষেত্রে কৃপণ হয়ো না বা অন্যকে সাহায্য করতে অনিচ্ছুক হয়ো না। আবার ব্যয়ের ক্ষেত্রে মুক্তহস্ত হয়ে (তোমরা সামর্থ্যের) সীমা ছাড়িয়ে যেও না। যদি করো, তাহলে তুমি নিন্দিত বা নিঃস্ব হবে। মনে রেখো, তোমার প্রতিপালক যাকে ইচ্ছা পর্যাপ্ত জীবনোপকরণ দেন, যাকে ইচ্ছা সীমিত জীবনোপকরণ দেন। অবশ্যই তিনি বান্দাদের প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন এবং তাদের সবকিছুই দেখেন। (সাত) তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা কোরো না। তোমাদের ও তোমাদের সন্তানদের রিজিকদাতা আমিই (জীবনোপকরণ আমিই দিয়ে থাকি)। নিশ্চয়ই সন্তান (ভ্রূণ) হত্যা মহাপাপ। (আট) তোমরা জেনার (ব্যভিচার, পরকীয়া বা অবৈধ যৌনাচারের) কাছেও যেও না। এটা অশ্লীল ও জঘন্য পাপাচার। (নয়) ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা কোরো না। কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে ‘কিসাস’ (ন্যায়সঙ্গত বদলা) দাবি করার অধিকার দিয়েছি।

কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে। আর মনে রেখো, (যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে) সে-তো (আল্লাহর কাছ থেকে) সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছেই। (দশ) উন্নয়নের লক্ষ্য ছাড়া এতিমের সম্পত্তির কাছেও যাবে না। এতিম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর (তার সম্মতিক্রমে সম্পত্তিকে কাজে লাগাতে পারো)। (এগারো) ওয়াদা রক্ষা করবে। ওয়াদা ভঙ্গ করলে তোমাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। (বারো) ওজনে কখনো কম দেবে না (জীবনের যে-কোনো ধরনের লেনদেন হোক না কেন)। সঠিক মানদণ্ডে ওজন করে পুরো প্রাপ্য দেবে। এতে তোমারই মঙ্গল হবে এবং শুভপরিণাম বয়ে আনবে। তেরো) যে-বিষয়ে তোমার যথাযথ জ্ঞান নেই, সে-বিষয়ে (শুধু শোনা কথায় আন্দাজ-অনুমানের ওপর ভিত্তি করে) কখনো নিজেকে জড়াবে না। (মহাবিচার দিবসে) তোমার কান, চোখ ও মনকে জবাবদিহিতার জন্যে ডাকা হবে। (চৌদ্দ) দম্ভভরে (বক্ষ স্ফীত করে) মাটিতে পা ফেলবে না। তুমি তোমার পদভারে কখনো জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, পারবে না উচ্চতায় পর্বতকে অতিক্রম করতে। (অর্থাৎ চালচলনে বিনয়ী হবে।) এই (চৌদ্দটি) আদেশের মধ্যে যে পাপাচার করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা তোমার প্রতিপালকের কাছে অতিঘৃণ্য। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩, ২৬-৩৮)

মাদক পুরোপুরি বর্জনের নির্দেশনা
৩. জাহেলি যুগের সংস্কার, অভ্যাস ও আসক্তি পরিত্যাগ করে শুদ্ধ জীবনাচার অনুসরণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। শুদ্ধ জীবনের জন্যে মাদকও পুরোপুরি বর্জন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। ‘হে বিশ্বাসীগণ! নিশ্চয়ই মাদকদ্রব্য, জুয়া, মূর্তি ও ভাগ্যনির্ণায়ক তীর বা পাশা নাপাক ঘৃণ্য বস্তু এবং শয়তানের হাতিয়ার। অতএব তোমরা তা পুরোপুরি বর্জন করো, যাতে তোমরা সফল পরিতৃপ্ত হতে পারো। শয়তান তো মাদক (অর্থাৎ মদসহ সকল নেশাকারক দ্রব্য) ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়। এরপরও কি তোমরা এসব ঘৃণ্য বস্তু থেকে নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা মায়েদা : ৯০-৯১)

বিয়ে ও দাম্পত্য জীবনে নারীর সুবিচার, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার
৪. বিয়ে ও দাম্পত্য জীবনে নারী যাতে পরিপূর্ণ সুবিচার পায় তা নিশ্চিত করা হয়। সম্পত্তির ক্ষেত্রেও নারীর অধিকারকে সুস্পষ্ট রূপ দেয়া হয়। কোরআন প্রথম ধর্মগ্রন্থ যাতে সম্পত্তিতে নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এছাড়া বিয়ের সার্বজনীন নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। ‘নারীর যত্ন নেয়ার পুরো দায়িত্ব পুরুষের। আল্লাহ পুরুষকে যে অতিরিক্ত অনুগ্রহ-সম্পদ ও আর্থিক সামর্থ্য দিয়েছেন তা দিয়ে সে নারীর পুরো যত্ন নেবে। আর সৎকর্মশীল নারীরা আল্লাহর সত্যিকারের অনুগত এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন, লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। স্ত্রী যদি দাম্পত্য দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে চায়, তবে তাদের সাথে অন্তর খুলে কথা বলো (যাতে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়)। (অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে) বিছানায় তাদের একা থাকতে দাও (তাদের স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকো)। (এরপর তারা চাইলে) বিছানায় তাদের সাথে মিলিত হও। আর পরিস্থিতি শুধরে গেলে তাদের কষ্ট দেয়ার জন্যে বাহানা খুঁজবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, মহান (তোমাদের সবার ওপরে কর্তৃত্ববান)।’ (সূরা নিসা : ৩৪)

‘পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে পুরুষের অংশ আছে এবং পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে। তা অল্প হোক বা বেশি, এ অংশ আল্লাহ নির্ধারিত।’ (সূরা নিসা : ৭)

বিবাহ নিষিদ্ধ এমন সম্পর্কের ব্যাপারে নির্দেশনা
যাদের সাথে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়: ‘তোমাদের জন্যে বিয়ে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা, মেয়ে, বোন, ফুফু, খালা, ভাইয়ের মেয়ে, ভাগিনী, দুধ-মা, দুধ-বোন, শাশুড়ি ও তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যার সাথে সহবাস হয়েছে তার আগের স্বামীর ঔরসে তার গর্ভজাত মেয়েরা, যারা তোমার কাছে লালিতপালিত হচ্ছে তাদের সাথে। তবে যদি তাদের মায়ের সাথে সহবাস না হয়ে থাকে, তবে তাদের সাথে তোমাদের বিয়েতে কোনো দোষ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদের এবং একসাথে দু-বোনকে বিয়ে করাও তোমাদের জন্যে হারাম। ...’ (সূরা নিসা : ২৩)

পারিবারিক জীবনে পারস্পরিক ধনসম্পত্তির ব্যাপারে লোভাতুর না হওয়ার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়: ‘হে বিশ্বাসীগণ! যে-সব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদের একে অপরের তুলনায় অতিরিক্ত অনুগ্রহ ও সুযোগ-সুবিধা দান করেছেন, তোমরা সে ব্যাপারে লোভাতুর হয়ো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা পুরুষ পাবে, আর নারী যা অর্জন করে তা নারী পাবে। ...’ (সূরা নিসা : ৩২)

সুবিচার করতে না পারলে একটা বিয়েই উত্তম
৫. তৎকালীন সমাজে একসাথে যত ইচ্ছা বিয়ের ব্যাপারে পুরুষদের কোনো বাধা ছিল না। কোরআনে পুরুষদের যত ইচ্ছা বিয়েকে চার বিয়েতে সীমাবদ্ধ করা হয় আর বলা হয়, সুবিচার করতে না পারলে এক বিয়েই উত্তম। ‘আর তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে, এতিম মেয়েদের অধিকার তোমাদের দ্বারা লঙ্ঘিত হতে পারে, তবে পছন্দ অনুসারে অন্য মেয়েদের মধ্য থেকে দুই, তিন বা চার জনকে বিয়ে করতে পারো। তবে যদি আশঙ্কা হয় যে, একাধিক স্ত্রীর সাথে তোমরা ‘ইনসাফ’পূর্ণ আচরণ করতে পারবে না, তাহলে একজনকে অথবা অধিকারভুক্ত দাসীকে বিয়ে করাই যথেষ্ট। সম্ভবত এ পন্থায় তোমরা পক্ষপাতিত্ব করার অপরাধ থেকে রক্ষা পাবে।’ (সূরা নিসা : ৩)

‘অবশ্য তোমরা যতই চাও না কেন, স্ত্রীদের সাথে সমান আচরণ করা তোমাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু একজনকে উপেক্ষা করে অন্যের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ো না (যাতে কারো এটা মনে না হয় যে, তার স্বামীই নেই।) আর যদি তোমরা নিজেদের ভুল সংশোধন করে নাও এবং আল্লাহ-সচেতন থাকো তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু।’ (সূরা নিসা : ১২৯)

এতিমের সম্পত্তি গ্রাস জঘন্য পাপাচার
৬. এতিমের অধিকার সুস্পষ্টভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ছলচাতুরী করে এতিমের সম্পত্তি গ্রাসকে জঘন্য পাপাচার হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয়- ‘এতিমদের প্রতি নজর রেখো বিয়ের বয়স না হওয়া পর্যন্ত। ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান ও যোগ্যতা সৃষ্টি হলে তাদের সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দেবে। তারা বড় হয়ে উঠছে, নিজেদের সম্পত্তি নিজেরা বুঝে নেবে-এ আশঙ্কায় অন্যায়ভাবে তাড়াহুড়ো করে তাদের সম্পত্তি খরচ করে ফেলো না। অভিভাবক হিসেবে তুমি সচ্ছল হলে এতিমের সম্পত্তি থেকে কোনোকিছু গ্রহণ করবে না আর গরিব হলে সঙ্গত পরিমাণ ভোগ করবে। তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার সময় অবশ্যই সাক্ষী রাখবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা : ৬)

‘অতএব এতিমদেরকে তাদের ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে। তাদের ভালো জিনিসের সাথে নিজের খারাপ জিনিসের অদলবদল করবে না। আর তোমাদের সম্পত্তির সাথে তাদের সম্পত্তি মিশিয়ে হজম করে ফেলবে না। নিশ্চয়ই এটা মহাপাপ।’ (সূরা নিসা : ২)

‘নিজে অসহায় সন্তান রেখে মারা গেলে, মৃত্যুকালে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তোমার মনে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকত, সেই একই অনুভূতি এতিমের প্রতি প্রদর্শন করো। আল্লাহ-সচেতন থাকো, হক কথা বলো, সুবিচার করো।’ ‘যারা এতিমের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, তারা তাদের পেট পরিপূর্ণ করছে আগুন দিয়ে। তারা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে চিরকাল।’ (সূরা নিসা : ৯-১০)

‘তারা জিজ্ঞেস করছে, এতিমদের ব্যাপারে কী করব? বলো, ‘তাদের জন্যে সুব্যবস্থা করা উত্তম।’ আর তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাকো, তবে তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ অবশ্যই হিতকারী আর অনিষ্টকারীর মধ্যে পার্থক্য করবেন। আল্লাহ ইচ্ছে করলেই এ বিষয়ে তোমাদের ওপর কষ্টকর দায়িত্ব দিতে পারতেন। মনে রেখো, আল্লাহ সর্বশক্তিমান, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারা : ২২০)

সম্পত্তির উত্তরাধিকারের দিক-নির্দেশনা
৭. সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কোনো সুষম বিধান ছিল না। মদিনার সমাজের জন্যে উত্তরাধিকারের জটিল বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা বিধিবদ্ধ করা হয়। ‘পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে আমি উত্তরাধিকার সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি। আর যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছ, তাদের প্রাপ্য দিয়ে দিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুরই পর্যবেক্ষক।’ (সূরা নিসা : ৩৩)

‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের (সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রাপ্তি) সম্পর্কে বিধান দিচ্ছেন: এক ছেলে পাবে দুই মেয়ের অংশের সমান, শুধু মেয়ে দুই-এর বেশি রেখে গেলে তারা পাবে রেখে যাওয়া সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ, আর যদি এক মেয়ে থাকে তবে সে পাবে অর্ধেক। তার সন্তান থাকলে তার পিতামাতা প্রত্যেকেই সম্পদের এক ষষ্ঠাংশ; সে নিঃসন্তান হলে যদি শুধু পিতামাতা তার উত্তরাধিকারী হয় তবে মা পাবে এক তৃতীয়াংশ; কিন্তু যদি তার ভাইয়েরা থাকে তবে তার মা পাবে এক ষষ্ঠাংশ; অবশ্য এ সবই হবে মৃত ব্যক্তির অসিয়তের দাবি পূরণ ও ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যে উপকারের দিক থেকে কে তোমাদের বেশি আপন, তা তোমরা জানো না। এই হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নিসা : ১১)

স্ত্রীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি সম্পর্কে বলা হয়: ‘তোমাদের স্ত্রীদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির অর্ধেক তোমাদের জন্যে, যদি তারা নিঃসন্তান হয়। তাদের সন্তান থাকলে রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তোমরা পাবে, অসিয়ত পালন ও ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের সন্তান না থাকলে স্ত্রীরা পাবে রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ, যদি একটি সন্তান থাকে তবে রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক অষ্টমাংশ স্ত্রীরা পাবে, তোমাদের অসিয়ত পালন ও ঋণ পরিশোধের পর। আর যদি কোনো পুরুষ বা মহিলা নিঃসন্তান হয় এবং মা-বাবাও মারা গিয়ে থাকে কিন্তু এক ভাই বা বোন জীবিত থাকে তবে তারা প্রত্যেকে পাবে এক ষষ্ঠাংশ, আর যদি তারা সংখ্যায় বেশি হয় তবে তারা এক তৃতীয়াংশ পাবে, তবে সবটাই হবে অসিয়ত পালন ও ঋণ পরিশোধের পর- কারো অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। এই হচ্ছে আল্লাহর বিধান। ...’ (সূরা নিসা : ১২)

নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তির ব্যাপারে...
নিঃসন্তান ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি সম্পর্কে বলা হয় : ‘..... আল্লাহ বিধান দিচ্ছেন যে, যদি কোনো নিঃসন্তান ব্যক্তি মারা যায় যার মা-বাবা মারা গেছে, তার একজন বোন থাকলে সেই বোন তার সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। আর বোন যদি সন্তানহীন অবস্থায় মারা যায় তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। মৃতের উত্তরাধিকারী যদি দুই বোন হয় তবে তারা সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। আর যদি কয়েকজন ভাইবোন থাকে তবে বোনেরা একভাগ আর ভাইয়েরা দুভাগ পাবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে তাঁর বিধান সুস্পষ্টভাবে বয়ান করেছেন, যাতে তোমরা পথভ্রষ্ট না হও। আর আল্লাহ সবকিছুই জানেন।’ (সূরা নিসা : ১৭৬)

অশ্লীলতা, পরকীয়া ও ব্যভিচারে রোধে করণীয়
৮. অশ্লীলতা, পরকীয়া ও ব্যভিচারের বিস্তার রোধে দৃষ্টি ও পোশাক-পরিচ্ছদে শালীনতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সুন্দর ও পরিশীলিত সমাজ নির্মাণে পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যেই পর্দার বিধান অনুসরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ‘(হে নবী!) বিশ্বাসী পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে শালীন রাখে, লজ্জাস্থান ঢেকে চলে এবং যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সংযত রাখে। এটি তাদের শুদ্ধাচারী করে তুলবে। তারা যা করে, আল্লাহ সে-সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।’ 

‘(হে নবী!) বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে শালীন রাখে, লজ্জাস্থানসমূহ ঢেকে চলে এবং যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সংযত রাখে। সাধারণভাবেই যা প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য ও মাধুর্য যেন জনসমক্ষে প্রকাশ না করে। তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার ওড়না দ্বারা ঢাকা থাকে। স্বামী, পিতা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, আত্মীয়া, দাসী, যৌনকামনা রহিত পুরুষ কর্মচারী, নারী-অঙ্গ সম্পর্কে অসচেতন শিশু ছাড়া অন্য কারো সামনে যেন তাদের সৌন্দর্য-মাধুর্য প্রকাশিত না হয়, সে ব্যাপারে তাদের সচেতন থাকতে হবে।
হাঁটার সময় তারা যেন এমনভাবে পা না নাড়ায়, যা তাদের গোপন সৌন্দর্যের দিকে অন্যের মনোযোগকে আকৃষ্ট করে। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সবসময় সকলে মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’ (সূরা নূর : ৩০-৩১)

‘বৃদ্ধা নারী, যারা বিয়ের কোনো আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না, তারা যদি সৌন্দর্য প্রদর্শনী না করে তাদের জড়ানো চাদর খুলে রাখে, তবে তাতে কোনো দোষ নেই। তবে খুলে না রাখাই ভালো। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।’ (সূরা নূর : ৬০)

‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রী, কন্যা ও বিশ্বাসী নারীদের বলো, তারা যেন (জনসমক্ষে) তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের (শালীন মহিলা হিসেবে) চিনতে সুবিধা হবে এবং কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু।’ (সূরা আহজাব : ৫৯) এইসব বিধান নাজিল করা হয় সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।

জয়নব বিনতে খুজাইমাকে বিয়ে 
পঞ্চম স্ত্রী। জয়নব বিনতে খুজাইমা। তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ওহুদের যুদ্ধে শহিদ হন। ওহুদের যুদ্ধে শহিদ পরিবারের অর্ধশতাধিক বিধবার সামাজিক পুনর্বাসনের এবং সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষার অংশ হিসেবে নবীজী তাকে বিয়ে করেন। তিনি খুবই দয়াবতী নারী ছিলেন। বঞ্চিতের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি পরিচিত ছিলেন উম্মুল মাসাকিন অর্থাৎ ‘বঞ্চিতদের মাতা’ নামে। নবীজীর সাথে বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই তিনি মারা যান। 

ষষ্ঠ স্ত্রী উম্মে সালামা। তার স্বামী আবু সালামা নবীজীর একেবারে প্রথম দিকের অনুসারী। তিনি তার স্বামীর সাথে প্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। পরে আবু তালিবের মৃত্যুর পর তারা মদিনায় হিজরত করেন। তার স্বামী আবু সালামা ওহুদের যুদ্ধে শহিদ হন। তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। শিশুসন্তান ছাড়া মদিনায় তার আর কোনো নিকটাত্মীয়ও ছিল না। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। নবীজী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু উম্মে সালামা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। নবীজী তার সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো দেখার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর তিনি বিয়েতে রাজি হলেন।

বিদূষী উম্মে সালামা স্বল্প সময়েই মদিনার নারীদের মুখপাত্রে পরিণত হলেন। মসজিদ-সংলগ্ন আবাসে থাকার ফলে উম্মুল মুমেনিনরা সামাজিক তৎপরতার কেন্দ্রে অবস্থান করতেন। তিনি মুসলিম নারীদের অন্তরে সমাজে নতুন ভূমিকা ও সম্মানজনক সহাবস্থানের স্বপ্নের বীজবপন করলেন। নবীজীর সাথে বিয়ের কিছুদিন পরই মদিনার মহিলাদের একটি দল এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, কোরআনে মহিলাদের উল্লেখ এত কম কেন!

উম্মে সালামা প্রশ্নটি নবীজীর কাছে তুলে ধরলেন। এর কয়েকদিন পরই তিনি শুনতে পেলেন নবীজীর তেলাওয়াত:
‘নিশ্চয়ই সমর্পিত পুরুষ ও নারী, বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়ী পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ ও নারী, যৌনসংযমী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও নারীদের জন্যে আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সূরা আহজাব : ৩৫) 

কোরআনের বিভিন্ন আয়াতেও পুরুষ ও নারীর যথাযোগ্য মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। ‘পুরুষ হোক বা নারী, বিশ্বাসী হয়ে যে-ই সৎকর্ম করবে, সে-ই জান্নাতে দাখিল হবে। তাদের প্রতি পরমাণু পরিমাণও অবিচার করা হবে না।’ (সূরা নিসা : ১২৪) ‘তারপর তাদের প্রতিপালক তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বলবেন, আমি কোনো সৎকর্মশীল নর-নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা একে অপরের পরিপূরক। তোমাদের সৎকর্মের পুরস্কার সমান। তাই যারা হিজরত করেছ, ঘরছাড়া হয়েছ, আল্লাহর পথে নির্যাতিত হয়েছ, যুদ্ধ করেছ বা নিহত হয়েছ, তাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেবো। তারা প্রবেশ করবে জান্নাতে, যার পাদদেশে থাকবে প্রবহমান ঝর্নাধারা। ...বস্তুত আল্লাহর পুরস্কারই শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫)

‘বিশ্বাসী পুরুষ হোক বা নারী, যে-ই সৎকর্ম করবে তাকে দুনিয়ায় সার্থক জীবন দান করব এবং পরকালে সে তার কাজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাবে।’ (সূরা আন-নহল : ৯৭) আসলে কোরআনে নারী-পুরুষের অধিকার সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত। নারীর কিছু বিশেষ অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে। পুরুষেরও কিছু বিশেষ অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে।

নারী-পুরুষের সৎকর্মের পুরস্কার সমান
যখন নারীরা কোরআনের আয়াত শুনলো যে, নারী-পুরুষের সৎকর্মের পুরস্কার সমান তখন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে এই স্বপ্নের প্রয়োগ শুরু করল। তারা অনুভব করল আল্লাহ তাদের পক্ষেই আছেন। আসলে কোরআনের শিক্ষা হচ্ছে, প্রতিটি মানুষ কর্মের ব্যাপারে স্বাধীন ও সার্বভৌম। তবে প্রত্যেককেই কর্মের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। শুধু পুরুষ নয়, নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি সমানভাবে প্রযোজ্য। বিদূষী উম্মে সালামা হুদাইবিয়া, খায়বর ও মক্কা বিজয়ের সময় নবীজীর সফরসঙ্গী ছিলেন এবং বিভিন্ন সংকটকালে নির্ভরযোগ্য পরামর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন।

ওহুদে মুসলমানদের হতাহতের খবরে উৎসাহিত হয়ে বনু আসাদ মদিনা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নবীজী খবর পেয়ে ১৫০ জন জনযোদ্ধার একটি দল প্রেরণ করলেন। মুসলিম বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। নাখলার বাসিন্দাদের মদিনা আক্রমণে প্ররোচিত করছিল খালেদ ইবনে সুফিয়ান। এদেরকে দমন করার জন্যে প্রেরিত অভিযানে বনু হুদাইল গোত্রপতি খালেদ ইবনে সুফিয়ান নিহত হলেন। একই সময় নবীজী আদল ও কারা গোত্রের বিশেষ অনুরোধে তাদের ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্যে ছয় জন শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞকে প্রেরণ করলেন। এরা হলেন, ১. মারসাদ ইবনে মারসাদ (দলপতি) ২. আসিম ইবনে সাবিত ৩. খালিদ ইবনে বুখাইর ৪. আবদুল্লাহ ইবনে তারিক ৫. খুবাইব ইবনে আদী এবং ৬. জায়েদ ইবনে দাসিন্না।

পথিমধ্যে আর-রাজী নামক স্থানে বনু হুদাইল গোত্রের শতাধিক তীরন্দাজ আচমকা আক্রমণ করে তাদের চার জনকে হত্যা করল। চুক্তি লঙ্ঘন করে ওরা আউস গোত্রের আনসার খুবাইব ইবনে আদী এবং খাজরাজ গোত্রের জায়েদ ইবনে দাসিন্নাকে আটক করে মক্কায় কোরাইশদের কাছে বিক্রি করে দিল। খুবাইব বদরের যুদ্ধে কোরাইশ নেতা হারিস ইবনে আমিরকে হত্যা করেছিলেন। তাই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে উকাবা ইবনে হারিস তাকে কিনে নিল। আর জায়েদকে কিনে নিল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে।

কিন্তু সে মাস ছিল হত্যা নিষিদ্ধ ও যুদ্ধ বিরতির মাস। তাই মাস শেষ হলে হত্যা করার জন্যে তাদের বন্দি করে রাখা হলো। খুবাইব শিকলে বাঁধা অবস্থায়ই অপ্রয়োজনীয় পশম কাটার জন্যে হারিসের কন্যা জয়নবের কাছ থেকে একটি ধারালো চাকু চেয়ে নিলেন। জয়নবের অসতর্কতার একমুহূর্তে তার ছোট্ট ছেলে দৌড়ে খুবাইবের কাছে গেল। খুবাইব তাকে হাঁটুর ওপর বসালেন। জয়নব হঠাৎ করেই দেখল যে, বন্দির ডান হাতে ধারালো চাকু আর বাম হাঁটুর ওপর বসে আছে তার ছোট্ট ছেলে, তখন সে ভয়ে আঁতকে উঠল। খুবাইব মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আমি তোমার ছেলেকে খুন করব? আমি কখনো তা করতে পারি না। একজন মুসলমান কখনো কোনো শিশু বা কোনো নিরপরাধ মানুষকে খুন করে না।’

হত্যা নিষিদ্ধের মাস শেষ হওয়ার পর খুবাইবকে মক্কার উত্তরে ছয় কিলোমিটার দূরে তানিম নামক স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আগে থেকেইে ক্রুশ প্রস্তুত করা ছিল। হত্যার দৃশ্য দেখার জন্যে মক্কার লোকজনও সেখানে জমা হয়েছিল। তখন খুবাইব তার হত্যাকারীদের অনুরোধ করলেন, তাকে দু-রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়ার জন্যে। তারা অনুমতি দিলে তিনি গভীর মনোযোগের সাথে দু-রাকাত নামাজ আদায় করলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘আমি নামাজে আরো সময় নিতাম। কিন্তু তা হলে তোমরা মনে করতে যে, আমি মৃত্যুভয়ে নামাজ দীর্ঘায়িত করছি। তাই তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম।’

[এ ঘটনার পর থেকে যদি শত্রুপক্ষ কোনো মুসলিম বন্দিকে হত্যা করতে চায়, তবে মৃত্যুর আগে অনুমতি পেলে দু-রাকাত নামাজ পড়া সুন্নাহ-য় পরিণত হয়।] কোরাইশরা এরপর খুবাইবকে কাঠনির্মিত ক্রুশে বিদ্ধ করল এবং বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করল। ‘মুহাম্মদের সঙ্গীরা যেভাবে তাকে ভালবাসে, এমনভাবে ভালবাসতে আমি কাউকে দেখি নি!’ খুবাইবের সহবন্দি জায়েদ ইবনে দাসিন্নাকেও একইভাবে হত্যা করা হলো।

জায়েদকে হত্যা করার সময় সেখানে অন্যান্য কোরাইশ নেতাদের সাথে আবু সুফিয়ানও ছিলেন। তিনি জায়েদকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যি করে বলো তো, তুমি কি চাও না, আজকে তোমার স্থানে মুহাম্মদ বন্দি অবস্থায় থাকত, আর তুমি তোমার পরিবারের সাথে মুক্ত থাকতে?’ জায়েদ জবাবে বললেন, ‘আমি অবশ্যই চাই না মুহাম্মদ যেখানে আছেন, সেখানে তাঁর গায়ে একটা কাঁটা বিঁধুক আর আমি আমার পরিজনের সাথে থাকি?’ আবু সুফিয়ান হতবাক হয়ে মন্তব্য করলেন, ‘মুহাম্মদের সঙ্গীরা যেভাবে তাকে ভালবাসে, এমনভাবে ভালবাসতে আমি কাউকে দেখি নি!’

বীরে মাউনার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো একই মাসে। হাওয়াজিনদের অন্তর্ভুক্ত আমির গোত্রের নেতা আবু বারা ইবনে মালিক মদিনায় এসে নবীজীর সাথে দেখা করলেন। নবীজী তাকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান না করেই বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি যদি আপনার কিছু সাহাবীকে নজদ এলাকায় পাঠান তবে আমি আশা করছি যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। নবীজী বললেন, ‘আমার ভয় হয় নজদের লোকেরা এদের হত্যা করবে।’ আবু বারা নিশ্চিত করলেন যে, আমি তাদের সুরক্ষা দেব।’ নবীজী আল মুনযির ইবনে আমরের নেতৃত্বে কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী ৪০ জন সাহাবীকে ইসলাম প্রচারের জন্যে প্রেরণ করলেন। তারা নজদের পথে মাউনা কূপের কাছে পৌঁছার পর সুলাইম গোত্রের যোদ্ধারা আচমকা আক্রমণ করে ৩৮ জনকে হত্যা করল। আহত কাব ইবনে জায়েদকে মৃত মনে করে ফেলে গেল। আর আমর ইবনে উমাইয়াকে মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দিল।

আমর মদিনা ফেরার পথে তার সঙ্গীদের হত্যাকারী ভেবে আমির গোত্রের দুজনকে হত্যা করলেন। এবং মদিনায় এসে নবীজীর কাছে আদ্যোপান্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। আর-রাজী ও বীরে মাউনার ঘটনার কথা একই দিনে নবীজীর কাছে পৌঁছায়। ঘটনা দুটি মুসলমানদের সামনে সুস্পষ্ট করে দিল যে, শত্রুরা কখনো তাদেরকে শান্তিতে থাকতে দেবে না, শান্তিতে ধর্মপ্রচার করতে দেবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, মদিনার বাইরে বা ভেতরেও মুসলমানদের শত্রুর কোনো অভাব ছিল না। আমর ইবনে উমাইয়া বনু আমির গোত্রের দুজনকে ভুল করে হত্যা করায় নবীজী রক্তপণ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

তখন মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় তিনি মদিনার ইহুদি গোত্র বনু নাদিরের কাছে রক্তপণ সংগ্রহে সহযোগিতা চাইলেন। তাছাড়া আগে থেকে বনু নাদিরের সাথে বনু আমিরের পারস্পরিক মৈত্রী চুক্তি ছিল। বনু নাদিরের নেতারা মুক্তিপণ সংগ্রহে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তারা নবীজী ও বিশ্বাসীদের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানালেন। নবীজী আবু বকর, ওমর ও আলীকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। তারা যখন আলাপ-আলোচনার জন্যে এক ভবনের পাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন, তখন বনু নাদিররা নবীজীকে (স) হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। নবীজী ষড়যন্ত্র অনুধাবন করতে পেরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।

বিশ্বাসভঙ্গের এমন জঘন্য ঘটনার শাস্তি হিসেবে বনু নাদিরকে মুহাম্মদ ১০ দিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তবে মদিনা ছেড়ে গেলেও নিজেদের সম্পদ ও বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে লোক রাখার সুযোগ তারা পেল। অর্থাৎ তাদের সকল সম্পদ তাদেরই থাকবে। কিন্তু মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাদেরকে বলল যে, তোমাদের মিত্র হিসেবে আমি ২০০০ সৈন্য নিয়ে সুরক্ষা দেবো। আর তোমাদের স্বধর্মীয় বনু কোরাইজা এবং মিত্র গাতাফান গোত্র তো রয়েছেই।

বনু নাদির গোত্রপ্রধান হুয়াই ইবনে আখতাব এই ঘটনাকে মদিনা থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদের চমৎকার সুযোগ মনে করলেন। তার মনে হলো ওহুদ, আর-রাজী ও বীরে মাউনার ঘটনায় মুসলমানদের মনোবল নষ্ট হয়ে গেছে। অতএব এখনই সময়। তিনি পাল্টা বলে পাঠালেন, ‘আমাদেরকে বহিষ্কারের যে-কোনো উদ্যোগ আমরা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করব।’ তারা যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে নিজ নিজ দুর্গে অবস্থান গ্রহণ করল। নবীজী দ্রুত যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে বনু নাদিরের দুর্গগুলো অবরোধ করলেন। বনু নাদিররা বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু তা এলো না।

মদিনার শক্তিশালী ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজা মদিনা সনদ লঙ্ঘন করতে অস্বীকৃতি জানাল। গাতাফান গোত্র বনু নাদিরের চিঠির কোনো জবাবই দিল না। আর মুনাফেক সবার সাথেই মুনাফেকি করে। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ২০০০ সৈন্যের কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। অবরোধের ১০ দিন পর নবীজী মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগের জন্যে তাদের খেজুর বাগানের বেশ কয়েকটি গাছ দৃশ্যমানভাবে কাটার নির্দেশ দিলেন। হুমকি দিলেন, বাগানের সব গাছ কেটে ফেলা হবে। খেজুর গাছ কাটার প্রভাব পড়ল দ্রুত। বনু নাদির এবার আগের শর্তে মদিনা ত্যাগের প্রস্তাব করল। নবীজী বললেন, ‘না। যুদ্ধ ঘোষণার পর আগের শর্ত আর থাকছে না। তবে প্রত্যেকেই নিরাপদে মদিনা ছেড়ে যেতে পারবে সাথে এক উট বোঝাই মালামাল নিয়ে।’

বনু নাদির মনে মনে ভাবল, ঘরবাড়ি বাগান থাকুক। কোরাইশরা মুসলমানদের পরাজিত করার পর তারা আবার ফিরে আসবে। মদিনা ত্যাগ করে বনু নাদির গোত্রের অধিকাংশই খায়বরের বিশাল ইহুদি এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করল। নবীজী যুদ্ধলব্ধ বনু নাদিরের স্থাবর সম্পত্তি দরিদ্র মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে বিতরণ করে দেন কোরআনের নির্দেশনার ভিত্তিতে। 

‘একইভাবে (যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তির অংশবিশেষ) অভাবী মোহাজেরদের জন্যে, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সাহায্যে সদাপ্রস্তুত থাকে। এরা সত্যাশ্রয়ী। একইভাবে (যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তির অংশবিশেষ) তাদের জন্যে, অভাবী মোহাজেররা আসার আগে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এ শহরেই বসবাস করছিল। এরা মোহাজেরদের ভালবাসে ও মোহাজেরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা নিয়ে ঈর্ষান্বিত নয়। নিজেরা অভাবী হলেও নিজেদের চেয়ে মোহাজেরদেরকেই অগ্রাধিকার দেয়। এদের অন্তর সংকীর্ণতামুক্ত। এরাই সফলকাম।’ (সূরা হাশর : ৮-৯)

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি