হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা
প্রকাশিত : ১২:৫৮, ২১ আগস্ট ২০১৯
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা আগামীকাল বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট)। এজন্য প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে। কিন্তু সাক্ষাৎকার দানকালে কোনও রোহিঙ্গাই বিনা শর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছেন না।
বাংলাদেশে এখন যে এগারো লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে, তার বড় অংশই বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর জাতিসংঘসহ নানা সংস্থার নানা উদ্যোগের পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রত্যাবাসন শুরুর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
পরে গত ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন ভন্ডুল হয়।
এরপর বাংলাদেশের পাঠানো প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা থেকে সম্প্রতি আবারও ৩ হাজার ৪৫০জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। এবং আগামী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরু করতে সম্মত হয় দুই দেশ।
এবার সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া বেশ কজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং নিজ ভিটে-বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি পূরণ করা না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরতে চান না বলে মত দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের ভয়েও অনেকে নিজ দেশে ফিরতে রাজি হচ্ছে না। এর আগে যারাই মিয়ানমার ফেরত যেতে চেয়েছেন, তাদের নির্যাতন সইতে হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন আল-ইয়াকিনের অন্তত ৩১ প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা কিলার বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে অবস্থান করছে। আর আশ্রিত রোহিঙ্গারা জানান, কেউ প্রত্যাবাসনে রাজি হয়েছে শুনে এর আগে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গত সোমবার রাতেও প্রত্যাবাসনের খবর দিতে গিয়ে শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক অপহৃত হয়েছেন। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রাণের ভয়ে অনেকে স্বদেশে ফিরে যাবে বলে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না।
এদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যা, গুমসহ নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশানসও। ফলে রোহিঙ্গাদের এসব কর্মকাণ্ড হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিন দিন।
খেয়াল খুশিমতো যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার জেলার আনাচে-কানাচে শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। শুধু উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতেই নয়, কক্সবাজারের সীমানা পার হয়ে রোহিঙ্গারা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
রোহিঙ্গারা মোবাইলে দেদারে ব্যবহার করছে বাংলাদেশি সিম। শরণার্থী ক্যাম্প ও আশপাশের বাজারগুলোয় হাত বাড়ালেই বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন কিংবা নিবন্ধন ছাড়াই এসব সিম পাওয়া যায়। এমনকি অবৈধ পথে মিয়ানমারেও তা পাচার হচ্ছে। ফলে ওই দেশে থেকে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে চলছে বাধাহীন যোগাযোগ। আবার এসব সিম ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ও চালিয়ে যাচ্ছে। ভুয়া রেজিস্ট্রেশন হওয়ায় পরবর্তী সময় প্রকৃত ব্যবহারকারীদের ধরতে পারছে না প্রশাসন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পের এক যুবক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশি অপারেটরদের সিম ব্যবহার করেন। এগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশি নাগরিকদের আইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া রেজিস্ট্রেশনকৃত। এ সুযোগে অনেকে আবার অপহরণ, ডাকাতি, খুন, হুমকি দেওয়া ও বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণায় এসব সিম ব্যবহার করে। তবে ক্যাম্পের সবাই যে মোবাইল ব্যবহারে সচেতন, তা নয়।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা অ্যাফেয়ার্স সেলে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন তুষার কণা খোন্দকার। তখন তিনি ছিলেন সহকারী সচিব। পরে স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। তার মতে, প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল উৎস নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে কেউই আন্তরিক ছিল না। মিয়ানমারের ওপর যাদের প্রভাব আছে, তারা কখনোই স্থায়ী কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
তুষার কণা খোন্দকার বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে, তারা স্টেটলেস হয়ে গেছে। এটা প্রচার করে তাদের তৃতীয় কোনও দেশে যাওয়ার অপশন দেওয়া হচ্ছে। এই অপশনে ৭৫০টি পরিবার যেতে পেরেছে। কিন্তু বারুদের মতো মেসেজটি চলে গেছে, এখানে ক্যাম্পে থাকলে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড চলে যাওয়া যাবে। আয়ারল্যান্ডে রোহিঙ্গা শিশুরা ক্রিকেট খেলছে এমন ছবি ইউএনএইচসিআরের বিভিন্ন বইতে পাবেন। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল সুবিধাভোগী এই গোষ্ঠীর কারণেই এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকার একটি কাজই এখন করতে পারে, রোহিঙ্গাদের একদম আলাদা একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। ইউএনএইচসিআর সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে। তাদের কার্যক্রম মনিটর হবে। এতে খুব দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।