ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

পর্ব-৪

হৃদরোগ নিরাময়ের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি

প্রকাশিত : ১৭:৩৮, ১ অক্টোবর ২০১৭ | আপডেট: ১৮:১১, ২ অক্টোবর ২০১৭

চলতি বছর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর । দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘পাওয়ার ইওর হার্ট, শেয়ার ইওর হার্ট’। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। অর্থাৎ বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৭ লাখ বা মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ ঘটে হৃদরোগের কারণে।

হৃদরোগের  কারণ:

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আবেগের আগ্রাসন, কাজের বাড়তি চাপ প্রভৃতি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। জীবনে ক্রমাগত আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া, কাজ-কর্মে তাড়াহুড়ো, আধুনিক জীবনযাত্রায় নিত্য দিনের দুর্ভাবনা এককথায় স্ট্রেস সরাসরি আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া ও হৃৎপিণ্ডের উপর প্রভাব ফেলে। হৃদযন্ত্রের নানারকম প্রাণঘাতী অসুখের মধ্যে করোনারি হৃদরোগ অন্যতম। এতে হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে কোলেস্টেরল বা চর্বি জমে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায় এবং বুকে ব্যথাসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ, ধূমপান, মেদস্থুলতা এবং টেনশন বা স্ট্রেস ইত্যাদিকে হৃদরোগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ মনে করা হয়।

হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসা :

প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় ধমনীতে জমে থাকা এ চর্বির স্তর পরিষ্কার করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে ব্লকেজের পরিমাণ অনুসারে ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু এর কোনোটি দিয়েই পুনঃব্লকেজ প্রতিরোধ করা যায় না। কারণ মূল সমস্যার সমাধান না করে সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে গেলে যা হয়, এখানেও তা-ই ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লকেজ-এর চিকিৎসা করা হলেও ব্লকেজ -এর কারণ ও পুনঃব্লকেজ প্রতিরোধের ব্যাপারে রোগীকে খুব ভালোভাবে সচেতন করা হয় না। ফলে চিকিৎসা গ্রহণের পরও অনেক রোগী পুনরায় নতুন ব্লক নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস ও ধূমপানের পাশাপাশি হৃদরোগের ক্ষেত্রে অত্যধিক মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা একটি অন্যতম প্রধান অনুঘটক, যার কোনো চিকিৎসা হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। অপারেশনের পর রোগী যখন পুরনো জীবন অভ্যাসে ফিরে যায়,  সে আবারও আক্রান্ত হয় ব্লকেজসহ হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতায়।

নতুন আশা নতুন বিশ্বাস :

খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এর চেয়ে অনেক ভালো ফল পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতায়। এতদিন চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন, ধমনী একবার ব্লক হওয়া শুরু করলে বাইপাস সার্জারি কিংবা এনজিওপ্লাস্টি ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই। চিকিৎসকদের এই রক্ষণশীল চিন্তার মর্মমূলে প্রথম আঘাত হানেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ডিন অরনিশ। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করার সময় তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন, এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস করার ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি রোগী পুনরায় ধমনীর ব্লকেজ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। পরবর্তীতে হৃদরোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে যোগ ব্যায়াম, কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার ও মেডিটেশনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৯০ সালে আমেরিকার মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট-এ প্রকাশিত হয় তার একটি গবেষণা রিপোর্ট। ১৯৮৭ সালে ৪৮ জন হৃদরোগীকে ২ ভাগে ভাগ করে ডা. অরনিশ এ গবেষণাটি পরিচালনা করেন। এক গ্রুপের ২৮ জনকে এক বছর ধরে কম চর্বিযুক্ত খাবার দেয়ার পাশাপাশি মেডিটেশন ও যোগ ব্যায়ামের অনুশীলন করানো হয়। সেইসাথে ধূমপান বর্জন এবং রোগীদেরকে মমতা ও সহানুভূতিপূর্ণ মানসিক অবস্থায় রাখার চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে বাকি ২০ জনকে আমেরিকান হার্ট এ্যাসোসিয়েশন নির্দেশিত হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসা এবং পথ্যবিধির অধীনে রাখা হয়। এক বছর পর দেখা যায়, ১ম গ্রুপের রোগীদের ধমনীতে ব্লকেজের পরিমাণ তো বাড়েইনি, বরং কমেছে এবং হার্টে রক্ত চলাচলের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে বেড়েছে। অন্যদিকে প্রচলিত চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও দ্বিতীয় গ্রুপের প্রায় সবারই ব্লকেজের পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন-এ গবেষণাটি সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

শুধু আমেরিকা বা পাশ্চাত্যেই নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের এ আধুনিকতম পদ্ধতি। ডা. ডিন অরনিশ ভারতে এসেছিলেন এবং অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স-এ  চিকিৎসকদের সম্মেলনে তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। ভারতে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং চমৎকার ফলাফল পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশÑ এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক ২০০৮ সালের নভেম্বরে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনায় দেয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘মনের প্রভাব শরীরের উপর অপরিসীম। তাই দেহের পাশাপাশি মনের যতœ নেয়াও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন বা আত্মা ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকে না। কাজেই আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে নিয়মিত নামাজ, প্রার্থনা ও মেডিটেশন করা উচিত। চাপমুক্ত জীবনযাপন, মানসিক সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্যে রিলাক্সেশন বা শিথিলায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে তাই এটি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে’।

নিজের দায়িত্ব নিতে হবে নিজেকেই :

ইংরেজিতে একটি কথা আছে- patient cure themselves, doctors show the way.

 নব্য চিকিৎসা ধারার প্রবর্তক ডা. ডিন অরনিশ, ডা. দীপক চোপড়া, ডা. কার্ল সিমনটন, ডা. বার্নি সীজেল, ডা. হার্বার্ট বেনসন প্রমুখ ‘বডি, মাইন্ড, স্পিরিট’সাময়িকীর ১৯৯৭ সালের বিশেষ সংখ্যায়  ‘একবিংশ শতকের স্বাস্থ্য’ প্রচ্ছদ কাহিনীতে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে মত প্রকাশ করেছেন যে, সুস্থ থাকতে হলে নিজের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে। নিজেকে নিরাময় করার ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের সহজাত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। কারণ বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি বা সারাজীবন কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রক ওষুধ সেবনের চাইতে সঠিক জীবনদৃষ্টি গ্রহণ করে জীবনধারা পরিবর্তনের খরচ অনেক কম। ডা. হার্বার্ট বেনসন বলেন, একজন মানুষ নিজেই রিলাক্সেশন বা  শিথিলায়ন, মেডিটেশন, ব্যায়াম ও পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করে তা অনুসরণ এবং নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে।

লেখক : কোঅর্ডিনেটর, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব।

                                                                                        

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি