১৪ ফেব্রুয়ারি স্মরণ
প্রকাশিত : ১৩:২০, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২৩:৩৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি বাতিল ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তৎকালীন স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা ছাত্র-জনতার রক্তে লাল হয়েছিল ঢাকার রাজপথ।
এসময় গণগ্রেফতারে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। এ ঘটনা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন অনিবার্য করে তোলে। সেসময় শুরুর দিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সঙ্গে এদিন ঐতিহাসিক ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্ববহ এই দিনটি সময়ের বিবর্তনে এখন নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এদিনে মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত হন। তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে সেই শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয় এরশাদের সামরিক সরকার।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পরই ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। পাশাপাশি সামরিক সরকারও ছাত্রদের নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।
২৪ মার্চই কলাভবনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হন কয়েকজন শিক্ষার্থী। দুদিন পরই ছাত্ররা সাভারে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্র বিরোধী স্লোগান তুললে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
পরে ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার লাঠিচার্জ করলে ১৪টি ছাত্র সংগঠন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। অন্যদিকে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার এনে শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণই ছিল এর উদ্দেশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে বিলোপ করতে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত স্বায়ত্তশাসনের অধ্যাদেশ বাতিলের সুপারিশ করা হয় এতে। একইসাথে রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা শতকরা ৫০ ভাগ শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়।
এর প্রতিবাদে ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে এ শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে। এর ধারাবহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দিমুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র সমাবেশ ডাকে কলা ভবনে।
সমাবেশ শেষে সচিবালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর মিছিল বের হলে হাইকোর্টের গেটের সামনে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে পড়ে। এ সময় পুলিশের বেপরোয়া গুলি ও বেধড়ক লাঠিচার্জে নিহত হন জয়নাল, জাফর, দিপালীসহ ১১ জন, আহত হন শতাধিক আর পুলিশের হাতে আটক হন ১৩৩১ জন।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কাঞ্চন। পরে দেশব্যাপী এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয় এরশাদ সরকার। শুরুর দিকে থেকে যথাযথভাবে পালন করে আসলেও সময়ের বিবর্তনে নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে।
ঐতিহাসিক ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস‘ স্বরণ করে জাসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার তার ব্যক্তিগত ফেইসবুকে লিখেছেন, ক্ষমতা দখল আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই ছিল সে দিন। মজিদ খানের শিক্ষনীতির বিরুদ্ধে এক সেক্যুলার বৈজ্ঞানিক গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য সেই মিছিল বের করছিল শিক্ষার্থীরা।
বিশেষ করে এই দিনের কথা মনে হলেই জয়নালের কথা বার বার মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন তার ফেইসবুকে, আমি বিশ্বাস করি ভালবাসার চাইতে কোন মারণাস্ত্র শক্তিশালী হতে পারে না। ভালবাসা দিয়েই জয় করতে চাই পৃথিবীর মানবতা। ভালবাসার উত্তাপে উজ্জীবিত হোক মানবিকবোধ। নির্মূল হয়ে যাক সকল নষ্ট-ভ্রষ্ট চিন্তা।
শিরিন আখতারের ফেসবুকে দেয়া পোস্টটি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পাঠকদের জন্য হুবহ তুলে ধরা হল:
১৪ ফেব্রুয়ারি। আমার সকল ভালবাসা জয়নালের জন্য। ’৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উত্তাল বিশাল মিছিলে শহীদ জয়নাল, আমার ছোট্ট্র সাহসী ভাইটি। আমার সহকর্মী। নোয়াখালীর চাটখিল থেকে অনেক স্বপ্ন চোখে নিয়ে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে বলে। মিছিলে মিছিলে মুখরিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। অবৈধ ক্ষমতা দখল আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই। মজিদ খানের শিক্ষনীতির বিরুদ্ধে এক সেক্যুলার বৈজ্ঞানিক গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবার জন্য সেই মিছিল এগিয়ে চলছিল।
১৪ ফেব্রুয়ারির আগের দিন মধুর ক্যান্টিনে এসে আমাকে বল্ল, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়তে চাই’। আমি হেসে বল্লাম নিশ্চয় পড়বে। আগামীকাল মিছিলে এসো। বুঝতে পারিনি আমার এ আহবান ওকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিবে। দুরন্ত সাহসে হেঁটে চলছিল মিছিল। বটতলা থেকে সে মিছিল শিক্ষাভবন। সেখানেই লুটিয়ে পড়েছিল জয়নাল। অনেক যুদ্ধের পর লাশ নিয়ে রাখা হল আর্টস ফ্যাকাল্টিতে। রাজনৈতিক নেতারা আসবেন, দেখবেন। হঠাৎ পুলিশের আক্রমণ ছিনিয়ে নিয়ে গেল জয়নালকে। রাতে কারফিউ। অতপর ---
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে তাই জয়নালের কথা বার বার মনে পড়ছে। আমি বিশ্বাস করি ভালবাসার চাইতে কোন মারণাস্ত্র শক্তিশালী হতে পারে না। ভালবাসা দিয়েই জয় করতে চাই পৃথিবীর মানবতা।
ভালবাসার উত্তাপে উজ্জীবিত হোক মানবিক বোধ। নির্মূল হয়ে যাক সকল নষ্ট-ভ্রষ্ট চিন্তা।
জয়তু ১৪ ফেব্রুয়ারি।। জয়তু জয়নাল।।
/টিআর//
আরও পড়ুন