ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই

প্রকাশিত : ১৭:২১, ২৫ মার্চ ২০১৯ | আপডেট: ১৭:২৩, ২৫ মার্চ ২০১৯

১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩)-এর অধীনে গণহত্যার সংজ্ঞায় গণহত্যা বলতে এমন কর্মকাণ্ডকে বোঝানো হয়েছে যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এই সংজ্ঞা অনুসারে গণহত্যা কেবল হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উপরোক্ত উদ্দেশ্যে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতিসাধন, জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার মতো জীবননাশী অবস্থার সৃষ্টি করা, জন্ম ও জীবনধারণ প্রতিরোধ করার মতো ব্যবস্থা নেয়া, একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্ম পরিচয় ও জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলাকেও গণহত্যার সংজ্ঞার আওতাভুক্ত। এই রেজ্যুলেশন অনুযায়ী গণহত্যা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু তাই নয়, গণহত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, এমনকি যারা এ কাজে উদ্বুদ্ধ করবেন তারাও এই অপরাধের কারণে বিচারাধীন হবেন। এই উদ্বুদ্ধকরণের ব্যাপারটি সরাসরি হোক, নিভৃতে হোক কিংবা জনসমক্ষে উত্তেজক বক্তব্যের মাধ্যমেই হোক তা সমানভাবে গুরুতর অপরাধ। গণহত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও বিচারযোগ্য অপরাধে অপরাধী হিসেবে পরিগণিত হবেন। গণহত্যা সব সময়ই একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফসল, যা প্রতিরোধে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বুকে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম গণহত্যার একটি সংঘটিত করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এত অল্প সময়ে এত মানুষ হত্যা করার নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হলোকস্টে প্রায় ৫ বছরে ৬ মিলিয়ন ইহুদী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে নিহত মানুষের সংখ্যার আনুপাতিক হার হিসাব করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা হলোকস্টকেও হার মানায়। শত শত বধ্যভূমি আর গণহত্যার শিকার লাখ লাখ পরিবারের সদস্যরা আজও তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাত্র চার দশক আগে সারাবিশ্বের সম্মুখে সংঘটিত এই গণহত্যা আজও বিশ্বের ইতিহাসে স্থান পায়নি। পায়নি তার স্বীকৃতি। আর তাই আন্তর্জাতিক মহলে এত বড় হত্যাকা-অনুচ্চারিতই থেকে যায়। পাকিস্তানের এত বড় অপরাধ বিশ্বের অজানাই থেকে যায়। সেইসঙ্গে দেশের ভেতরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের প্রমাণিত সত্যকে অস্বীকার করে ইতিহাস বিকৃত করার প্রয়াস পায় এবং এই একই দেশবিরোধী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারে আন্তর্জাতিক মহলকে আমাদের প্রতি বৈরি করে তোলার সুযোগ পায়।

 অনেকেই প্রশ্ন করেন কেন এই ৪৮ বছর পরেও ’৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতি জরুরী। অনেকেই ভাবেন, আজকের দিনের এত বড় বড় সমস্যা থাকতে কেন ’৭১-এর বিষয় নিয়ে পড়ে আছি। ভাবতে পারেন চাকরির কোটার মতো ব্যক্তিগত লাভজনক বিষয় রেখে একটা বায়বীয় স্বীকৃতি নিয়ে কেন আমরা ভাবছি। ভাবতে পারেন পুরনো গণহত্যার চেয়ে রাজপথের দুর্ঘটনা অনেক বেশি আজকের বাস্তবতা। কিন্তু এভাবে ভাবাটা ঠিক নয়। মনে রাখবেন যে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না অথবা স্বীকৃতি মেলে না ভবিষ্যত প্রজন্ম তাকে অপরাধ গণ্য করে না। সুতরাং সে বারংবার সেই অপরাধ করতে থাকে। এই যেমন ধরুন সড়ক দুর্ঘটনার বিচার না হওয়ায় বা দোষীদের অপরাধের স্বীকৃতি না মেলায় সড়ক দুর্ঘটনার হত্যাকাণ্ড কমছে না। তেমনিভাবে গণহত্যার বিচার না হলে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ৪৮ বছর পরেও গণহত্যার স্বীকৃতি চাইছি আপনার জন্য, আপনার সন্তানের জন্য। আপনার সন্তান যেন আমার বাবার মতো গণহত্যার শিকার না হয় তার জন্য। কোটা না হলে চাকরি হলেও হতে পারে, যদি আপনি সত্যিকারের মেধাবী হন। শিক্ষার প্রসার, সড়কে দুর্নীতির বিলোপ অথবা আইনের শক্ত প্রয়োগে সড়কগুলো নিরাপদ হলেও হতে পারে। কিন্তু গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে তার বিচার না করলে ও তাকে ঘৃণা করতে না শেখালে আবার গণহত্যা হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কথা। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার করে পার পেয়ে যাওয়ায় তারা আজও নিজ দেশে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচিস্তান তার করুণ উদাহরণ। তেমনি বাংলাদেশের গণহত্যার বিচার হলে আজ হয়ত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই নির্মম গণহত্যা হতো না। গণহত্যা একটি-দুটি নয়, লাখ লাখ প্রাণের বিনাশ করে। সুতরাং, এর ভয়াবহতা সবচেয়ে বড়। তাই বারংবার এ নিয়ে কথা বলতে হবে, জানতে হবে, জানাতে হবে। বর্তমান দিনের সকল সমস্যার সঙ্গে গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টা চালানো একটি সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা- যতদিন পর্যন্ত না গণহত্যা নামক ভয়াবহতা থেকে এই পৃথিবীর প্রতিটি জাতিকে, প্রতিটি অনাগত শিশুকে নিরাপদ রাখা যায়।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্পষ্ট করে জানা জরুরি। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গণহত্যা বিষয়ক রেজ্যুলেশন যেদিন গৃহীত হয় সেই দিনটিকে জাতিসংঘ ২০১৭ সালে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের আর সব দেশের মতো বাংলাদেশও এতে স্বাক্ষর করেছে। তাই ২৫ মার্চকে ঘিরে তেমন কোন আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত আনার সুযোগ নেই। সেটা এখন আর আমাদের দাবিও নয়। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চকে আমাদের ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। জাতীয়ভাবে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস‘ হিসেবে এই ঘোষণা করায় বিশ্ব দরবারে এদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ আমরা অগ্রসর হলাম। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতি অর্জন খুব সহজ হবে বলে আমার মনে হয় না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যে সকল ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য, বিশেষত আমেরিকা যুদ্ধের গণহত্যাকারীদের পক্ষাবলম্বন করেছে সেই গণহত্যাসমূহের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বর্জিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী হত্যা, রোয়ান্ডা ও কম্বোডিয়ার মতো হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত রয়েছে। পশ্চিমা বহু দেশ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ’৭১-এ গণহত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকা, চীন, তথাকথিত ইসলামী উম্মাহ এরা কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। আমাদের গণহত্যার স্বীকৃতি তাদের সকলের অমানবিক চেহারা উন্মোচন করবে। এটা তারা হতে দেবে এত সহজে তা আমার মনে হয় না। আর সে কারণেই বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করার লক্ষ্যে আমাদের পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে আন্তর্জাতিক মহলের সর্বক্ষেত্রে। যে কোন সংজ্ঞাতেই বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এক ভয়াবহ গণহত্যা বলে স্বীকৃত হওয়ার যোগ্য। শুধু আমাদের প্রয়োজন যথাযথভাবে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক মহলের কাছে উপস্থাপন। ইতিহাস সংরক্ষণ ও নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা ভাল নই।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে তো আরও নই। তাছাড়া সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আমাদের এ দেশ ছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির হাতে। ’৭৫-৯৬ আমাদের দেশ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠীর হাতে থাকার সময় তারা সুপরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি ধ্বংস করেছিল। এখন অনেকদিন চলে গেছে, একে একে চলে যাচ্ছেন সেই ঐতিহাসিককালের রচয়িতারা, সেই কালের সাক্ষীরা। হারিয়ে যাচ্ছে প্রমাণাদি। আমাদের ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য আমরা হারিয়ে ফেলছি। কি অপরিসীম ক্ষতি। জরুরী ভিত্তিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য। এটা শুধু সময়ের দাবিই নয়, বরং হয়ত একেবারেই সময়ের শেষ পর্যায়ের শেষ আকুতি। আমরা আর কবে সচেতন হব?

লেখক : শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর সন্তান।

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি