দেশে দেশে বর্ষবরণ উৎসব
প্রকাশিত : ১২:৪১, ১৪ এপ্রিল ২০২২
এপ্রিলের ১৪ তারিখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় উৎসবগুলোর একটি। মুসলিম সম্প্রদায়ের দুইটি ঈদের পর পহেলা বৈশাখই দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উদযাপন করে থাকেন।
কেবল বাংলাদেশই নয়, দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছেও দিনটি বিশেষ উদযাপনের। তবে কেবল বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে ১৪ই এপ্রিলে নতুন বর্ষবরণের উৎসব পালন করা হয়। এর মধ্যে ভারতের কয়েকটি রাজ্য, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম অন্যতম।
চলুন জেনে নেয়া যাক ১৪ই এপ্রিল কোন দেশে কেমন করে পালন হয় নতুন বছরের উদযাপন:
বাংলাদেশ
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকা শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে।
এখন যেমন বাংলা নতুন বছরের শুরুর দিনটি একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় তেমন ছিল না। বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ তখন ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত।
ইতিহাসবিদদের হিসাব অনুযায়ী ১৫৫৬ সাল থেকে বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়।
মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার সভার জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লা শিরাজীর সহযোগিতায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন একটি বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন।
এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে ওঠে।
ঐ সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না।
বাংলা সন শূন্য থেকে শুরু হয়নি, যে বছর বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়, সে বছর হিজরি সন ছিল ৯২৩ হিজরি। সে অনুযায়ী সম্রাটের নির্দেশে প্রবর্তনের বছরই ৯২৩ বছর বয়স নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলা সনের। বাংলা বর্ষের মাসগুলোর নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নামে। তবে এখন যে রূপে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়, রাজধানী ঢাকায় ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন জনপ্রিয় হয় নি। সেসময় ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করার রীতি চালু হয়, যা এখন সার্বজনীন চরিত্র লাভ করেছে।
মিয়ানমার
মিয়ানমারের নববর্ষকে স্থানীয়ভাবে থিংইয়ান নামে ডাকা হয়। বার্মিজ ভাষায় এর অর্থ ‘পরিবর্তন’ বা ‘এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর’।
নতুন বছরের প্রথম দিনটি সাধারণত মধ্য-এপ্রিলে হয়ে থাকে, তবে ঠিক কোন নির্দিষ্ট দিনে তা পালন হবে তা হিসাব করা হয় মিয়ানমারের সৌর এবং চন্দ্র পঞ্জিকার গণনা মিলিয়ে।
থিংইয়ানের দিনে বার্মা বা মিয়ানমার জুড়ে পানি উৎসব হয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো পানি উৎসবের একটি। দেশটির মানুষ ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে পালন করে আসছে এ উৎসব।
নববর্ষের চারদিন আগে থেকে পানি উৎসব শুরু হয়, চলে নববর্ষের দিন পর্যন্ত।
দেশটির মানুষের বিশ্বাস, পানি উৎসবের পানির ছোঁয়া লাগতে হবে সব মানুষের গায়ে, তাতে করে সব পাপ দূর হয়ে যাবে। এপ্রিলে মিয়ানমারের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে, যে কারণে পানি উৎসবের কারণে লোকের কষ্টের চেয়ে বরং এক ধরণের শান্তি হয়।
থাইল্যান্ডের সংক্রান উৎসব
থাইল্যান্ডের নতুন বছরের শুরুর দিনটি সংক্রান উৎসব নামে পরিচিত। সংক্রান শব্দটি সংস্কৃত ভাষার শব্দ সংক্রান্তি থেকে এসেছে।
থাইল্যান্ডে মূলত এটি এপ্রিলের ১৩ তারিখে শুরু হয়, কিন্তু এ উৎসব চলে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
২০১৮ সালে থাই সরকার উৎসবের দৈর্ঘ্য ১২ই এপ্রিল থেকে ১৬ই এপ্রিল পর্যন্ত ঘোষণা করেছে। এ সময়ে দেশটির সাধারণ ছুটি থাকে। থাই এবং মালয়েশিয়ান সিয়ামিজ গোত্রের মানুষেরাই মূলত ধর্মীয় রীতি মেনে এ উৎসব পালন করেন, কিন্তু উদযাপন হয় দেশজুড়ে।
নববর্ষে থাইল্যান্ডে সবচেয়ে বড় আয়োজন থাকে পানি উৎসব। দিনভর সব বয়সের সব শ্রেণীর মানুষ অংশ নেন তাতে।
সিনহালা নববর্ষ
সিনহালা নববর্ষকে স্থানীয়ভাবে আলুথ আবুরুদ্ধাও বলা হয়। মূলত সিনহালিজদের উৎসব হলেও দেশটির সকল মানুষ উদযাপনে সামিল হন। দিনটিতে শ্রীলঙ্কায় সরকারি ছুটি থাকে।
শ্রীলংকার এই নববর্ষ ১৪ই এপ্রিল পালন করা হয়। তবে উৎসব চলে এক সপ্তাহ ধরে।
এ উৎসবটিও সৌর পঞ্জিকা অনুসারে পালন করা হয়, কিন্তু ঠিক কোন দিনে পালন করা হবে দিনটি সেটি নির্ধারণ করা হয় নতুন চাঁদের হিসাবে। সিনহালা নববর্ষের সাথে তামিল নববর্ষের উদযাপনে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
উৎসবে নানা রকম পিঠা, মিষ্টি আর পায়েস বানানো হয়। এতে নাগরিক আয়োজনের চাইতে লোকজ বিভিন্ন খেলাধুলা আর প্রতিযোগিতার আয়োজন বেশি দেখা যায়।
সবচাইতে উল্লেখযোগ্য খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে গরুর দৌড়, ডিম খেলা-এতে হাওয়ায় ছুড়ে দেয়া ডিম লুফে নেয়ার প্রতিযোগিতা হয়, ফসলি মাঠে কাদা খেলা ইত্যাদি।
কম্বোডিয়ার খেমার নববর্ষ
কম্বোডিয়াতে ১৪ই এপ্রিল খেমার নববর্ষ পালন করা হয়। দেশটিতে দিনটিকে বলা হয় ‘চউল সানাম থামাই’, এর মানে নতুন বছরে প্রবেশ করা।
উৎসবের শুরু হয় বৌদ্ধ মন্দিরে সকাল বেলায় ধর্মীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে। এরপর প্যাগোডা বা বৌদ্ধমন্দির চত্বরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মাধ্যমে নতুন বছরের স্বাগত জানাতে শুরু করেন অধিবাসীরা।
খেমার নববর্ষে কম্বোডিয়াতে নানা ধরণের লোকজ খেলা এবং প্রতিযোগিতা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে রশি বা দড়ি টানাটানি খেলা হয়, অধিকাংশ এলাকায় নারী বনাম পুরুষের মধ্যে হয় এই খেলা। তাতে অংশ নেন বাচ্চা-বুড়ো সবাই।
নেপাল
১৪ই এপ্রিল নেপালের আনুষ্ঠানিক বর্ষ পঞ্জিকা বিক্রম সাম্বাতের প্রথম দিন। সৌর পঞ্জিকা, যা মূলত প্রাচীন হিন্দু রীতি অনুযায়ী তৈরি করা হয়, তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় কোন দিনে পালন হবে উৎসব, তবে সাধারণত ১৪ই এপ্রিলেই হয় উৎসবটি।
এ দিনে নেপালে নববর্ষ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে। এ দিনে বৈশাখ উৎসব নামে সার্বজনীন এক উৎসব হয় দেশজুড়ে।
বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি হয় দিনটিতে, উৎসবের আমেজে ভালো খাওয়া-দাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় আর নানা খেলাধুলার আয়োজন করা হয়।
তবে নেপালে চন্দ্রবর্ষের প্রথম দিন, যার নাম সোনাম লহসারও উদযাপন করা হয়, সেদিনও সরকারি ছুটি থাকে দেশটিতে।
লাওস
লাওসেও সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী বৈশাখের প্রথম দিনটি পালন করা হয়। স্থানীয়ভাবে এর নাম সংক্রান বা পি-মেই, যার মানে নতুন সংক্রান্তি বা নতুন বছর।
দেশটিতে তিন দিন ধরে চলে উৎসব আনুষ্ঠানিকতা।
ভারত
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু তারও বহু বছর আগে থেকে পঞ্জিকা দেখে যেসব দিন আর ক্ষণ উদযাপন হত, সেগুলো এখনো দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে পালন করা দেশটির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করা হয়। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, মনিপুর, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন হয় বৈশাখের প্রথম দিন:
পাঞ্জাব- বৈশাখী, কেরালা- ভিষু, আসাম- বিহু, তামিল নাড়ু- পুথান্দু, উড়িষ্যা- পান সংক্রান্তি, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা- পহেলা বৈশাখ।
সূত্র: বিবিসি
এসএ/
আরও পড়ুন