ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

সত্তর দশকে রোজার ঈদ

মোহাম্মদ মাসুদ খান 

প্রকাশিত : ১১:৪৮, ২১ এপ্রিল ২০২৩ | আপডেট: ১১:৫৯, ২১ এপ্রিল ২০২৩

Ekushey Television Ltd.

ইলেক্টিনিক্স ডিভাইসে নিমগ্ন আমাদের ছেলেমেয়ারা কি জানে স্বাধীনতা-উত্তর এই দেশে সত্তর দশকে কেমন ছিল রোজার ঈদ আনন্দ? পাকিস্তান আমলের পঞ্চাশ-ষাট দশকের কথা না হয় বাদই দিলাম। নতুন প্রজন্মের কাছে এসব হয়তো অজানা অধ্যায়। 

স্মৃতি হাতড়ে তাই তাদের জন্যই আমার এই আজকের (২০ এপ্রিল ২০২৩, ২৮ রমজান ১৪৪৪) প্রয়াস।   

মুক্তিসংগ্রামের ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিল সত্তর দশকের প্রথম রোজার ঈদ। সে ঈদে দেশবাসীর ঈদ আনন্দ ছিল না। দিনটি ছিল শনিবার, ২০ নভেম্বর ১৯৭১। চূড়ান্ত বিজয়ের তখনও ২৬ দিবস বাকী। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ আর নির্মম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছিল সত্তর দশকের প্রথম ঈদ-উল ফিতর।

এবার আসা যাক সত্তর দশকের অন্যান্য কয়েকটি রোজার ঈদের কথায়। 

সাড়ে সাত কোটি জনতার সদ্য স্বাধীন দেশ। এতো রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট, ব্রীজ সত্তর দশকে ছিল না। যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল নৌপথ। রেলপথও ছিল অন্যতম মাধ্যম। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেতে এক-দুই দিন লেগে যেতো। সড়ক পথেও একই অবস্থা। অসংখ্য ফেরী পারাপারের প্রয়োজন পড়তো। যেমন ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে ৩-৪টি ফেরী পার হতে হতো। 

কাঁচপুরে শীতলক্ষ্মা, গজারিয়াতে মেঘনা আর দাউদকান্দির কাছে গোমতীতে ফেরীর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পর কুমিল্লায় পৌঁছতে ৮-১০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগতো। দুরবর্তী অন্যান্য জেলার কথা নাই বা বললাম। সত্তর দশকে ঈদ যাত্রায় ফেরী পার হতে গিয়ে অনেক যাত্রীবাহী বাস নদীতে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।  

সে সময় শহুরে জীবনে ঈদের আনন্দ আঁচ করা গেলেও গ্রামীণ জনপদে ঈদকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। কেবল ঈদ্গাহে ঈদের জামাতই ছিল ঈদ উপলব্ধি করার একমাত্র উপায়। নতুন জামা-কাপড় কেনার  সামর্থ সিংহভাগ গ্রামীণ মানুষের ছিল না। ঈদের দিন ভালো খাবারের আয়োজন করাও ছিল তাদের জন্য দুরূহ। তবে অবস্থাপন্ন মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যতো। তাদের ঘরে ভালো-মন্দ রান্না হতো।

শহুরে জীবনে সত্তর দশকেও রোজার ঈদের আনন্দ অনেকটা টের পাওয়া যেতো। মুলত শব-ই বরাতের পর থেকেই রমজানের রোজা আর ঈদের প্রস্ততি শুরু হয়ে যেতো। 

ঈদ কার্ডের প্রচলন ছিল, তাও আবার হাতে আঁকা। কেবল শিক্ষিত সমাজেই ঈদ কার্ড আদান-প্রদান হতো। টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠানে ঈদের নাটক, ম্যগাজিন অনুষ্ঠান আনন্দ মেলা হতো। যতদূর মনে পড়ে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইদ এমন একটি ঈদ আনন্দ মেলা উপস্থাপনা করেছিলেন। 

সিনেমা হলগুলোতে ঈদ উপলক্ষে নতুন ছবি মুক্তি পেতো। সেই ছবি দেখতে হলে প্রচুর মানুষ ভীড় করতো। ১৯৭৯ সালের রোজার ঈদে এমনি একটি ছবি দেখতে শ্যামলী সিনেমা হলে আব্বা-আম্মা, ভাই বোন আমরা সবাই গিয়েছিলাম।

রোজার ঈদে শিশুরা কম বেশি নতুন জামা-জুতা পেতো। প্রায় ঘরে ঈদের দিন সেমাই-জর্দা তৈরি হতো। সে সময় অধিকাংশ পোষাক দর্জির কাছে বানানো হতো। ঢাকাবাসীর একমাত্র মার্কেট ছিল নিউমার্কেট। সে সময় ছিল বেল বট্ম পোষাকের যুগ। অতিরিক্ত ঢোলা প্যান্ট পায়জামা পড়তো ফ্যাশন সচেতন তরুণ-তরুণীরা।  

অধিকাংশ পরিবারে ছেলেমেয়েরা কেবল রোজার ঈদেই নতুন পোষাক পেতো। কেউ কেউ হয়তো কেবল একটি মাত্র নতুন জামা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতো। জামা পেলে পায়জামা বা জুতো পাবার প্রশ্নই ওঠে না। সত্তর দশকে এতেই সবাই খুশী থাকতো।  
ছোটরা তাদের নতুন পোষাক লুকিয়ে রাখতো। ঈদের আগে কাউকে দেখাতো না, দেখলে ‘ঈদ হবে না’, এমন একটা সাইকোলজি শিশুদের মনে কাজ করতো। 

এ প্রসঙ্গে এক রোজার ঈদের কথা বলি। সময়টা ১৯৭৬ সাল। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সে বছর ঈদে আমি দুটি শার্ট পেয়েছিলাম। তবে আব্বা কিন্ত আমার জন্য একটি শার্টের কাপড়ই এনেছিলেন, কিন্ত আম্মার সেটি পছন্দ না হওয়ায় আব্বা পরে আরেকটি শার্টের কাপড় আমার জন্য কিনে এনেছিলেন। মনে আছে, আব্বা ২য় শার্টের কাপড়টি আম্মার হাতে দিয়ে বললেন এটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট পলিস্টার কাপড়। আমি তো বেজায় খুশি। এবার ঈদে তাহলে দুটি জামা পাবো। এক এক করে দুটি জামাই দর্জির দোকানে বানাতে দেওয়া হলো, একটি শার্ট ঈদের ৭-৮ দিন আগেই বানানো হলো আর বাকীটা তৈরি হলো চাঁদ রাতে মানে ঈদের আগের দিন।

পরের দিন সকালে যথারীতি হান্ড্রেট পার্সেন্ট পলিস্টার কাপড় দিয়ে বানানো শার্ট পড়ে অতি আনন্দে বাসা থেকে বের হলাম। সামনের রাস্তায় বেরোতেই পাশের সিঁড়ির শিউলী আমাকে দেখে সুর করে বললো “তোমার এই শার্ট আমি আগে দেখেছি”,  শিউলির কথা শুনে আমার আনন্দ ম্লান হয়ে গেলো। আর আপার ওপর রাগ হলো, আপাই সম্ভবত আমার ঈদের জামা ওদেরকে দেখিয়েছে। 

যাই হোক মনে মনে ভাবলাম তাতে কী, আরও একটা নতুন শার্ট তো আমার আছেই, এই ভেবে কিছুক্ষণ পর আবার বাসায় ফিরে গেলাম। আগের শার্টটি খুলে আম্মার কাছে ২য় শার্টটি চাইলাম। সঙ্গত কারণে আম্মা তা দিতে প্রথমে রাজী হননি। পরে আমার পীড়াপীড়িতে দ্বিতীয় শার্টটি পড়তে দিলেন। সেই শার্ট পড়ে আবারও দ্বিগুণ আনন্দে বাইরে বের হলাম। যথারীতি শিউলির সঙ্গে আবারও ওদের বাসার সামনে দেখা, আমাকে অবাক করে দিয়ে সে এবারও বললো “এই শার্টের কাপড়টিও আমি আগে দে-খে-ছি”। 

দ্বিতীয় বার শিউলির মুখে এমন কথা শুনে আমার মেজাজ একেবারেই খারাপ হয়ে গেলো। বাসায় ফিরে শার্ট খুলে ফ্লোরে শুয়ে গড়াগড়ি করে কান্না কাটি শুরু করলাম। আম্মা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন বটে। 

দুটি জামাই শিউলি আগে দেখে ফেলেছে জেনে মনে হলো এবার বুঝি আমার ঈদটাই হলো না। এমনই অম্ল-মধুর মজার ঈদ দেখা মিলতো সত্তর দশকের সময়টাতে।    

তখন মানুষের আয় রোজাগারও তেমন ছিল না। শেরেবাংলা নগর গার্লস স্কুলের সামনের বাসা থেকে শ্যামলী পর্যন্ত রিকশা ভাড়া ছিল ৫০ পয়সা। ৭২ থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত জন প্রতি ফেতরা ছিল ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। 

ঈদের দিন পাকা মার্কেটের কাছে শাজাহান ভাইয়ের বাবা চটপটি ফুসকা বিক্রি করতেন। পঞ্চাশ পয়সায় এক প্লেট আর পঁচিশ পয়সায় হাফ প্লেট চটপটি পাওয়া যেতো। একটি ফুসকার দাম দশ পয়সা। পঁচিশ পয়সা দিয়ে তিনটি ফুসকা পেতাম। দশ পয়সায় আইসক্রিম আর পঞ্চাশ পয়সায় মাজাদার বেবী আইসক্রিম। সে এক অনাবিল ঈদ আনন্দ ছিল সেই সত্তর দশকে।  

সত্তর দশকে ঢাকায় মানুষও ছিল অনেক কম। সন্ধ্যার পর রাস্তায় খুব কম লোকজনই চলাচল করতো। 

সম্ভবত সালটা ১৯৭৭। রমজান চলছে। আব্বা আমাকে নিয়ে নিউমার্কেট গিয়েছিলেন জুতা কিনে দিতে। ফেরার পথে একটি শেয়ার রিক্সায় আমাকে কোলে নিয়ে উঠলেন। নিউমার্কেট থেকে কলাবাগান, শুক্রাবাদ পেরিয়ে আসদ্গেটে এসে রিক্সাটি যখন বায়ে যাচ্ছিলো। আব্বা তখন চিৎকার করে রিক্সা চালককে বললেন “কোথায় যাচ্ছো?”,“মোহাম্মদপুর টাউন হল” রিক্সা চালক উত্তর দিলেন। 

আব্বা বুঝতে পারলেন ভুল রিক্সায় তিনি উঠেছেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয় এমন অবস্থা। রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা একেবারেই কম, দু একটা বাস মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আব্বা বললেন “ইফতারের সময় ঘনিয়ে এসেছে আমি তাহলে কি করে বাসায় যাবো?” রিক্সা চালক আব্বাকে অভয় দিয়ে বললেন “চিন্তা কইরেন না স্যার আমি ব্যবস্থা করতেছি” এই বলে অল্প সময়ের মধ্যে সেই রিক্সা চালক আরেকটি রিক্সা আমাদের জন্য ঠিক করে দিলেন। দায়িত্ববান সেই রিক্সা চালকের ভাড়া মিটিয়ে আব্বা তাকে ধন্যবাদ দিলেন। দ্বিতীয় রিকশায় আমরা কখন বাসায় ফিরেছি তা আর স্মৃতিতে নেই। 

রোজার ঈদে ছেলেরা সকাল বেলা ঈদ গাহে যেতেন। আমাদের শেরেবাংলা নগর কলোনির বাসিন্দারা পাকা মার্কেট মসজিদ ও আগারগাও জামিয়া মসজিদ সংলগ্ন প্রাথমিক স্কুলের মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। আমাদের লাইনের মুচুরের আব্বা মজিবর রহমান চাচা ঈদের দিন সবার আগে ঈদ গাহে পৌছাতেন। তিনি মাইকে তখন গাইতেন নজরুলের বিখ্যাত সেই গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ”। 

প্রাচুর্যবিহীন সত্তর দশকের রোজার ঈদ ছিল সতিই খুশীর ঈদ।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক,  শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় আলামনাই এসোসিয়েশন।

এএইচ


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি