বিশ্ব সুন্দরী ক্লিওপেট্রার অজানা কাহিনী
প্রকাশিত : ১৬:০৬, ১৬ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১৬:১৮, ১৬ আগস্ট ২০১৯
ক্লিওপেট্রা। নামটি শুনলেই চোখে ভাসে খাড়া নাক, টানা চোখের নারীর কাল্পনিক ছবি। সৌন্দর্যের উপমা দিতে গিয়ে ‘ক্লিওপেট্রার মতো সুন্দর’বলা হয় অনেক সময়। ক্লিওপেট্রাকে বিউটি কুইন বলা হয়। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি আলাদা স্থান দখল করে আছে। আর মিসরীয় সভ্যতার দুয়েকটি বিষয় আছে যেগুলো গোটা সভ্যতার সমার্থক হয়ে ওঠেছে।
পিরামিড, মমির মতো ক্লিওপেট্রাও বছরের পর বছর ধরে এই সভ্যতার সিগনেচার হয়ে ওঠেছে। ফারাও রাজবংশের সর্বশেষ রাণী ক্লিওপেট্রা।
তাকে ঘিরে ইতিহাসে বিতর্ক আর রহস্যের কোনো শেষ নেই। যেমন রহস্যময তার জীবন ও রাজ্য শাসন তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। ক্লিওপেট্রার প্রেম নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গল্প-অনেক কাহিনীর অবতারণা হয়েছে।
গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। এমনকি মহান সাহিত্যিক শেকসপিয়র পর্যন্ত তার নাটকে অমর করে রেখেছেন রানী ক্লিওপেট্রার প্রেমকাহিনীকে। তিনি লিখেছেন অ্যান্টনি-ক্লিওপেট্রা।
অন্যদিকে জর্জ বানার্ড শ লিখেছেন সিজার-ক্লিওপেট্রা। অধিকাংশ সাহিত্যকর্মেই প্রাধান্য পেয়েছে ক্লিওপেট্রার প্রেম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আর প্রায় প্রত্যেকেই আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে নিজস্ব স্টাইলে বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার রূপের। বিখ্যাত লেখক হেনরি রাইডার হগার্ডের লেখা উপন্যাস ক্লিওপেট্রায় তিনি কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিলেও সেখানে ফুটে উঠেছে ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাষ আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়তা।
এ ছাড়াও ক্লিওপেট্রার চরিত্র নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েল প্রমুখ। ফলে হাজার হাজার বছর পরও ক্লিওপেট্রার প্রেম নিয়ে আলোচনা চলছে আজও। লেখালেখিও থেমে নেই।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত নারী শাসক ক্লিওপেট্রার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। তার পুরা নাম. অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী কন্যা ক্লিওপেট্রা ও ১৮ বছর বয়সী পুত্র টলেমি-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩ কে, যখন টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ফলে আইনগতভাবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হলো ক্লিওপেট্রা এবং তার স্বামী ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই ত্রয়োদশ টলেমি এর উপর। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে গেলেন।
এরই মধ্যে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হলেন। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরার পথে ফারসালুসের হাতে নিহত হন। যুদ্ধ থেকে পালাতে গিয়ে ক্লিওপেট্রার স্বামী ও ভাই টলেমি-১৩ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা হয়ে ওঠেন মিসরের একচ্ছত্র রানী।
এরমধ্যেই পটভূমিতে আবির্ভাব ঘটলো রোমের পরাক্রমশালী বীর মার্ক অ্যান্টনির। লোকমুখে তিনি ক্লিওপেট্রার রূপ-লাবণ্যের কথা শুনেছিলেন। কিন্তু কিভাবে সেই রূপ-লাবণ্য চাক্ষুষ করবেন? একদিন তিনি রোম থেকে এসে হাজির হলেন ক্লিওপেট্রার কারুকার্যশোভিত প্রাসাদের সামনে। এই খবর গোপন থাকার কথা নয়। দ্রুতই বীর অ্যান্টনির আগমনের খবর পেয়ে গেলেন রানী ক্লিওপেট্রা। মার্ক অ্যান্টনির কথা তিনিও শুনেছেন আগেই। সেই শুরু। অবশ্য কারও কারও মতে মিসর আক্রমণ করতে এসে ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান রোমান বীর অ্যান্টনি। তবে উভয়ক্ষেত্রেই প্রথম দর্শনেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে যান বলে মনে করা হয়। অ্যান্টনির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রকট রূপ নিল। শক্তিশালী রোমান বীর যেন ক্লিওপেট্রার ললিতবিভাসে মোমের মতো গলতে লাগলেন। কেবলই অপলক তাকিয়ে থাকা। যতই দেখেন, ততই দেখার আকর্ষণ বেড়ে যায়। চোখের তৃপ্তি হয় না যেন কিছুতেই। এরপর একে অন্যের মধ্যে দেখতে লাগলেন তাদের পরবর্তী জীবন। মার্ক অ্যান্টনি মশগুল ক্লিওপেট্রার প্রেমে। আর ক্লিওপেট্রাও নিঃসঙ্গ জীবনে কেবল একটি সঙ্গীই নয়, বরং তার সিংহাসন রক্ষায় এক পরাক্রমশালী বীরের সমর্থন পেয়ে গেলেন।
তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে অ্যান্টনিওর জীবন। পত্নী ফুলভিয়ার মৃত্যু এবং পম্পের বিদ্রোহ ঘোষণা এলোমেলো করে দিল বীর অ্যান্টনির সুবর্ণ সময়কে। গৃহযুদ্ধে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো রোম। এরপর গল্পে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। এর মধ্যেই ক্লিওপেট্রার জীবনে আবির্ভাব ঘটে মধ্যবয়সী বীর জুলিয়াস সিজারের। এলোমেলো মুহূর্তে সিজারকেও আকড়ে ধরেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। একসময় অসহায় অ্যান্টনি আত্দহত্যা করেন। সবকিছুর পরিণামে ক্লিওপেট্রাও সাধের জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
আরেকবার পেছনে ফেরা যাক। এই এলোমেলো অবস্থার পেছনে রোমের গৃহযুদ্ধকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়। রোমের গৃহযুদ্ধের নায়ক পম্পে। সিজারের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ। জনসাধারণকে তিনি বুঝিয়েছেন, সিজার ও তার পৃষ্ঠপোষকরা ভীষণ অবিচার করেছেন পম্পের পিতাকে অকারণে হত্যা করে।
পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তার এই বিদ্রোহ।সিজার শুনতে পেলেন, তার বিরোধীরা দল বেঁধে পম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অথচ দেশের এ দুর্দিনে অ্যান্টনি ভোগবিলাসে আত্দহারা ক্লিওপেট্রার সঙ্গে। পড়ে আছেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপ্রাসাদে। সিজার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তার একান্ত বিশ্বস্ত লেপাডাইসের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন দূতকে পাঠালেন মিসরে। অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও সফল হলেন তিনি। খ্রিস্টের জন্মের ৪৯ বছর আগে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটল পম্পের পরাজয়ে।
পম্পে পালিয়ে গেলেন ক্লিওপেট্রার দেশ আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সিজার তখনও বীজয়ী সিংহের মতো হুংকার তুলছিলেন। তার উদ্দেশ্য একটাই শত্রুর বিনাশ। তাই সিজার তার অনুচরদের আদেশ দিলেন যে করেই হোক পম্পেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। অনুচরদের কাছে খবর এলো পম্পে পালিয়ে যাচ্ছে ক্লিওপেট্রার দেশে। ওঁত পেতে রইল তারা। সেখানে পম্পে যাওয়া মাত্র সিজারের অনুচররা ছুরিকাঘাতে হত্যা করল পম্পেকে। এরপর সিজার তার দূতের মাধ্যমে ক্লিওপেট্রাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। মজার ব্যাপার এই যে, প্রস্তাব শুনে ক্লিওপেট্রা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ক্লিওপেট্রার জীবনে শুরু হলো অন্য এক পর্ব। সিজারের সমর্থনে ক্লিওপেট্রা আরও একবার নিজের সিংহাসনকে নিরাপদ করতে চাইলেন এবং মিসর শাসন করতে লাগলেন।
৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্লিওপেট্রা যখন রোমে অবস্থান করছিলেন আর একজন রানী হয়ে তারই অধস্তন এক জেনারেলের সঙ্গে রাজ প্রসাদে একত্রে বসবাসের কারণে চারদিকে কানাঘুঁষা শুরু হলো। এর মধ্যেই ঘটে গেলো আরেক আশ্চর্য ঘটনা। ক্লিওপেট্রার একটি পুত্রসন্তান হলো। আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা তার নাম দিল সিজারিঅন। ক্লিওপেট্রা বলতেন, টলেমি সিজার।
কিন্তু সিজারের আইনসম্মত উত্তরাধিকারী এবং ভাগ্নে অক্টোভিয়ান এটা মেনে নিলেন না। সিজার অবশ্য প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতে লাগলেন যে, সিজারিঅন তারই সন্তান। অনেকেই ভাবলেন, এটা সিজারের এক ধরনের চক্রান্ত, তিনি একে তো একজন বিদেশি তার ওপর বিবাহিত হয়েও ক্লিওপেট্রার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। আর এটা কোনো নিয়মের মধ্যেই পড়ে না।
অন্যদিকে একই সময় ক্লিওপেট্রা নানাদিক থেকে চরম সমস্যার মুখোমুখি হতে লাগলেন। এর মধ্যে ৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কোনো এক উৎসবের দিনে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটল। রোমের সিনেট বিল্ডিংয়ের সন্মুখ চত্বরে সিজার ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন। ব্রুটাসের নেতৃত্বে ক্যাসিয়াস, ট্রিবোনিয়াস, কেস্কাসহ ৬০ জন সিনেট সদস্যের প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি মারা গেলেন। সিজার হত্যাকাণ্ডের পর ক্লিওপেট্রা রোম থেকে পালিয়ে জন্মভূমি আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। মৃত্যুর আগে সিজার কখনো স্বীয় পুত্র বা ক্লিওপেট্রাকে কোনো উইল করে যেতে পারেননি। কাজেই তিনি তো গেলেনই, তার পুত্রের জীবনও চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে পতিত হলো।
আলেকজান্দ্রিয়ায় ফেরত আসার সময় ক্লিওপেট্রার সম্বল ছিল কেবল তার দ্বিতীয় স্বামী অর্থাৎ পরবর্তী ভাই টলেমি-১৪। সেও এক সময় নিহত হলো এবং সিজারিঅনই শেষ পর্যন্ত ৪ বছর বয়সে পরবর্তী রাজা হিসেবে উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হলেন। ক্লিওপেট্রা ফিরে এসে দেখলেন, সমগ্র আলেকজান্দ্রিয়া দুর্ভিক্ষ আর মহামারিতে সয়লাব। দীর্ঘদিন ধরে চলতে লাগল এই দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। সিজারিঅনের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা চেয়ে তিনি চারজন পদাতিক সৈন্যকে সিজারের প্রাক্তন এক লেফটেন্যান্ট 'দোলাবেলা' বরাবর পাঠালেন যার সুপারিশপত্র সিজারই এক সময় মিসরে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই চিঠি দোলাবেলার কাছে পৌঁননি। পথিমধ্যে ওই চারজন পদাতিককে 'ক্যাসিয়াস' নামে সিজারের এক হত্যাকারী আটক করে। ফলশ্রুতিতে দোলাবেলা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আর কোনো উপায় না দেখে ক্লিওপেট্রা বিশাল এক নৌবহর সাজিয়ে মার্ক এন্টনি ও অক্টোভিয়ানের উদ্দেশে নোঙর তোলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সেই যাত্রা শুরুতেই ঝড়ের কবলে পড়ে শেষ হয়ে যায়। ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াস নিহত হলে রোমের পরবর্তী কর্ণধার হিসেবে এন্টনি, অক্টোভিয়ান ও লেপিডাসই হবেন পরবর্তী বিজয়ী। আর ক্লিওপেট্রা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এদের মধ্যে কার সঙ্গে তার ভালো যাবে! অক্টোভিয়ান ভীষণ অসুস্থ হয়ে এক সময় ইতালি ফেরত গেলেন। কাজেই এন্টনি থাকলেন ক্লিওপেট্রার পর্যবেক্ষণে।
৪১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মার্ক এন্টনির পক্ষ থেকে টারসাস সফরের দাওয়াত পেলেন ক্লিওপেট্রা। ইতোমধ্যে তিনি এন্টনিকে কিভাবে পেতে হবে সে সম্পর্কে ভালোভাবেই জেনে গিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রা এও জানতেন যে, এন্টনির কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা যা কিছু সবই সীমিত আর শরীরেও নীলরক্ত। সুরায় আসক্তি, নারীলোভী, উচ্ছৃঙ্খলতা আর উচ্চাভিলাষ। তা সত্ত্বেও মিসর ছিল অর্থনৈতিক দুরবস্থার শেষ সীমায় উপনীত। ক্লিওপেট্রা ব্যাপক এক সংবর্ধনার আয়োজন করলেন এন্টনির সৌজন্যে।
আর সেই যাত্রাকেও এমনভাবে সাজালেন যা কোনোদিন কেউ দেখেনি, নিজেও সেভাবেই সাজলেন ঠিক যেন প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির মতোই। শহরে প্রবেশটা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক, ভালগারে পরিপূর্ণ, অর্ধ উলঙ্গ নারীদের প্রদর্শনী যা একজন ভালগার-মানুষকে আকৃষ্ট করতে ছিল যথেষ্ট। এন্টনি নিজে একজন ব্লু-ব্লাডেড হয়ে আরেকজন ব্লু-ব্লাডেড টলেমীয় রমণীর ধ্যান-ধারণা তো পছন্দ করবেনই। এন্টনির সাবেক স্ত্রী বা বর্তমান স্ত্রী ফুলভিয়া সবাই তো অত্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আগত।
ক্লিওপেট্রা আর এন্টনি ৪১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৪১-৪০ পর্যন্ত শীত মৌসুম আলেকজান্দ্রিয়ায় কাটালেন। ক্লিওপেট্রা চাইলে সবকিছুই পেতে পারতেন যা মনে চাইত। কিন্তু পরে এন্টনির ওপর ক্লিওপেট্রা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। আসলে ওই সময় ক্লিওপেট্রা একবারেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এন্টনি চেয়েছিলেন অর্থসম্পদ আর ক্লিওপেট্রার উদারতা ছিল মূলত যেখানে লাভের ব্যাপার থাকত।
৪০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, মার্ক অ্যান্টনি আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরে যান। এভাবে ৪ বছর কেটে গেলো, আর দেখা হয়নি দু'জনের। অ্যান্টনির স্ত্রী ফুলভিয়া সেখানে অক্টোভিয়ানের বিরুদ্ধে জমিজমা সংক্রান্ত বিরাট একটা আন্দোলনের মুখে পড়েন। এর মধ্যে ফুলভিয়া খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। অ্যান্টনি ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে সেই শরতেই অক্টোভিয়ানের বোন অক্টোভিয়াকে বিয়ে করেন। অক্টোভিয়া খুবই সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি রমণী ছিলেন এবং খুব অল্পদিন আগে তিনি বিধবা হন। আগের পক্ষে তিনটি সন্তানও ছিল। আর সেই মুহূর্তেই আলেকজান্দ্রিয়ায় ক্লিওপেট্রা মার্ক অ্যান্টনির ঔরসে ছেলে মেয়েসহ যমজ সন্তান প্রসব করেন।
আর অ্যান্টনি-অক্টোভিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান হলো মেয়ে। যদি অক্টোভিয়ার গর্ভে পুত্রসন্তানের জন্ম হতো তাহলে হয়তো ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিত। অ্যান্টনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের খবর রাখতেন, তা থেকে নিজের জন্য কত প্রয়োজন তারও হিসেব করতেন। এভাবেই এলোমেলো হয়ে চলতে লাগলো ক্লিওপেট্রার জীবন।
ক্লিওপেট্রা আর মার্ক এন্টনির প্রেমের কথা তখন রাজ্যের প্রধান আলোচনার বিষয়। সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক মতোই। এরই মধ্যে দু'জনের সম্পর্ক যেন আগের চেয়ে অনেকটা ফিকে হয়ে এলো। তবুও এন্টনি ক্লিওপেট্রার জন্য করেছেন অনেক কিছুই। এরই মধ্যে এন্টনি পার্থিয়ানের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য গ্রিস ছেড়ে ইতালি গেলেন।
ইতোমধ্যে অক্টোভিয়া আরো একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। অ্যান্টনি জানালেন, কন্যাসন্তান জন্মদানের ব্যাপারটি তিনি মেনে নিয়েছেন। কারণ তার ভাই অক্টোভিয়ানের সঙ্গে এখনো শান্তি স্থাপনে অনেক করণীয় রয়ে গেছে। তাই রোমে অবস্থান করাই তার জন্য যুক্তযুক্ত হবে। কিন্তু অ্যান্টনি প্রথমেই ক্লিওপেট্রার জন্য কিছু করতে চাইলেন।
অ্যান্টনি-ক্লিওপেট্রা দম্পতির যমজ সন্তানের অফিসিয়াল স্বীকৃত ছিল অ্যান্টনির নামেই,নামও দেয়া হয়েছিল সেভাবেই; আলেকজান্ডার হেলিওস ও ক্লিওপেট্রা সেলিনি। রাজ্য ভাগ করতে গিয়ে মার্ক অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রাকে দিলেন বিশাল কৃষিক্ষেত্র। এটি ক্লিওপেট্রা এবং মিসরের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। অ্যান্টনি দিলেন সাইপ্রাস, সিলিসিয়ান বেলাভূমি, ফোনিসিয়া, কোয়েলি-সিরিয়া, জুদিয়া এবং আরব ভূখন্ড। এ অনুদান মিসরকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো ব্যবস্থা করে দিল এবং বিশাল নৌবহর গঠন করতেও সমর্থ হলো। অ্যান্টনির পরিকল্পনা ছিল পাথিয়ানের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা। এজন্য অ্যান্টনির প্রয়োজন ছিল ক্লিওপেট্রার সমর্থন।
কিন্তু ৩৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে পার্থিয়ানের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি হেরে গেলেন। এজন্য ক্লিওপেট্রার প্রতি তার ঋণের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরো বেড়ে গেল। আর তাদের তৃতীয় সন্তানেরও জন্ম হলো তখন। তারা যখন সিরিয়া প্রত্যাবর্তনের পথে, ক্লিওপেট্রা সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ, কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার, বেতনভাতা ইত্যাদি নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ৩৫ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের প্রথম দিকে অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে আবার মিসরে ফিরে এলেন। ওদিকে এন্টনির স্ত্রী অক্টোভিয়া তখন এথেন্স-এ সরবরাহ ও পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছিলেন আর স্বামীর জন্য প্রতীক্ষায় দিন গুনছিলেন।
অ্যান্টনি তাকে একটা চিঠি পাঠালেন, তিনি যেন কোনোভাবেই মিসরে না আসেন। অক্টোভিয়ার ভাই অক্টোভিয়ান নানাভাবে উসকানি দিয়ে যাচ্ছিলেন এন্টনির সঙ্গে কোনো মতে একটা যুদ্ধ বাধানোর জন্য, যেটা একপ্রকার অলঙ্ঘনীয় হয়ে পড়েছিল। এন্টনিও হয়তো কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারতেন যদি অক্টোভিয়া ও তার ভাই অক্টোভিয়ানকে রোমে পেতেন। ক্লিওপেট্রা হয়তো অ্যান্টনিকে আলেকজান্দ্রিয়ায় রেখে ভালোই করেছিলেন। এসব সত্ত্বেও অক্টোভিয়া এন্টনির প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ত ছিলেন। ৩৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মার্ক এন্টনি আর্মেনিয়া রাজ্যের জনসাধারণের মধ্যে জনমত গঠনে নামলেন, যা পরবর্তীকালে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সাফল্য বয়ে আনে।
এসব পূর্বাপর বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে তিনি দেশব্যাপী এমনকি আলেকজান্দ্রিয়াসহ উৎসবের আয়োজন করেন, ক্লিওপেট্রাকে 'নতুন আইসিস' হিসেবে তুলে ধরার মানসে তাকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির মর্যাদায় ভূষিত করেন। এন্টনিও প্রাচীন গ্রিক-রোমান শাসনের প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে 'নতুন ডিওনাইসাস' হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা ছিল তার বহুদিনের স্বপ্ন। কিছুদিনের মধ্যে আরো অনেক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, শিশু-উৎসব অনুষ্ঠান করলেন যেখানে শিশুদের জন্য রাজকীয় উপাধি প্রদান এমনকি রাজ সিংহাসনে তাদের নিয়ে বসারও সুযোগ দিলেন।
খ্রিস্ট পূর্ব ৩২-৩১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এন্টনি চূড়ান্তভাবে অক্টোভিয়ানের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালেন। এই ঘটনা সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে এটাই প্রমাণ করল যে, ক্লিওপেট্রার সঙ্গে তার সত্যিকারের প্রণয় রয়েছে। ফলশ্রুতি দাঁড়ালো এই যে, রোমানদের সঙ্গে এন্টনির বিশ্বস্ততা, নির্ভরতা, সহযোগিতা ইত্যাদি সবকিছুরই পরিসমাপ্তি ঘটল। অক্টোভিয়ান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এন্টনির 'উইল' প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন আর সে সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও করলেন। অন্য অনেকের মনে এটাও ধারণা হলো যে, অ্যান্টনি সম্মিলিত শক্তিতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকেই বিশ্ব জয়ের সূচনা করবেন।
কিন্তু দেখা গেল, ৩১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ২ সেপ্টেম্বর অক্টোভিয়ান নৌবাহিনীর কাছে অক্টিয়াম (গ্রিস)'র যুদ্ধে এন্টনির মর্মান্তিক পরাজয় ঘটল। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে (৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) দ্বিতীয়বারের মতো আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখে অগ্রসরমান অক্টোভিয়ান বাহিনীর মুখোমুখি হলেন এন্টনি। পরাজয় যেন নির্ধারিতই ছিল। আর পরাজিত এন্টনি নিজের তরবারি দিয়েই আত্মহত্যা করলেন; পেছনে পড়ে রইল বিশাল রোমান সাম্রাজ্য-গ্রিস, ইতালি, মিসর আর ক্লিওপেট্রা ও তার আলেকজান্দ্রিয়া। এন্টনির মৃত্যুর পর কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিওপেট্রাকে অক্টোভিয়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
এর আগেই ক্লিওপেট্রাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হলো। ক্লিওপেট্রাকে মারার জন্য আনা হলো চরম বিষাক্ত সাপ 'অ্যাসপ' [মিসরীয় কোবরা]। ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে সেই কোবরাকে আনা হলো ক্লিওপেট্রার সামনে। এই সাপের কামড়েই ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা মারা গেলেন। আবার আরেকটি মতানুসারে পরাজয়, প্রেমিক এবং রাজ্য হারানোর শোকে ক্লিওপেট্রা তার ব্যক্তিগত কক্ষে একটি সাপ আনিয়ে আত্দহত্যা করেন। ক্লিওপেট্রার এই রহস্যময় জীবন আর প্রেমের অমর রহস্য সম্ভবত কখনোই পুরনো হবে না।
আরও পড়ুন