ঢাকা, শুক্রবার   ১৪ মার্চ ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

আলো, স্বর্গের পরী ও মানবিকতা

আবীর দে

প্রকাশিত : ১৯:৩৪, ২২ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ২০:২৭, ২২ আগস্ট ২০২০

Ekushey Television Ltd.

মাত্রই ডাক্তার দেখিয়ে বের হয়েছিলাম আমি, জাহরা এবং ওর আম্মু। মিরপুরস্থ ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের নিচে দেখা গেলো একটা অদ্ভুত দৃশ্য। এক পৌঢ় একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে সাহায্য চেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক কি যেন ছিলো মেয়েটার মুখশ্রীতে...। স্বর্গের পরীকে মাটিতে নামালে যা হয়, তেমন-ই হয়েছিল। মলিন চেহারা আর সারা মুখে কেমন একটা যন্ত্রণা। বয়সের স্বাভাবিক দুরন্তপনাও নেই ওর মধ্যে। 

এগিয়ে গেলাম পরীর দিকে। পৌঢ় লোকটি ওর বাবা, আর পরীর নাম হচ্ছে ‘আলো’! মাতৃহীন, ঠিক কয়েকমাস আগে আলো তার মাকে হারিয়েছে। রিকশাচালক বাবা তাই তাকে ফেলে কাজে যেতেও পারছে না। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। তাই বাধ্য হয়েই সাহায্যের জন্য হাত পাতছেন মানুষের কাছে।

ইতিমধ্যে আমরা দশ টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম বটে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার জন্য কিছু করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। গলায়, হাঁটুতে এলার্জির চিহ্ন আর ফ্যাকাশে মুখ দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- এই পরীটাকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

নিয়ে গেলাম মিরপুর-২ এ অবস্থিত ডাঃ এম আর খান শিশু ইনষ্টিটিউটে। সেদিন ছিলো শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফারহানা রাহাতের ডিউটি। ভিজিট দিয়ে বসে রইলাম অপেক্ষায়। ফ্যানের বাতাসে আরাম পেয়ে ততক্ষণে চেয়ারেই সুখনিদ্রায় চলে গেছে আলো। সারাদিন রাস্তায় তো হাঁটার কথা ছিলো না তার, এই বয়সে।

চেয়ারেই সুখনিদ্রায় চলে গেছে আলো

ভাগ্যের ফেরে বই-খাতা আর বন্ধুদের ফেলে বাবার সঙ্গে রাস্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে আলোকে। ইতিমধ্যে চলে এলো আমাদের সিরিয়াল। ডাক্তার খুব ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলেন আলোকে। জিজ্ঞেস করলেন সমস্যার কথা। দেখার পালা শেষ হলে তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন আর আমাদের সাথে কথা বলা শুরু করলেন।

প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, আলো আমাদের কি হয়? আজই রাস্তায় পরিচয় এবং সবকিছু শুনে একটু থমকে গেলেন। এরপর দিয়ে দিলেন বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। ডাক্তার মানেই যে কসাই না, তার প্রমাণ আরেকবার পেলাম যখন তিনি ভিজিট-এর থেকে ২০০ টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলেন! আমরাই গ্রহণ করলাম না।

এরপর আলোকে ১৪ দিনের ওষুধ কিনে দিলাম আমরা। সাথে ওর শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য কিছু টাকাও। একবার কান্নার চোরাস্রোত টের পাচ্ছিলাম চোখের কোণে। কেন আমাদের সামর্থ্য এতো কম- এই ভেবে। হয়তো আজ স্টুডেন্ট না হলে আরো কিছু করতে পারতাম আলোর জন্য।

ওর বাবা জানালো- মেয়েকে নিয়ে উনার স্বপ্নের কথা। মেয়েকে মাদ্রাসায় দিয়ে পড়াশোনা শেখাবেন আর নিজে কাজে লেগে পড়বেন। "পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে কিন্তু খারাপ বাবা একজনও নেই" -এই কথাটা মনে পড়ছিল তখন। মেয়ের ব্রেইন শার্প, তাই পড়াশোনা করালে হয়তো দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারবে মেয়েটা।

বিদায়বেলায়, গালে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম ওকে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা ওর পড়াশোনার খরচও আমরা বহন করবো দরকার পড়লে। এই স্বর্গের পরী যেন তার স্বর্গীয় সুষমা ছড়িয়ে বেড়াতে পারে সমাজে। আলোরা যাতে হারিয়ে না যায় শিক্ষার আলোর অভাবে।

আমি বর্তমানে শেকড় নামে একটি প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত আছি। আমাদের উদ্দেশ্য হলো- অন্তর্নিহিত মানবিক গুণাবলীগুলো চর্চা করা এবং মানুষের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়া। দৈনন্দিন জীবনের এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমেই আমরা আমাদের মানবিক গুণাবলীগুলো আবিষ্কার করতে পারি, যা আমাদের জীবনকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারে।

লেখক- শিক্ষার্থী (চতুর্থ বর্ষ), আরবান এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি