যৌন হয়রানি ও নারীদের নিত্যদিনের গল্প
প্রকাশিত : ১৯:০৯, ২২ আগস্ট ২০২০
প্রতীকী ছবি
রাত ৮টা ৪০মিনিট। শায়লার বান্ধবীর জন্মদিন ছিলো। তাই জন্মদিন সেলিব্রেট করে ফিরতে কিছুটা দেরী হয়ে গেলো। বান্ধবীর বাসা থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার পথে হঠাৎ শায়লা অনুভব করলো- দুইজন অপরিচিত মানুষ তার পিছু পিছু আসছে। যখনই সে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে, মানুষ দুটো খুব অদ্ভুত বিকৃত একটা মুচকি হাসি দিচ্ছে আর নোংরা অঙ্গভঙ্গি দেখাচ্ছে। শায়লা খুব দ্রুত বাসস্ট্যান্ড এসে মানুষের মধ্যে দাঁড়ালো এবং কিছুটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললো।
বাস এলো এবং ভিড় থাকা সত্ত্বেও সে উঠে পড়লো। সিট ফাঁকা না থাকার কারণে তাকে রড ধরে চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। এরই মধ্যে অদ্ভুতভাবে সে আবিষ্কার করলো- এক মধ্য বয়স্ক পুরুষ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তার উপর বার বার ঝুঁকে পড়ছে। সে যতই নিজেকে সংকুচিত করে সামনে চাপিয়ে রাখছে, ওই লোক বাজেভাবে বারবার গায়ে এসে পড়ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। তার হাসি দেখেই শায়লা বুঝে গিয়েছিলো এটা ইচ্ছাকৃত।
কিছুক্ষণ পর একটা সিট ফাঁকা হলো এবং শায়লা সেখানে বসে পড়লো। হঠাৎ তার পাশের সিটের এক লোক তার ব্যাগের নিচে হাত রেখে বার বার শায়লার দেহকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিলো। এতে শায়লা খুব অস্বস্তি অনুভব করা সত্ত্বেও কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না।
এই "শায়লা" কিন্তু আর কেউ নয়। আমাদের দেশের প্রতিটি মেয়ের নিত্যদিনের গল্প। নারীরা প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা চুপচাপ এগুলো সহ্য করি। ফলে দিন দিন এই হয়রানি বেড়েই চলেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত ৩/৪ বছরে তুলনামূলকভাবে এরকম যৌন হয়রানি এবং নির্যাতন দ্রুতহারে বেড়েছে। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন এর কারণ কি? এর সমাধান কোথায়?
আমরা দৈনন্দিন জীবনে এই সমস্যার ভুক্তিভোগী প্রায় সমগ্র নারীজাতি। কিন্তু সেই তুলনায় প্রতিবাদের স্বর খুবই ক্ষীণ। সবাই নিশ্চুপভাবে সবটা সহ্য করে যাওয়ায় দিন দিন হয়রানি বেড়েই যাচ্ছে।
লেখক- অর্নিতা দাস
আমাদের দেশের একাংশ মানুষ দৈনন্দিন হয়রানির জন্য নারী সমাজকেই দায়ী করেন। তাদের চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ইত্যাদি। আসলে কি শুধু এটাই কারণ? মুদ্রার একটা পিঠ দেখলেই হবে! ওপিঠটাও যাচাই-বাছাই করে দেখুন।
এই হয়রানি সাধারণত দুই ধরনের। যেমন- শারীরিক হয়রানি এবং মানসিক হয়রানি। শারীরিক হয়রানি যেমন- ধর্ষণ। এটা যতটা চোখে পড়ে, মানসিক হয়রানি তেমন কারো দৃষ্টিগোচরই হয় না। রাস্তাঘাটে চলাচল করার সময় মেয়েরা বহু মানসিক হয়রানির শিকার হয়, যা তারা চুপচাপ সহ্য করে চলে আসে। তাই শতকরা কতভাগ মেয়ে প্রতিনিয়ত যে মানসিক হয়রানির শিকার হচ্ছে, সেটা হিসাবের বাইরে।
আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ৬ মাসের বাচ্চা থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা, কেউই নরপিশাচদের লোলুপ থাবা থেকে রেহাই পায় না। প্রতিদিন সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে ধর্ষণের খবর খুব সহজলভ্য হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতা দিন দিন তরুণ সমাজের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে। তরুণ সমাজ যেখানে দেশ গঠনের কারিগর, তারাই আবার বিভিন্ন নেশাদ্রব্যসহ ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানিতে জড়িয়ে পড়ছে। দিন যত যাচ্ছে এর মাত্রা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। এভাবে আর কত?
আমাদের সমস্যার মূলে কাজ করতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে। তাহলেই সমাজে পরিবর্তন আসবে। নারীদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করা দরকার। চুপ করে থাকলে আর চলবে না। কথায় আছে, "অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেনো তারে তৃণ সম দহে"। অর্থাৎ- চুপ করে অন্যায় সহ্য করাটাও এক ধরনের অন্যায়। যার ফলে অপরাধী দ্বিতীয়বার অপরাধ করার সুযোগ পায়। তাই যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে হবে।
পাশাপাশি, নারী-পুরুষ সমান অধিকার শুধুমাত্র নথিভুক্ত করলেই চলবে না। এটাকে ব্যক্তি জীবনে নিশ্চিত করতে হবে। নারী সুরক্ষার লক্ষ্যে হয়রানিসহ সকল অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুমাত্র আধুনিক হলেই হবে না, আধুনিক মানসিকতাও পোষণ করতে হবে। আর অবশ্যই শিশুদের বাল্যকাল থেকে নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। যেনো ভবিষ্যৎ জীবনে নৈতিক অবক্ষয়মূলক কোনো কাজে জড়িয়ে না পড়ে।
শিশুদের ছোট থেকেই মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্যে রাখতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে সুন্দর দেশ গড়ে উঠবে এবং হয়রানি হ্রাস পাবে। তাহলেই, শায়লার মতো মেয়েরা নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবে এবং নিরাপত্তাহীনতায় আর গুটিয়ে থাকতে হবে না।
লেখক- শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এনএস/