গতিশীলতাই সুখ, তাতেই সুস্বাস্থ্য
প্রকাশিত : ১৪:৫৪, ৭ আগস্ট ২০২১
Happiness is a state of activity. কথাটি বলেছিলেন গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল। সচল থাকুন, কর্মব্যস্ত থাকুন। আপনি সুখী হবেন। কিন্তু এ তো প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। আমরা আধুনিক মানুষ, জানতে চাই হালের খবর আর তত্ত্ব।
এখন স্বাস্থ্য-গবেষকরা বলছেন রীতিমতো একই কথা। সেটি হলো, সারাদিন কেবল শুয়ে বসে কিংবা বসে থেকে সব কাজ নয়, বরং সুযোগ পেলেই একটু উঠে দাঁড়ান, হাঁটুন, ব্যায়াম করুন। কিছুটা পরিশ্রম আর পেশি সঞ্চালন হতে পারে এমন কাজগুলো করুন আনন্দের সাথে। গতিশীল হোন, যতটা সম্ভব। সুখী হবেন তো বটেই, আপনি সুস্থ থাকবেন। কমবে জটিল সব রোগ-ব্যাধি আর অকালমৃত্যুর ঝুঁকি। সেইসাথে বাড়বে আপনার কর্মময় দীর্ঘজীবনের সম্ভাবনা।
করোনা কালে লকডাউনের এ সময় ঘরে বসে টেলিভিশন, মোবাইল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে আমরা নিজেদের আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে ঘরের বাইরে বের হওয়ার ঝুঁকি থাকায় অসহায়ের ন্যায় আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে গত কয়েক দশকে বেড়েছে উচ্চ রক্তচাপ, করোনারি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্থূলতা, ক্যান্সারের মতো জীবনঘাতী রোগগুলোর আগ্রাসন। উন্নত দেশগুলোই শুধু নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এসব রোগে চিকিৎসা-ব্যয়ের অঙ্কটা বেশ মোটা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব রোগের অন্যতম কারণ হলো ন্যূনতম শারীরিক পরিশ্রমহীন ও প্রায় নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন। সেইসাথে ভুল খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ইত্যাদি তো রয়েছেই।
উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য-বিষয়ক সব প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মোট মৃত্যুর চতুর্থতম কারণ হলো এই শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। শুধু তা-ই নয়, প্রায় ২৫ শতাংশ স্তন ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সার, ২৭ শতাংশ ডায়াবেটিস, ৩০ শতাংশ হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণও এটিই। এছাড়াও এর ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন রকম সংক্রমণের ঝুঁকি তো থাকেই।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বসে থাকা এবং নিস্ক্রিয় জীবন যাপনের সাথে পাঁচটি স্বাস্থ্যঝুঁকির সরাসরি যোগ আছে। যা হচ্ছে- টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কোলন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার।
বসে থাকা ক্ষতিকর
স্রষ্টা এই দেহটাকে তৈরি করেছেন বসে থাকার জন্য নয়, চলাফেরার জন্যে। মানুষের দেহে ৩৬০টি জয়েন্ট এবং ৭০০ পেশীর হাড় আছে। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো ইচ্ছে মতো দেহকে নড়চড়া করানো। অসাধারণ এই গঠনের কারণেই গ্রাভিটির বিপরীতেও মানুষ সোজা হয়ে সুন্দরভাবে দাঁড়াতে পারি।
দেহের চামড়া নড়াচড়ার সুবিধার জন্যেই ইলাস্টিকের মতো নমনীয়! একই ভাবে দেহের ভেতরে অবিশ্রান্ত চলছে যে রক্তপ্রবাহ, তা ততটাই ভালো হবে যতটা এই দেহ থাকবে সচল। অর্থাৎ দেহের প্রতিটি ইঞ্চিই তৈরি নড়াচড়ার উপযোগী করে। নড়াচড়া করলেই এরা ভালো থাকবে। কিন্তু সেটা যখন করা হবে না তখন কী ঘটাবে দুর্ঘটনা।
প্রথম শিকার হবে মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড হলো একটা লম্বা কাঠামো যাতে আছে হাড় ও ডিস্ক। জয়েন্ট, মাসল এবং লিগামেন্টগুলো এই হাড়ের সাথেই লেগে থাকে। পিঠ বাঁকিয়ে এবং মাথা ঝুঁকিয়ে মানুষ যখন চেয়ারে বসে, একটা অস্বস্তিকর চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের ওপর। ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোর ক্ষয় হয়, ক্ষয়ে যায় জয়েন্ট ও লিগামেন্ট। পেশীর ওপর তৈরি হয় অতিরিক্ত চাপ!
দ্বিতীয় শিকার ফুসফুস। বসে থাকার সময় বক্ষখাঁচা সংকুচিত হয়ে থাকে। ফলে কমে যায় ফুসফুসের প্রসারণ ক্ষমতা। আর ফুসফুসের প্রসারণ ক্ষমতা কমা মানে রক্তের অক্সিজেন প্রবাহ কমা।
লম্বা সময় ধরে বসে থাকলে রক্তের লাইপোপ্রোটিন লাইপেজ কমে যায়। বিশেষ এক এনজাইম, যা রক্তের ফ্যাট বা চর্বি ধ্বংস করে। তাই যত বেশি বসে থাকবে, দেহ থেকে তত কম ফ্যাট ধ্বংস হবে।
কর্মব্যস্ত থাকুন সবসময়
যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা চিকিৎসা-গবেষণা প্রতিষ্ঠান মেয়ো ক্লিনিক। একাধিক গবেষণার পর তাদের পরামর্শ-সবসময় সচল থাকুন। দীর্ঘক্ষণ একনাগাড়ে বসে না থেকে একটু হেঁটে আসুন। আপনার কাজের ধরনটা যদি এমন হয় যে, ডেস্কে বসেই কাজ করতে হয় অফিসে থাকাকালীন পুরোটা সময়, তবে প্রতি আধঘণ্টা পর পর ছোট্ট বিরতি নিন। মিনিট পাঁচেকের জন্যে উঠে দাঁড়ান, দাঁড়িয়েই হাত-পায়ের পেশিগুলো নাড়িয়ে কিছুটা ব্যায়াম করে নিতে পারেন। পরবর্তী কাজে আপনি আরো উজ্জীবিত বোধ করবেন।
দিনের পর দিন এমন নিষ্ক্রিয়তা অজান্তেই আপনাকে ঠেলে দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্থূলতা, হাড়ক্ষয়, বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা ও কয়েক রকমের ক্যান্সারের দিকে। ২০১১ সালে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের উল্লেখযোগ্য সময় যারা টিভি বা কম্পিউটারের সামনে বসে কাটিয়ে দেয়, হৃদরোগে অকালমৃত্যুর হার তাদের অপেক্ষাকৃত বেশি।
গবেষকরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন- নিরবচ্ছিন্নভাবে বসেই কাজ করেন যারা, তারা কিন্তু ঝুঁকিতে আছেন। এর মধ্যে যারা দিনে সর্বোচ্চ ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বসেই কাটিয়ে দেন, তারা আছেন তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিতে। দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সবসময় কোনো না কাজে সচল আর চলাফেরার মধ্যে আছেন তাদের হৃৎস্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা নিষ্ক্রিয়দের তুলনায় অনেকটাই ভালো।
তাই যে কাজই করুন, দীর্ঘসময় বসে কাটাবেন না। টিভি দেখছেন, দাঁড়িয়ে বা দাঁড়িয়ে থেকে কিছু একটা করতে করতে দেখা যায়? কিংবা প্রতিদিনের পত্রিকাটা দাঁড়িয়েই পড়ে নিতে পারেন। অথবা বাড়ির দৈনন্দিন কাজকর্মগুলো নিজেই করা, শখের বাগানের যত্নআত্তি, আপনার গাড়ি ধোয়ার কাজটি না হয় আপনিই করলেন। এছাড়াও বাড়ি ফিরে সন্তানের সাথে খেলাধুলাও হতে পারে দৈহিকভাবে সচল আর গতিশীল থাকার একটি দারুণ উপায়।
কেবল বড়দের ক্ষেত্রেই নয়, শিশু-কিশোরদের জন্যেও এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব ছোটবেলায় এমনকি পাঁচ বছর বয়সের আগে থেকেই যেসব শিশু খেলাধুলা-দৌড়ঝাঁপের মধ্য দিয়ে অধিকতর সক্রিয় থাকতে অভ্যস্ত, তাদের সুষম মনোদৈহিক বিকাশ এবং পরবর্তী জীবনে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা প্রায়শই উচ্ছল ও কর্মচঞ্চল, একাডেমিক ক্ষেত্রে তাদের ফলাফল তুলনামূলক ভালো। বেশিরভাগ সময়েই এরা জীবনে মেধা ও অন্তর্গত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। অতএব, আপনার সন্তানের অবিরাম চঞ্চলতা আর দুরন্তপনা দেখে এবার আনন্দের হাসিই হাসতে পারেন বৈকি।
ব্যায়াম হোক প্রতিদিনের অভ্যাস
ব্যায়ামের উপকারিতা অগণন। সার্বিক সুস্থতার জন্যে ব্যায়ামের ভূমিকা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। এছাড়াও নিয়মিত ব্যায়ামে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুসংহত হয়ে ওঠে। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনকি দেহকোষের জেনেটিক কোডে-ও সূচিত হতে পারে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন।
শরীরের সুস্থতা তো বটেই, মনের সুস্থতার জন্যেও এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন ও কর্মচঞ্চল থাকেন সবসময়, তাদের ক্ষেত্রে বিষণ্নতার প্রকোপ কম। এদের মানসিক সহিষ্ণুতাও তুলনামূলক বেশি। উপরন্তু, ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে সেরোটনিন ও এন্ডোরফিনের মতো আনন্দবর্ধক নিউরোট্রান্সমিটারের প্রবাহ বাড়ে, দেহ-মন থাকে চনমনে। চিন্তাশক্তি আর বুদ্ধিমত্তা তখন কাজ করে চমৎকার। কানাডার নিউরোলজি এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত নিবন্ধে এটি বলা হয়েছে।
ব্যায়ামের মধ্যে হাঁটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বাস্থ্য-বিষয়ক কার্যক্রমের মূল স্লোগান হলো-Sit less walk more. হাজারো তথ্য-প্রমাণ ও গবেষণার ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য সরকার তাদের নাগরিকদের জন্যে হাঁটার একটি আদর্শ রুটিন বাতলে দিয়েছেন- দিনে ন্যূনতম ৩০ মিনিট, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন।
প্রায় দুই দশক আগে, ২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো-Move for health. এর গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সাল থেকে এ আহ্বানটি নিয়েই বিশ্বজুড়ে একটি দিবস পালন করছে- Move for health day (১০ মে)।
তাই, জীবনে সক্রিয়তা আর গতিশীলতা বাড়ান, যতটা সম্ভব। আপনি সুস্থ থাকবেন। আপনার আনন্দময় দীর্ঘজীবনের সম্ভাবনা বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ হাজার মানুষের ওপর ১০ বছর ধরে পরিচালিত একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, যারা তাদের অবসর সময়েও দৈহিক শ্রম ব্যয় করে কোনো না কোনো কাজ করেছেন তারা অন্যদের চেয়ে বেঁচেছিলেন চার বছরেরও বেশি সময়।
সদা সক্রিয় ও কর্মচঞ্চল থাকার অভ্যেসটি গড়ে তুলতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ-পরিবারের সদস্য, নিকটতম বন্ধু, কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করুন, তাদের সম্পৃক্ততা আপনার আগ্রহ ও আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন এমন জীবনদর্শনে বিশ্বাসী মানুষ ও সংগঠনের সদস্যদের সাথে।
আজ থেকেই শুরু করুন...। আরো বেশি সচল আর কর্মমুখর থাকার দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে শুরু হোক আপনার নতুর বছর।
এসএ/