‘নিষিদ্ধ’ পিরিয়ড নিয়ে কিছু কথা
প্রকাশিত : ১৬:১২, ২৯ মে ২০২২ | আপডেট: ১৬:১৪, ২৯ মে ২০২২
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া ঋতুস্রাব। ‘২০৩০ সালের মধ্যে এমন একটি বিশ্ব তৈরি করা যেখানে কোনো নারী বা কন্যাশিশু ঋতুস্রাবের কারণে পিছিয়ে থাকবে না, এমন প্রতিপাদ্যে ২৮ মে পালিত হলো বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২২।
এবারের প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ঋতুস্রাবকে জীবনের একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। মাসিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
আধুনিক এই সময়ে এসে আসলে এই ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়টি নিয়ে আমরা কতুটকু সচেতন হতে পেরেছি?
মাসিক হয়, বাংলাদেশে এমন নারীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৪০ লাখ। তাদের একটি বড় সংখ্যা শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে-২০১৮ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৬ শতাংশ কিশোরী তাদের প্রথম মাসিকের আগে ঋতুস্রাব সম্পর্কে জানত। তারা এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা বিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন। মাত্র ৪৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী তাদের মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ডিসপোজাল প্যাড ব্যবহার করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্যানিটারি প্যাড অপসারণের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ বিদ্যালয়ে এবং এসব বিদ্যালয়ে ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা মানসম্পন্ন টয়লেট রয়েছে। ৩০ শতাংশ কিশোরী বলেছেন, তারা শেষ ছয় মাসে মাসিকের সময় বিদ্যালয়ে যাওয়া থেকে বিরত ছিলেন এবং গড়ে আড়াই দিন বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও মাসিকের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে অস্বাস্থ্যকর পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন বেশিরভাগ নারী। এতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ গর্ভধারণে নানা জটিলতার সম্মুখীন হন তারা। এ বিষয়ে নারীদের সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই, পাশাপাশি স্যানিটারি ন্যাপকিনও সহজলভ্য করতে হবে।
বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট প্যাডের মূল্য ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। তাই সাধারণ নারীরা প্যাড কিনে ব্যবহার করতে পারছেন না। স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা আছে। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছর থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত স্যানিটারি প্যাডের উপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। তারপরও স্যানিটারি প্যাডের দাম এখনো বেশি। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। তাই পণ্যটির দাম কমানো হোক, যাতে সকল মেয়েরা, নারীরা এটি ব্যবহার করতে পারে।
ঋতুস্রাবের মতো স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া এখনো ট্যাবু হয়ে আছে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় খুব কম। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, বাড়ছে প্রচার-প্রচারণা, প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। উল্লেখ করা যায়, মাহাথির স্পন্দন নির্মিত জয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনের কথা। যেটি এ বছর নারী দিবসে প্রথম প্রচারিত হয়। একদম ব্যতিক্রমী একটি নির্মাণ। বিজ্ঞাপনের থিম ছিল, কেক কেটে, বেলুন দিয়ে ঘর সাজিয়ে মেয়ের প্রথম পিরিয়ডকে উদযাপন করছেন বাবা, মা ও বড় বোন। রীতিমতো একটা উৎসবের আবহ। মাহাথির স্পন্দনকে ধন্যবাদ সাহসী এই নির্মাণের জন্য।
ইদানিং জানা যাচ্ছে, দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন নারী উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালাও হচ্ছে। মাসিক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছেন তরুণ-তরুণীরা। এসবই আশাব্যঞ্জক।
বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবসে নারীর মাসিক নিয়ে সমাজের প্রচলিত ট্যাবু ভাঙার আহ্বান জানিয়েছে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম (নাসাসু)। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের লেখা প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতা, মাসিক সুরক্ষা পণ্যের দাম কমানো এবং মাসিক নিয়ে সমাজের প্রচলিত ট্যাবু বিষয়ক বিভিন্ন বার্তা প্রদর্শনও করেছে ফোরামটি। একইসঙ্গে দেশের নারীদের নিরাপদ মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠায় ৭ দফা দাবি পেশ করেছে। ২৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ‘নিষিদ্ধকে ভাঙি’ শীর্ষক এক উন্মুক্ত প্রদর্শনী থেকে এই দাবি তুলে ধরা হয়।
এবার আসা যাক, ‘কলকাতার প্যাডম্যান’ হিসেবে খ্যাত শোভন মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে। শিলিগুড়ি থেকে সুন্দরবন, বাংলার প্রান্তিক নারীদের ঘরে ঘরে স্যানিটারি ন্যাপকিন হোম ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১৭-র অক্টোবরে নিজের এলাকা কলকাতার বাঁশদ্রোণী থেকেই এই কাজ শুরু করেন তিনি। ইতিমধ্যে, গুজরাটের একটি প্যাড প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে শোভনের 'মা ফাউন্ডেশন’। ওই সংস্থাই উৎপাদন ব্যয়ে শোভনের কাছে ন্যাপকিন পাঠিয়ে দেয়। রাজ্যের ১২০টি স্থানীয় ইউনিট তা প্যাক করে পৌঁছে দেবে ঘরে ঘরে। কাদের কাছে প্যাড পৌঁছাবে? রীতিমতো গবেষণা করে আগে থেকেই সেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
সম্পতি নতুন উদ্যোগে নিয়েছেন শোভন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ঘরে ঘরে কম দামে পৌঁছে যাওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেটে থাকবে বিভিন্ন বার্তাবাহী চিরকুট। যা নারী ও শিশু পাচার, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, নারী নিগ্রহ নিয়ে সচেতনতা প্রচারের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ফোন নাম্বারও যোগাবে। কোনো চিরকুটে লেখা, ‘এখন বিয়ে নয়/ আগে নিজের পায়ে দাঁড়াব, আমার উপর বিশ্বাস রাখো/ করে দেখাব’। সঙ্গে শিশু অধিকার ও সুরক্ষা কমিশন এবং পাচার-বিরোধী সংস্থার হেল্পলাইন।
মাসিকের সময় শারীরিক জটিলতায় ভোগা নারীদের কর্মক্ষেত্রে ছুটির প্রস্তাব ১৭ মে অনুমোদন করেছে স্পেন সরকার। মন্ত্রিসভা বৈঠকে খসড়া প্রস্তাবটি অনুমোদন পায়। চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে খসড়াটি এরপর পার্লামেন্টে তোলা হবে। আর সেখানে আইন হলে ইউরোপের প্রথম দেশের নাগরিক হিসেবে ঋতুস্রাবের সময় ছুটির অধিকার ভোগ করবেন নারীরা। খসড়ায় এ ক্ষেত্রে মাসে তিন অথবা পাঁচ দিনের ছুটির প্রস্তাব করা হলেও মন্ত্রিসভা কোনো সময় বেঁধে দেয়নি। ফলে পিরিয়ড জটিলতা যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত সবেতনে ছুটি নিতে পারবেন স্পেনের নারীরা। তবে এজন্য চিকিৎসকের সনদ থাকতে হবে।
বর্তমানে শুধু জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও জাম্বিয়ায় নারীর ঋতুস্রাবকালীন ছুটির অনুমোদন আছে।
স্প্যানিশ গাইনোকোলজি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, পিরিয়ডের সময় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী গুরুতর ব্যথায় ভোগেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ডিসমেনোরিয়া। ডিসমেনোরিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে তীব্র পেটে ব্যথা, কোমড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, জ্বর ও বমি। এ থেকেই পরিষ্কার, ওই সময়টা কর্মজীবী নারী, শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কষ্টকর।
আমাদের দেশেও হয়তো কর্মক্ষেত্রে ঋতুস্রাবকালীন ছুটি পাবেন নারীরা, এমন দিন কী আসবে কখনো?
লেখক: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস
এসি