ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বদলে যাচ্ছে ভোলায় মহিষ পালনের ধরন

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ১৪:০৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১১:৫৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ জেলা ভোলার অনন্য ঐতিহ্য ‘মহিষ পালন’। জেলায় প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে মহিষ পালন করা হয়ে আসছে বাথান পর্যায়ে। বাথানে একই সঙ্গে ২০০ থেকে ৫০০ পর্যন্ত মহিষ পালন সম্ভব। যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এ মহিষ পালন অধিক লাভজনক হওয়ায় স্থানীয়রা বাড়িতে পালন শুরু করেছে। মহিষ পালনের ব্যাপকতায় এলাকার দরিদ্র কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠছেন। মহিষের দুধ বিক্রির টাকা কৃষদের চোখে দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

এলাকায় মহিষ পালন করেন দোলাল মাতব্বর। মহিষ পালনে তার জীবন বদলে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালে আমি চারটি মহিষ নিয়ে আমার যাত্রা শুরু করি। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে আমি শুরু করি। এখন আমার ৩৬টি মহিশ। শুধু তাই নয়, বর্তমানে আমার দুই একর জমি হয়েছে। যার স্থানীয় বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। এ মহিষের দুধ বেচে আমি আমার সংসারের খরচ মেটাই। আমার  দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। মেয়ে একটার বিয়ে দিয়েছি। তাও এই মহিষের দুধ বিক্রির টাকায়। তিনি জানান, মহিষ পালন অত্যন্ত লাভজনক। এক লাখ টাকা দিয়ে মহিষ কিনলে দুই বছর পরে পাওয়া যাবে একটি বাচ্চা। বাচ্চা বিক্রি করে পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা আর দুধ বিক্রি করে পাওয়া যায় ২০ হাজার টাকা।  অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে এক লাখ টাকায় ৫০ হাজার টাকা লাভ। তাই ভোলায় এখন এ মহিষ পালনে সবাই ঝুঁকছে। এতোদিন শুধু বাতানে পালন হলেও এখন তা বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া পরিবেশেও পালন হচ্ছে। মহিষ পালনে দিন বদলের এ গল্প ভোলা জেলার অনেক কৃষকের।

জানতে চাইলে মহিষ পালক জাকির হাওলাদার বলেন, আমার ৯৫টি মহিষ আছে। এটা আমার দাদা পালন করেছে। চাচা পালন করেছে। এখন আমি করছি। তবে আগে মহিষ একটু কিছু না হতেই মরে যেত। তাই অনেকে বেশি পালন করতে চাইতো না। কিন্তু এখন কৃমি নাশক ওষুধ ও বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে মহিষ মরার হার অনেক কমে গেছে। একদিকে মরার ঝুঁকি কমেছে। অন্যদিকে মাংস ও দুধের দাম বাড়ার কারণে লাভের পরিমানও বেড়েছে। তাই অনেকের মতো আমারও বেশি মহিষ পালনের আগ্রহ বেড়েছে। আমি এ মহিষ পালন করে চার কানি জমি কিনেছি। যার স্থানীয় বর্তমান বাজার মূল্য ১০ লাখ টাকা।       

জেলায় মহিষ পালনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা (জিজেইউএস)। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, সারা বাংলাদেশে দেড় লাখ মহিষ পালন হয়। তার মধ্যে শুধু ভোলা জেলাতেই পালন হয় ৯০ হাজার। সবচেয়ে বড়  সম্ভাবনাময় ও নতুন আশার কথা হলো এলাকায় এখন মহিশ পালনে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। এখন শুধু বাতানেই মহিষ পালন হচ্ছে না। বাতানের পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশেও এর পালন শুরু হয়েছে। প্রায় প্রতি বাড়িতেই এ মহিশ পালন শুরু হচ্ছে। মহিষ পালনের এ ব্যাপকতায় এলাকায় অর্থনৈতিক দিকটাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মহিষের দুধ ও মাংস বিক্রির টাকা গরিব পরিবারগুলোতে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে।

মহিষের বাথানের মালিক মো. ইউনুছ বলেন, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর চরে তাদের বাথানে প্রায় আড়াইশ` মহিষ রয়েছে। যা তারা চার পুরুষ ধরে লালন করে আসছেন। দৈনিক এখান থেকে ১৩০ থেকে ১৫০ কেজি দুধ হয়। জেলায় অনেকেই ঐতিহ্য ধারণ করে মহিষ পালন করে আসছেন। যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।

দ্বীপাঞ্চল হওয়ায় এখানে পর্যাপ্ত পানি ও ঘাসসহ মহিষের উপযোগী খাদ্য ও বাস্থান আছে। যার কারণে আমরা এখানে মাহিষ পালনকে আরও এগিয়ে নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) মাধ্যমে ইফাদ’র সহায়তায় ‘উন্নত মহিষ পালন পদ্ধতি’ আওতায় আমরা (জিজেইউএস) মহিষের ইনব্লিডিং (অরক্ষিত প্রজনন) রোধের ব্যবস্থা নিয়েছি। বাগেরহাটের খামার থেকে উন্নত যাতের ২৭টি মহিষ ষাঢ় নিয়ে এসেছি। যেগুলো কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেছি। এক একটা ষাঢ়ের মূল্য নিয়েছি ২৫ হাজার টাকা। যার প্রকৃত বাজার মূল্য ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা।

শীতের সময় ঘাসের সংকট দেখা দেয়। তাই মহিষের খাদ্য ঘাস চাষে প্রয়োজনীয় বীজ সরবরাহ করছি। ২০ থেকে ২৫ জন কৃষক যাতে এক সঙ্গে ঘাস চাষ করতে পারে সে জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এছাড়া মহিষের রোগ বালাই থেকে সুরক্ষা দিতে আমরা বছরে তিনবার কৃমিনাশকসহ বিভিন্ন ভ্যাকসিন দিচ্ছি।

এলাকায় ‘উন্নত মহিষ পালন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেন জিজেইউএস’র সহকারী পরিচালক (টেকনিক্যাল) ডা. খলিলুর রহমান বলেন, এলাকায় মহিষ পালনে কৃষকদের আমরা কারিগরি দিকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। জেলার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আরও বেশি প্রকিক্ষণ দেওয়া হবে।

জানা গেছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে ভোলার উৎপত্তি হলে এখানে ক্রমশই জনবসতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হলে তারা মহিষ, গরু, ছাগল পালন শুরু করে। ভোলা দ্বীপ হওয়াতে এখানকার ছোট বড় অসংখ্য চরে মহিষ পালনে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। বিশেষ করে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারগুলোর শত শত মহিষ পালন করে।

অনেকের ধারণা, প্রায় ২০০ বছর আগে স্থানীয়রা মহিষের দুধ থেকে কাঁচা দধি উৎপাদন শুরু করে। যা ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সময়েও সমান জনপ্রিয়। এখানে এমন কোন বিয়ের অনুষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে দধি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়নি। এতেই বোঝা যায় এখানে এটা কত জনপ্রিয়।

জানা যায়, জেলায় শতাধিক বিচ্ছিন্ন চর রয়েছে। নদীর মাঝখানে এসব চরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এলাকা জুড়ে সবুজ ঘাসের সমারহ। আর এসব চরে পালন করা হয় হাজার হাজার মহিষ। সবুজ ঘাস খেয়ে পালিত হয় এসব মহিষ। যুগ যুগ ধরে বংশপরাক্রমায় বহু পরিবার এখানে মহিষ ও দধি বিক্রির পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। অনেকে আবার নিজস্ব মহিষের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন করে দধি তৈরি করেন। দধির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ নিয়ে বাথান। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব বাথান থেকে মনে মনে  দুধ আসতে শুরু করে শহরের বাজারগুলোতে। গ্রামাঞ্চলে হাটের দিনে দধির টালির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয় মহিষের দুধের দধি। 

এলাকায় দধি বিক্রেতারা বলেন, সাধারণত দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের দধির (টালির) চাহিদা বেশি। বর্তমানে দেড় কেজি ওজনের দধি ১৫০ ও দুই কেজি ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দধি থেকে মাখন, ঘি ও ঘোল বানানো হয়। মাখনের কেজি ৮০০ ও ঘিয়ের কেজি এক হাজার ২০০ টাকা বিক্রি হয়। এর ভালো দাম পাওয়ায় তাদের লাভও ভালো হয়। তবে দুধের দাম বৃদ্ধি পেলে দধির দামও বাড়ে বলে জানান তিনি।

এলাকায় মহিষ পালন ও দধি বিক্রিতে অর্থনৈতিক সম্ভবনা কতটুকু জানতে চাইলে জিজেইউএস’র সহকারী পরিচালক বীথি ইসলাম বলেন, এলাকায় মহিষ পালন দেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়। বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশ মহিশই এ ভোলা জেলাতে পালন হয়। মহিষের দুধ যেমন মিষ্টি তেমন পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এর মাংসেও অনেক খাদ্যগুণ বিদ্যমান। এখানে এর পালন বাড়াতে পারলে দেশের দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ সহজতর হবে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমরা জিজেইউএস) এলাকার কৃষকদের মহিষ পালনে উদ্বুদ্ধ করছি। তাদের মহিষের বাচ্চা সরবরাহ করছি। প্রয়োজনে ঋণ দিচ্চি। পাশাপাশি তা পালনে প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। এমনকি মহিশের দুধ বিক্রির মাধ্যমও ধরিয়ে দিচ্ছি। যাতে মহিষ পালনে কৃষকরা আরও আগ্রহী হয়। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।

 

এসএইচ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি