দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সম্মেলন
বৈষম্য দূরীকরণ ও আঞ্চলিক সহযোগিতার আহবান
প্রকাশিত : ২৩:৫০, ২০ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২৩:৫১, ২০ মার্চ ২০১৮
দুই দিনব্যাপী ‘লিঙ্গ,অধিকার ও ইচ্ছাপূরণ নিয়ে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সম্মেলন: বড় শহরে ন্যায়বিচার অভিগম্যতা’ শীর্ষক সম্মেলন শেষ হলো আজ। গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে শুরু হয়েছিল এ সম্মেলন।
সম্মেলনের শেষ দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. নাসরিন আহমেদ এবং ওডিশার জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ড. শ্রী কৃষ্ণ দেবা রাও। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডের দূতাবাসের এসআরএইচআর ও জেন্ডারের প্রথম সচিব ড. অ্যানি ভেস্টজিনস।
বক্তব্য প্রদানকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘ন্যায়বিচারের সুযোগ মানুষের অধিকার। পাশাপাশি, এটা আইনের শাসন নিশ্চিত করার মূল উপাদান। মানবাধিকারের সুরক্ষা শুধুমাত্র অংশীজনদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়াও, আঞ্চলিক সহযোগিতা, সমন্বয় সাধন, যোগাযোগ, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান বড় শহরের বাসিন্দাদের আইনের আশ্রয় নিতে সহায়তা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সালে দেশের বিভিন্ন আদালতে ১৭ লাখ ৪২ হাজার ২৪৭টি মামলা গ্রহণ করা হয়। এ সংখ্যাই প্রমাণ করে লিঙ্গ নির্বিশেষে ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার সমর্থিত আইন সহায়তা বিষয়ক স্কিম এবং এনজিওভিত্তিক আইনি সেবা সহায়তা কার্যক্রম প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত নারীদের আদালতের আশ্রয় নিতে ও তাদের অভিযোগের যথার্থতা নির্ণয়ে এবং পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ে ও প্রতিকারে সহায়তা দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সরকারি তহবিল থেকে ৬৬ হাজার ৬৪৪ জনকে আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৯ হাজার ৮৮২। এক্ষেত্রে, এনজিওগুলোর অবদানও উল্লেখযোগ্য।’
লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে বর্ণিত আইনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধানের ২৮ ধারা অনুযায়ী, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনযাত্রার সকল ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সুস্পষ্টভাবে নারী ও পুরুষের সমতা ঘোষণা করা হয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে আমাদের প্রয়োজনীয় আইন রয়েছে। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা লিঙ্গ ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল। বিভিন্ন রায়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালত নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকার ও অন্যান্য সংস্থার ক্ষেত্রে নির্দেশনা জারি করেছে।’
সম্মেলনের শেষ দিন ‘প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও আইনি সেবা’ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে শুরু হয়। সেখানে বক্তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং এটা কিভাবে অনলাইনে সেবাসমূহের সুযোগ বৃদ্ধি করছে ও বৃহত্তরভাবে প্রভাব রাখার ক্ষেত্রে বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে এর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সূর্যমুখী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুজতবা ফিয়াদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন ডিনেট-এর নির্বাহী চেয়ারপারসন ড. অনন্য রায়হান, মায়া আপা’র মেডিকেল লিড ড. সায়লা মতিন, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পুলিশ সুপার মো. তবারাকা উল্লাহ, কার্লাস এফএম ১০১.৬ এফএম-এর হেড অব অপারেশনস তাসনুভা আহমেদ, মানবধিকার বিষয়ক আইনজীবি ও নাজদিক’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা জয়শ্রী সতপুত, বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর ১০৯-এর গবেষণা কর্মকর্তা সায়লা আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) এর ন্যাশনাল কনসালটেন্ট (অ্যাকসেসিবিলিটি) ভাস্কর ভট্টাচার্য এবং টেক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা শামস জাবের।
মো. তবারক উল্লাহ বলেন, ‘পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাকে একসাথে নিয়ে আসতে সরকার ২০১৬ সালে জাতীয় জরুরি সেবা চালু করে। সেবার ধরন সময়ের সাথে সাথে উন্নত হচ্ছে। এমনকি, এ সেবা যানজটসহ নানা কারণে মাঝে মাঝে ধীর হলেও আমরা তাৎক্ষণিক সেবাদান নিশ্চিতকরণে কাজ করছি।’
আইন, নীতিমালা ও প্রক্রিয়া সনাক্তকরণের ওপর আলোচনায় বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতিমালার পুনর্গঠন এবং মানুষের ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বৈষম্যমূলক আইন ও এর সনাক্তে বেরসকারি সংস্থার ভূমিকার কথা তুলে ধরে বক্তারা এসব আইনের পুনর্গঠন ও সঠিক প্রয়োগে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের কথা বলেন।
দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘আইন, নীতিমালা ও প্রক্রিয়ায় বৈষম্য সনাক্তকরণে’র ওপর আলোকপাত করা হয়। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সাবেক জেলা জজ ও এনএইচআরসি’র সদস্য নুরুন নাহার ওসমানী। আলোচক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ একরামুল হক, এসএনভি নেদারল্যান্ড উন্নয়ন সংস্থার ওয়ার্কিং উইথ উইমেন প্রকল্পের টিম লিডার ফারথীবা রাহাত খান ও এডিডি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর শফিকুল ইসলাম।
তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় নেটওয়ার্ক ও জোট নির্মাণের প্রভাব নিয়ে। এ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এনএইচআরসি সদস্য মেঘনা গুহঠাকুরতা। এ অধিবেশন শুরু হয় সখির চেঞ্জমেকার আখি আক্তারের কমিউনিটি মোবিলাইজেশনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে। এ অধিবেশনে আলোচক হিসেবে ছিলেন অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, বাংলাদেশ নারী স্বাস্থ্য জোটের (বিডব্লিউএইচসি) নির্বাহী পরিচালক শরীফ মোস্তফা হেলাল, নারীপক্ষ’র সদস্য মাহীন সুলতান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডের দূতাবাসের এসআরএইচআর ও জেন্ডার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মুশফিকুনা জামান সাতিয়ার এবং নারীমৈত্রীর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আক্তার ডলি।
দিনের চতুর্থ ও সমাপনী অধিবেশনে ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা, ক্ষমতায়ন ও সমতা’ নিয়ে উপস্থাপনা উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা। এরপর বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) ড. নাসরীন আহমেদ, ওডিষার জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) ড. শ্রী কৃষ্ণা দেবা রাও, প্রধান বিচারপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের চেয়ারম্যান নাইমা হক। এ সম্মেলনের প্রত্যাশিত ফলাফল ছিল বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, বৈষম্য চিহ্নিতকরণ, ন্যায়বিচারের অভিগম্যতায় নেটওয়ার্ক ও জোট তৈরি, ক্ষমতায়ন ও সমতার ওপর জ্ঞানবৃদ্ধি। সমাজের ক্ষমতায়ন, উদ্ভাবন, লিঙ্গ বৈষম্যের আইন ও অনুশীলনের ওপর আলোকপাত করে ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যসেবা, অধিকারের অভিগম্যতা শক্তিশালী করা নিয়ে এ অধিবেশনে আলোচনা করা হয়।
আয়োজিত সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) ড. নাসরিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বিশেষত, গ্রামীণ অঞ্চলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের নিয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে শহরাঞ্চলে নারীদের নিয়েও এটা বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন বিদ্যমান অবকাঠামো ও মৌলিক সুবিধাগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতি তিনজনের একজন ঢাকার অসংখ্য বস্তিতে থাকে। শহরের বাসিন্দারা সকালে-বিকালে নারীর অবমাননা দেখতে অভ্যস্ত। তারা কোন সুবিধা ছাড়া এসব এলাকায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অশিক্ষিত জনেরা ধর্মের ধ্বজ্জাধারী হয়ে ভুলভাবে ধর্ম ব্যাখ্যা করছে, নারীদের অপব্যবহার করছে এবং সমাজে নারীবিদ্বেষী ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। নারীরা নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন যা প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়া প্রতিরোধ করা কঠিন। নারীরা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে এবং অনেক কিছুই থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আমাদের এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।’
ড. নাইমা হক তাঁর সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘শহরাঞ্চলে দরিদ্র নারীদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমাদের ধারণা রয়েছে। তারা দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। ব্লাস্ট সহ অন্যান্য সংস্থার উচিৎ সম্মতি, অধিকার, সুযোগ ও বৈষম্যের বিষয়গুলো সমাধানের জন্য একসাথে এগিয়ে আসা। নারীদের সংগ্রামের ধরণ সার্বজনীন নয়, এটা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এ সম্মেলন আমাদের এ অঞ্চলের বর্তমান অবস্থা বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।’
সম্মেলনটি আইনজীবী, স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুশীলনকারী, গবেষক, সরকারি কর্মকর্তা, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, সেবাপ্রদানকারী, আইন বিষয়ক কর্মী, সাম্প্রদায়িক স্বাস্থ্যকর্মী, সাম্প্রদায়িক নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের একসঙ্গে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ আয়োজনের লক্ষ্য ছিল উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি কিভাবে বড় শহরগুলোতে ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকার আদায়ের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারে এবং লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আইনম নীতিমালা ও অনুশীলন দূর করতে পারে এটা নিয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান।
দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করে সখি প্রকল্প (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের আওতাধীন), ম্যারি স্টোপস বাংলাদেশ, বাংলাদেশ উইমেন হেলথ কোলিশন, উই ক্যান অ্যালায়েন্স টু এন্ড ভায়োলেন্স এগেইন্স্ট উইমেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ। আয়োজনে সহযোগিতা করেছে ঢাকায় নিযুক্ত কিংডম অব দি নেদারল্যান্ডের দূতাবাস।
//এস এইচ এস//টিকে
আরও পড়ুন