চমেক হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল-এ রূপান্তর করা হোক
প্রকাশিত : ২০:৩১, ২৬ মে ২০২০ | আপডেট: ২০:৩৩, ২৬ মে ২০২০
চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার অবস্থা বড়ই বেহাল ও নাজুক। করোনা রোগীদের জন্যে এখানে পর্যাপ্ত আইসিইউ সুবিধা না থাকায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত রোগীরা। সরকার চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৫০টি আইসিইউ ব্যবহারের জন্যে সিদ্ধান্ত নিলেও বিশেষ মহলের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে সেই উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। এ আইসিইউগুলো থাকলে মোরশেদুল আলমের মতো শিল্পপতিকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হতো না।
আইসিইউ যা-ও আছে তাতে নেই দক্ষ জনবল। নগরের হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালকে করোনা রোগী চিকিৎসার জন্যে প্রস্তুত করা হলেও দক্ষ জনবল সঙ্কটের কারণে চালু করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে করোনা রোগীর চিকিৎসা চললেও ক্রমবর্ধমান রোগীর তুলনায় তা যথেষ্ট অপ্রতুল।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউসহ ১০০ শয্যায় ও আইটিআইডিটিতে ৩০ শয্যায় করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে। অন্যদিকে ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার উদ্যোগে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্যে নাভানা গ্রুপের দেয়া ভবনে স্থাপিত দেশের প্রথম ৩০ শয্যার ফিল্ড হাসপাতালেও করোনা রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে এখন যেভাবে জ্যামিতিক হারে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে- সে ক্ষেত্রে এ হাসপাতালগুলো যথেষ্ট নয়, আরও এক/দেড় হাজার শয্যাবিশিষ্ট নতুন বড় হাসাপাতাল প্রয়োজন। যেখানে রোগীরা চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে করোনা চিকিৎসা সঙ্কট সঠিকভাবে মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো কার্যকর উদ্যোগ ও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাঁচাতে এ মুহুর্তে চট্টগ্রামে যা করা প্রয়োজন তা হলো- জরুরি ভিত্তিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল-এ রূপান্তর করা। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু সরকারি উদ্যোগ। চমেক হাসপাতালের নন-কোভিড রোগীদের চট্টগ্রামের যেসব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে, সেখানে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করে, চমেকে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার আয়োজন করা যায়। এখানে একসাথে দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়ার সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের খুলশির ৫শ’ শয্যাবিশিষ্ট সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চান্দগাঁওয়ের আড়াইশ বেডের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল ও চন্দনাইশের ১ হাজার ৫শ’ শয্যাবিশিষ্ট বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আন্তর্জাতিক মানসম্মত, অত্যাধুনিক দৃষ্টিদন্দন স্থাপনায় গড়ে ওঠা এ ৪টি হাসপাতালে অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স সবই আছে। কিন্তু এসব হাসপাতালে কোনো রোগী নেই। তিন হাজারের মতো বেড পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
চমেক হাসপাতালে আসা নন-কোভিড রোগীদের এসব বেসরকারি হাসপাতালে অনায়াসে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। শহরের ফয়স লেক এলাকার ৫শ শয্যা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালেও (ইউএসটিসি) রোগী খুব বেশি নেই। ২/৩শ বেড খালি থাকে। এখানেও সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া যায়। মা ও শিশু হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেখানেও ১ হাজার শয্যা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চমেক-এর নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মালিকদের সাথে এখনই বসা জরুরি। ন্যূনতম ফি দিয়ে যাতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়, সে ব্যাপারে সরকারি একটি নির্দেশনা দিতে হবে।
এছাড়া সরকার ইতোমধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর যে ৫০টি আইসিইউ ব্যবহারের চুক্তি করেছিল তা আবার পুর্নবহাল করে করোনা রোগীদের দ্রুত আইসিইউ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।
স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরও মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা যেখানে জড়িত, সেই চিকিৎসাখাতের এমন নাজুক অবস্থা কারো কাম্য নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ হাসপাতাল নেই। নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ও আইসিইউ পরিচালনার মতো দক্ষ নার্স ও অন্যান্য কর্মী। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালেও নেই পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওরায়দুল কাদের যখন এ হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন তাঁকে প্রাইভেট হাসপাতালের যন্ত্র ও দক্ষ লোকবল ধার করে জোড়াতালি দিয়ে বাঁচানো হয়েছিল।
চিকিৎসা খাতে সর্বত্র দক্ষ জনবলের স্বল্পতা থাকলেও তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। আর কতো মানুষ জীবন দিলে চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপিদের টনক নড়বে-তা বোধগম্য নয়। চট্টগ্রামে সাধারণ চিকিৎসাকর্মী মোটামুটি হারে থাকলেও দক্ষ বিশেষায়িত সুনির্দিষ্ট কক্ষে কাজ করার লোকবল একেবারেই নেই। তাই জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ পরিচালনার জন্যে দক্ষ লোকবল তৈরির জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়া দরকার করোনা নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ানো ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া অতীব জরুরি।
অবহেলা ও বঞ্চনার অভিশাপ থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষ কবে মুক্তি পাবে- সেই আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। বাঙালি জাতির আন্দোলন–সংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে এবং জাতীয় কোষাগারে রাজস্ব প্রদানের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও সে তুলনায় চট্টগ্রামবাসীর ন্যায্য হিস্যা আদায়ে রাজনৈতিক নেতারা চরমভাবে ব্যর্থ।
১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও বিগত ৫৫ বছরে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নতুন করে সরকারিভাবে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। অথচ রাজধানী ঢাকায় বিশেষায়িতসহ ৩০টির মতো হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। কথায় কথায় ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে জাতীয় উন্নয়ন’ বলা হলেও সার্বিকভাবে চট্টগ্রামের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এখনো হয়নি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর প্রসঙ্গে হাসপাতালটির ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ মুঠোফোনে বলেন, “চমেক হাসপাতালকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করলে অন্য রোগীদের অবস্থা কী হবে। রিক্সা-টেক্সিচালক, দিনমজুরসহ সাধারণ মানুষের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। সরকার চাইলে সাবসিডি দিয়ে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা হাসপাতাল-এ রূপান্তর করতে পারে। ইতোমধ্যে এখানের ১২টি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে করোনা হাসপাতাল করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।”
চট্টগ্রাম বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর সাথে কথা হয় চমেক হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল-এ রূপান্তর নিয়ে। ডা ফয়সল বলেন, “হার্টের রিং বসানো, এনজিওগ্রামসহ অন্যান্য যেসব চিকিৎসা চমেক হাসপাতালে স্বল্পমূল্যে করা হয়, বেসরকারি হাসপাতালে তা সম্ভব নয়। হাসপাতালের চলমান চিকিৎসাসেবার বাইরে আলাদা ইউনিট করে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। এছাড়া সরকার বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করতে পারে।”
লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম।
এনএস/