ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

করোনা নির্মূলে দক্ষিণ কোরিয়ার মিরাকল প্রযুক্তি

ওমর ফারুক হিমেল,দক্ষিণ কোরিয়া 

প্রকাশিত : ২২:২৮, ৩০ মে ২০২০

বিশ্বে যে কয়টি দেশ অভিনব কৌশল ও প্রযুক্তির সহায়তায় পাশাপাশি যথাযথ সময়োপযোগী কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতিরোধে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে, এদের মধ্য অন্যতম দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি শান্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে এই ভাইরাস মোকাবিলা করেছে। দেশটির দেগু ক্লাস্টার নিয়ন্ত্রণের পর সিউলের ইথেওয়ান ক্লাস্টারও  অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে। এখন তৃতীয় ক্লাস্টার কুপাং লজিস্টিক কোম্পানীতে ভাইরাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে দঃ কোরিয়া তার সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফল এই দেশটি প্রযুক্তি, টেষ্ট করা ছাড়াও আরো প্রয়োজনীয় জনহিতকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আর সেগুলো হলো-

কল্যাণের জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ: দঃ কোরিয়ায় করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা একযোগে কাজ করেছে। ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালু রেখেছে, একইসাথে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা এবং সামাজিক মেলামেশাকে নিরুৎসাহিত করেছে শান্ত ও ধীর চলার নীতিতে।  

চীনের থেকে শিক্ষা নিয়ে টেষ্ট বাড়িয়েছে: কোরিয়ায় শুরুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল। কোনো ব্যক্তি ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, তারা সে পরীক্ষা শুরু করে ব্যাপকভাবে। এতে সফলতাও পায় কেসিডিসি। এখন পর্যন্ত দেশটি প্রায় ৮ লাখের বেশি মানুষকে পরীক্ষা করেছে। প্রতিদিন দেশটি বিনা মূল্যে ২০ হাজার লোকের পরীক্ষা করছে। ৬০০টি বুথ স্থাপন করেছে বিভিন্ন স্থানে। 

শনাক্ত ও পৃথকীকরণের পথেই ছিল সিউল: যাদের উপসর্গ রয়েছে, শুধু তাদের পরীক্ষা করাই যথেষ্ট নয়। ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে, তাদের শনাক্ত করে আলাদা করেছে। সিসিটিভি ফুটেজ, ডাটা ব্যবহার দেখে সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করে সিউল কর্তৃপক্ষ। করোনা উপসর্গ রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে কারা মেলামেশা করেছে, তা শনাক্ত করা হয় ব্যাপকভাবে।
 
সামাজিক গেদারিং সীমিতকরণ: করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে সামাজিক মেলামেশাও কঠোরভাবে সীমিত করেছে সিউল প্রশাসন। 

গণ পরিবহনে মাস্ক বাধ্যতামূলক: কোরিয়ায় গণপরিবহনে চলাচলে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়। বাস, ট্রেনে অবশ্যই যাত্রীদের মাস্ক পরিধান করতে হবে। করোনা নিয়ন্ত্রণে এটাও সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবে করোনার প্রভাবে পণ্যের দাম বাড়েনি সেখানে, মাস্কের সংকটও নেই। ডাকঘর ও ফার্মেসীতে রয়েছে পর্যাপ্ত মাস্ক।

এছাড়াও, কোরিয়ায় পর্যাপ্ত মালামাল মজুদ রয়েছে এবং কাজও চলছে সমানতালে। পুরো কোরিয়াকে কীটনাশক দিয়ে ধৌত করা হয়েছে। এতে অংশ নেনে জনপ্রতিনিধিরাও।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার: রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, বিমান বন্দরে ব্যবহারের জন্যে রেখে দিয়েছে পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরকারিভাবেই।

চীনের উহানের ভাইরাসটি কোরিয়ার দেগুতে থেকে যাত্রা শুরু করে কোরিয়ায় যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল, সিউল সেটিকে জনগণের সহযোগিতায় কমাতে সক্ষম হয়। শাটডাউন বা লকডাউন না করেই গণজমায়েত নিষিদ্ধ, ধর্মীয়  অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। অফিসের কাজ বাড়িতে করার নির্দেশ, কোম্পানীর কর্মচারীদের বাইরে যেতে নিরুৎসাহিতকরণ করা হয়েছে কঠোরভাবে।  

এছাড়া প্রতিটি মানুষকে ট্র্যাক করার জন্য তিনটি প্রধান উপায় ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে। 

প্রথমত, ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড- বিশ্বে নগদহীন লেনদেনের পরিমাণ দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকাংশেই বিদ্যমান। লেনদেনগুলো ট্র্যাক করে, মানচিত্রে কোনও কার্ড ব্যবহারকারীর গতিবিধি আঁকানো সম্ভব হয়েছে। কোরিয়া বর্তমানে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তাড়াতাড়ি শনাক্ত করতে পারছে প্রত্যেককে।

দ্বিতীয়ত, স্মার্টফোন- একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে মোবাইল ফোনকেও। ২০১২ সালের হিসেব মতে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোন ব্যবহারকারীর তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। ফোনে মানুষের অবস্থান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ নির্ভুলতার সাথে রেকর্ড করা হয়। কারণ যে কোনও সময় ডিভাইসগুলো এক থেকে তিনটি ট্রান্সসিভারের মধ্যে সংযুক্ত থাকে। ফোর-জি এবং ফাইভ-জি ট্রান্সসিভারগুলো পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ফোন সংস্থাগুলো সমস্ত গ্রাহকদের তাদের আসল নাম এবং জাতীয় রেজিস্ট্রি নম্বর সংগ্রহ করে থাকে। এর ফলে প্রায় প্রত্যেকের ফোনের অবস্থান অনুসরণ করে ট্র্যাক করা সম্ভব। কোরিয়া থিক এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে।

সিসিটিভি: সিসিটিভি ক্যামেরা কর্তৃপক্ষকে COVID-19 রোগীদের সাথে যোগাযোগ করে এমন ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৪ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার শহরগুলিতে ৮ মিলিয়নেরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বা ৬.৩ জন প্রতি একটি ক্যামেরা স্থাপিত হয়। ২০১০ সালে, প্রত্যেকে ভ্রমণের সময় প্রতিদিন ৮৩.৩ বার এবং প্রতি নয় সেকেন্ডে একবার ধরা পড়েছিল। এই পরিসংখ্যানগুলো আজ অনেক বেশি কাজে লাগানো হয়েছে। বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের নজরদারি প্রযুক্তির সর্বোচ্চ একটি দেশ।
 
এছাড়া করোনা রোগীর অবস্থান জানার জন্য Corona 100m নামে মোবাইল অ্যাপস চালু করে। করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি ১০০ মিটারের মধ্যে এলেই এই অ্যাপস অ্যালার্ম দেবে।

আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে মনিটরিং করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট রুমের বাইরে যাচ্ছেন কি না, মোবাইলের জিপিএস চালু রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। 

বহুজাতিক কোম্পানী জনগণের পাশে: কোরিয়ার স্যামসাং, হুন্দাইয়ের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ডরমিটরিকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে সরকারকে দেয়। উন্নত চিকিৎসা সেবার কারণে কোরিয়ার সুস্থ হওয়ার হার ৯০ ভাগের বেশি  যা পুরো বিশ্বে সর্বোচ্চ।

কিউ আর কোড ও ব্লুথুদের  সহায়তা: সাম্প্রতিক সময়ে ইথেওয়ানের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেয় দেশটি। সামাজিক সংক্রমণের পর্যায়ে যাওয়ার আগেই প্রযুক্তির সাহায্যে উপসর্গহীন বাহকদের খুঁজে বের করেছে। এক্ষেত্রে ব্লুটুথ ও কিউআর কোডের সহায়তায় নেয় দেশটি।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি