বেক্সিমকো যেভাবে টিকার পরিবেশক : সালমান এফ রহমান
প্রকাশিত : ০৮:৩১, ২৬ জানুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ০৮:৩৪, ২৬ জানুয়ারি ২০২১
চুক্তির আওতায় সোমবার ভারত থেকে বাংলাদেশে কোভিশিল্ডের ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান পৌঁছেছে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় যে তিন কোটি ভ্যাকসিন ডোজ আসার কথা রয়েছে, এ চালান তারই অংশ।
বেক্সিমকো গ্রাপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়গ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সংবাদ সংস্থা বাসসকে এক সাক্ষাৎকারে এই ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তার সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন : বাংলাদেশ সরকারের কেনা তিন কোটি ডোজের প্রথম চালান একটু আগেই দেশে এসে পৌঁছেছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি অপেক্ষাকৃত দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে। কীভাবে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
সালমান এফ রহমান : আমি মনে করি, এটি সম্ভব হয়েছে কেবল প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা ও সাহসের কারণে। সারা বিশ্বে এখন ভ্যাকসিন নিয়ে হাহাকার। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে (ইইউ) অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার জানিয়েছে তারা চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে পারবে না। কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ডের মতো দেশ কিংবা পাকিস্তানে কিছু শুরুই হয়নি। অথচ আমরা ত্বড়িত গতিতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করছি। কেবল প্রতীকীভাবে নয়, একেবারে পরিকল্পনামাফিক।
বেক্সিমকো কীভাবে এই টিকা ক্রয় ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত হলো?
সালমান এফ রহমান : সেরাম ইন্সটিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদক। বেক্সিমকো থেকে আমরা যোগাযোগ করে বললাম যে, আমরা বাংলাদেশে তোমাদের পরিবেশক হতে চাই। তারা প্রথমে অনাগ্রহী ছিল, তবে পরে জানালো, আমাদেরকে তখনই কিছু বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ, তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। তখন অগ্রীম টাকা বিনিয়োগ করে আমরা পরিবেশক হলাম।
এরপর আমরা সেরামকে বললাম, কবে নাগাদ টিকা পাওয়া সম্ভব? তারা বললো, প্রথম ধাপের টিকা শুধু গ্যাভি ও কোভ্যাক্সকে দিতে হবে, আর দিতে হবে ভারত সরকারকে। আর ভারত যেহেতু বড় দেশ, ফলে চাহিদাও অনেক বেশি। তাই, প্রথমেই টিকা দেওয়া যাবে না। আমরা তখন বললাম, ভারতের সাথে আমাদের এত সুসম্পর্ক। আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভীষণ ভালো সম্পর্ক। আমাদের আগে টিকা দিতে সমস্যা কোথায়! তখন তারা বললো, ভালো সম্পর্কের খাতিরে ভারত সরকার তোমাদের সরকারকে কিছু টিকা হয়তো দেবে। সেটা দুই সরকারের ব্যাপার। কিন্তু বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে এখানে আমাদের করণীয় কী?
তারপরও আমরা জোরাজুরি করে বললাম, আমাদের কিছু টিকা দিতেই হবে। আমরা তখন অনুমোদন পাওয়ার পর প্রথম ধাপে পাঁচ কোটি টিকার জন্য জোরাজুরি করছিলাম। তখন সেরামের ১০০ কোটি টিকার মধ্যে মাত্র ১০ কোটি অবশিষ্ট ছিল।
আমাদের মাথায় ছিল যে, সাথে সাথে টিকা না পেলে, পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে। গ্যাভি বা কোভ্যাক্স দিতে দিতে ২ থেকে ৩ মাস দেরি হয়ে যাবে, তারা দিবেও অল্পসংখ্যক। আমাদের জোরাজুরির পর সেরাম বলল, একটা উপায় আছে। তোমাদের সরকারের সাথে আমরা চুক্তি করবো যে মাসে ৫০ লাখ করে ৬ মাসে ৩ কোটি ডোজ দেব। কিন্তু টাকাটা এখনই অগ্রীম পরিশোধ করতে হবে।
আমরা তখন বললাম, তোমাদের ভ্যাকসিন অনুমোদনই পায়নি, আর এখনই টাকা দিতে হবে? তারা বললো, প্রথম ধাপে নিতে হলে এখনই অগ্রীম দিতে হবে। অন্যথায় সম্ভব নয়। অগত্যা আমরা রাজি হলাম।
আমি এরপর প্রধানমন্ত্রীকে জানালাম যে, ৩ কোটি ডোজ প্রথম ধাপে দেয়ার ব্যাপারে আমরা সেরামকে রাজি করিয়েছি। তবে তারা শর্ত দিয়েছে অগ্রীম অর্থ দিতে হবে। তিনি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। একেই আমি বলছিলাম প্রধানমন্ত্রীর দুরদর্শিতা ও সাহস।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমরা এখন ৫০ শতাংশ অগ্রীম দেব। বাকি অর্ধেক দেব টিকা অনুমোদন পেলে। সেরাম এই শর্তে সম্মত হলো। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারতের দামে টিকা পাওয়া সম্ভব কিনা। তখন সেরাম ভারত সরকারকে ৫ মার্কিন ডলারে বিক্রির প্রস্তাব করেছে, ভারত ৩ ডলারে দর কষাকষি করছে। আমি আমাদের ফার্মার এমডি নাজমুল হাসান পাপনকে বললাম, সেরামের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করতে। তারই ফলশ্রুতিতে উভয়পক্ষ সম্মত হয় যে, আপাতত দাম হবে ডোজ প্রতি ৪ ডলার। কিন্তু সেরাম যদি ভারত সরকারকে আরও কম দামে দেয়, আমাদেরও একই দামে দিতে হবে।
এরপর আমরা প্রথমেই ছয় কোটি ডলার বা অর্ধেক অগ্রীম পরিশোধ করলাম। আর এ কারণেই পৃথিবীর অনেক দেশ যখন টিকাই পাচ্ছে না, আমরা তখন এত সুবিধাজনক অবস্থানে আছি।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এসেছে যে, ভারতের চেয়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে বাংলাদেশকে। কিন্তু আপনারা বারবার বলে এসেছেন যে, বাংলাদেশ ও ভারত সমান মূল্য পরিশোধ করবে। আপনারা কি একই অবস্থানে অনড় আছেন?
সালমান এফ রহমান : অবশ্যই! রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে আমাদের কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি। নিলে এতটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না। যাই হোক, কথা হলো, ভারত ও বাংলাদেশ যে সমান মূল্যে ভ্যাকসিন কিনবে, এটি চুক্তিতেই আছে। সেরাম একটি মাল্টি-বিলিয়ন ডলার কোম্পানি। তারা বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি করেছে। সরকারের সাথে কি তারা চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে?
চুক্তিতে উল্লেখ আছে, ভারত যদি ৪ ডলারের বেশিতে সম্মত হয়, আমরা কিন্তু ৪ ডলারের বেশি পরিশোধ করব না। কিন্তু ভারত ৪ ডলারের চেয়ে কম দামে কিনলে, আমাদেরও সেই দামে দিতে হবে! এর চেয়ে ভালো চুক্তি আর কী হতে পারে? এখন ভারত ২০০ রুপি বা ২ দশমিক ৮ ডলারে ভ্যাকসিন কিনবে। এটা তো খুশির খবর! আমরা ৪ ডলারের পরিবর্তে ২ দশমিক ৮ ডলার পরিশোধ করব।
এখন আমাদের সামনে টাকা ফেরত চাওয়া বা পরবর্তীতে সমন্বয় করে নেয়ার সুযোগ আছে। তবে, প্রধানমন্ত্রী টাকা ফেরত বা মূল্য সমন্বয়ের পরিবর্তে উদ্বৃত্ত অর্থে আমাদের আরো ভ্যাকসিন নিতে বলেছেন। অর্থাৎ আমরা একই টাকায় তিন কোটির পরিবর্তে চার কোটি বা তারও বেশি টিকা পেতে পারি।
সেরাম ইন্সটিটিউটের সিইও আদর পুনাওয়ালার সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে ভারত থেকে টিকা রপ্তানি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা বিষয়টি লুফে নেয়। তবে, বেক্সিমকো ও সরকার সময়মতো টিকা আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল। অবশেষে আপনাদের অবস্থানই সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে, এমনটা বলবেন কী?
সালমান এফ রহমান : তা তো বটেই! আমরা বলেছিলাম যে ২৫ তারিখের মধ্যে টিকা আসবে। ২৫ তারিখেই আসলো। আমাদের সুশীল সমাজ, বিরোধীদল সবাই তো বলে দিয়েছিল যে, না, টিকা আসবে না। এই সময় আমাদের কতভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে! কিন্তু আমরা চুপ ছিলাম। শুধু বলেছি সময়মতো টিকা আসবে। টিকা সময় মতোই এসেছে।
একটি প্রশ্ন অনেকের মধ্যে আছে যে, কেন শুধু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ? ফাইজার, মডার্না বা চীন, রাশিয়ার টিকা কেন নয়?
সালমান এফ রহমান : সরকার কোনোদিন বলেনি যে, শুধু একটি টিকা আনা হবে। সরকার কিছুদিন আগে বলেছে যে, ফাইজারের টিকা নেয়া হবে। কিন্তু ফাইজার বা মর্ডানার টিকার সমস্যা কোল্ড স্টোরেজ নিয়ে। সারাদেশে এই টিকা বিতরণের অবকাঠামো আমাদের নাই। ঢাকা শহরে ১ থেকে ২টা ওই মানের কোল্ড স্টোরেজ আছে। ফলে, ঢাকায় হয়তো সীমিত আকারে এই টিকা বিতরণ করা যাবে।
আমাদের টিকা লাগবে অনেক বেশি! আর সেরাম থেকে আমরা যেই পরিমাণে আনছি, এই পরিমাণ অন্য কোনো কোম্পানি দিতে পারছে না। নিজের দেশকেই তারা দিতে পারছে না! পাকিস্তান চীনের খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু চীন নিজস্ব ভ্যাকসিনের মাত্র পাঁচ লাখ ডোজ পাকিস্তানকে উপহার দিয়েছে। বাকিটা কিনতে হবে, কিন্তু কখন সরবরাহ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ব্রাজিল, ভারতে বিমান পাঠাতে চেয়েও লাভ হয়নি। ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড সেরামের এই টিকা সাত ডলারের ওপরে কিনছে, তারপরও এখন পাবে না; পাবে জুনে! ভারতের পর বাংলাদেশ ছাড়া কেউই পাঁচ ডলারের নিচে টিকা পায়নি, আর প্রথম ধাপে তো নয়ই। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, জানুয়ারির ২৫ তারিখের মধ্যে বিশ্বের কোনো কোম্পানি আমাদের ৫০ লাখ টিকা দিতে পারতো না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে ওষুধ অনুমোদনের বিশেষ নিয়ম আছে। কোনো ওষুধ উৎপাদন বা আমদানি করতে হলে, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইইউ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এদের যে কোনো একটির অনুমোদন থাকতে হবে। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও সেই কথা প্রযোজ্য। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যে অনুমোদন দিয়েছে, এরপর ভারত ও আমরা দিয়েছি। কিন্তু শুধু যদি ভারত অনুমোদন দিত, তাহলে আমরা আনতে পারতাম না। বিনামূল্যে দিলেও পারতাম না। যুক্তরাজ্যের অনুমোদন থাকায় পারছি। চীন বা রাশিয়ার ভ্যাকসিন এই সংস্থাগুলোর কোনোটির অনুমোদন পায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেলে সেগুলো হয়তো আনা যাবে।
আর দামের ইস্যুতো আছেই। ফাইজার ও মডার্না তো বটেই, চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের দামও সেরামের ভ্যাকসিনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
কেউ কেউ বলছেন যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভ্যাকসিন ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে না এনে সরাসরি ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে আনা যেত কি না। এ বিষয়ে বেক্সিমকোর অভিজ্ঞতা কী বলে?
সালমান এফ রহমান : এই কথা যারা বলছে, তারা স্বভাবগতভাবেই ভারতবিরোধী। সারাবিশ্বেই এখন লাইসেন্সিংয়ের মাধ্যমে টিকা বা ওষুধ উৎপাদন করা হয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকা শুধু ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের বাজারে টিকা দেবে। আর কোভ্যাক্সসহ উন্নয়নশীল দেশে ওই টিকা সরবরাহ করার লাইসেন্স পেয়েছে সেরাম। ফলে, কিনতে হলে আমাদের তাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে।
আর সেরাম নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ যত টিকা আনে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা গ্যাভির মাধ্যমে, সরকারি বা বেসরকারিভাবে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই সেরাম থেকে আসে। কিন্তু, সেরাম সরাসরি বাংলাদেশে সরকার বা বেসরকারি খাতকে সরবরাহ করেনি, কারণ তাদের কোনো পরিবেশক ছিল না। ফলে তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে টিকা পাঠিয়েছে।
এ কারণেই কি তাহলে বেক্সিমকো পরিবেশক হিসেবে যুক্ত হয়েছে?
সালমান এফ রহমান : অবশ্যই। বিশ্বের যে কোনো দেশে আপনাকে ওষুধ রপ্তানি করতে হলে ওই দেশে আপনার নিজস্ব কার্যালয় থাকতে হবে, অথবা এজেন্ট বা পরিবেশক থাকতে হবে। যেমন, বেক্সিমকো ৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এদের প্রত্যেকটি দেশে আমাদের পরিবেশক রয়েছে। ঠিক তেমনি বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানির জন্য সেরামেরও পরিবেশক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল।
পরিবেশক তাহলে বেক্সিমকোই কেন? অন্য কোনো কোম্পানি কেন নয়?
সালমান এফ রহমান : আমি মনে করি, মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নটি করছে। তারা নিজেরাও জানে, বেক্সিমকোকে সরকার পরিবেশক হিসেবে নিয়োগ দেয়নি। বেক্সিমকোই বরং নিজস্ব উদ্যোগে সেরামে নিজের টাকা বিনিয়োগ করে পরিবেশক হয়েছে।
ধরুন, আপনি টয়োটা বা হুন্দাই কোম্পানির গাড়ির পরিবেশক হলেন। এখন টয়োটার পরিবেশক কি সরকার ঠিক করে দেবে? বেক্সিমকোর ক্ষেত্রে বরং উল্টো হয়েছে। আমরা সেরামের কাছ থেকে প্রথম ধাপে টিকা নিশ্চিত করে সরকারের কাছে গেছি। দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছি।
আর অন্যান্য কোম্পানিকে তো আমরা আটকে রাখিনি। তারা যায়নি কেন? আমরা যখন চুক্তি করি সেরামের সাথে বা প্রধানমন্ত্রী যখন দুরদর্শিতা দেখিয়ে অগ্রীম অর্থ ছাড়ে সম্মত হলেন, তখন সেরামসহ পৃথিবীর কোনো ভ্যাকসিনই অনুমোদন পায়নি। অর্থাৎ আমরা ও সরকার একটি বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীও নিয়েছিলেন। আমাদের থেকে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। তিনি তখনই বুঝেছিলেন যে এটা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কেউ সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল না। আর আমরা সাহস দেখিয়ে যেই ঝুঁকি নিয়েছি, তার ফল আজকে আমরা পাচ্ছি।
তাহলে কি চুক্তিটি জি২জি করা যেত না?
সালমান এফ রহমান : এটা জি২জি হবে কীভাবে? টিকা তো সরকারের কোনো গম বা পেঁয়াজ নয় যে, এক সরকার আরেক সরকারের কাছে জি২জি-র মাধ্যমে বিক্রি করবে।
টিকা বানাচ্ছে সেরাম ইন্সিটিউট। এটি ভারত সরকারের মালিকানাধীন কোনো কোম্পানি নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে জি২জি কীভাবে হবে? আমরা ভারত সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে, ভারত সরকার ২০ লাখ ডোজ সেরাম ইন্সিটিউট থেকে কিনে আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছে। কিন্তু এটা তারা সেরাম থেকে ফ্রি পায়নি। ভারত এই টিকা কিনে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলংকাকে দিয়েছে।
ডোজ প্রতি বেক্সিমকোর ১ ডলার করে কমিশন নেওয়া নিয়ে আপত্তি আছে কারও কারও…
সালমান এফ রহমান : প্রথম কথা হলো, পরিবেশক হিসেবে সবাই একটা কমিশন পায়। সাধারণত, কমিশন ১০ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। সেরাম ও সরকারের চুক্তিতে আমরা শুধু পরিবেশক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলাম। কিন্তু সরকার তখন আমাদের একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়। সেরাম থেকে আসা টিকা গ্রহণ, ওয়্যার হাউসে নেয়া ও সংরক্ষণ করা, সেখান থেকে সরকারের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাব থেকে প্রতিটি ব্যাচের ছাড়পত্র নেয়া, এরপর ৬৪টি জেলায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বেক্সিমকোর। এই পুরোটা সময় আমাদের কোল্ড-চেইন বজায় রাখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, ৬৪ জেলাতে গিয়ে আমাদের প্রমাণ করে আসতে হবে যে ভারত থেকে জেলা পর্যন্ত টিকা পরিবহনে পুরোটা সময় কোল্ড-চেইন বজায় রাখা হয়েছে। এটি কিন্তু সহজ কথা নয়।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কোল্ড-চেইন ভঙ্গ হতে পারে, এর দায় ঝুঁকি কিন্তু আমাদের। কোথাও সমস্যা হলে আমাদের সমপরিমাণ নতুন ডোজ এনে দিতে হবে। সাধারণত, এসব ক্ষেত্রে একটি এভারেজ ধরা হয় যে সর্বোচ্চ এত শতাংশে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এখানে কোনো এভারেজ নেই। একেবারে ৩ কোটি ডোজ গুনে গুনে বুঝিয়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বেক্সিমকো কখনই টিকা সরবরাহ বা আমদানিতে ছিল না। ফলে, এখন কোল্ড-চেইন বজায় রাখতে আমাদের নতুন করে স্টোরেজ বা ওয়্যার হাউস বানাতে হচ্ছে। বিশেষ ট্রাক কিনতে হচ্ছে। আমরা এখন নিশ্চিত নই যে আদৌ এখান থেকে আমাদের মুনাফা হবে কিনা।
আমরা অনেকবার বলেছি, এই দায়িত্ব যদি অন্য কেউ নিতে চায়, আমরা দিয়ে দিতে রাজি আছি। কিন্তু কোনো কোম্পানিকে দেখেছেন এগিয়ে আসতে?
বেক্সিমকো বেসরকারিভাবেও কিছু টিকা আনবে। তার উচ্চ মূল্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে…
সালমান এফ রহমান : কোভ্যাক্স এর অধীনে সেরাম ইন্সটিটিউট উন্নয়নশীল দেশগুলো ও ভারতের জন্য স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন বানাচ্ছে। কিন্তু বেসরকারিভাবে তারা একই দামে ভ্যাকসিন দিতে রাজি নয়। এক্ষেত্রে তারা ৮ ডলারে ভ্যাকসিন বিক্রি করছে। বাংলাদেশ সরকার কিনছে ৩ কোটি ডোজ। এ ছাড়া গ্যাভি ও কোভ্যাক্সের আওতায় আরও কয়েক কোটি ডোজ পাবে। আর আমরা আনব মাত্র ১০ লাখ ডোজ, যার কোনো প্রভাব সরকারি কর্মসূচিতে পড়বে না।
আমরা মূলত আনছি ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। করোনার সময় ওষুধ কারখানা বন্ধ ছিল না। কিন্তু এই খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সম্মুখ-সারির কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এসব কারণে ওষুধ শিল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আমরা এই অল্প কিছু ভ্যাকসিন আনতে যাচ্ছি।
অর্থাৎ, এমন নয় যে, আমরা প্রচুর ভ্যাকসিন বেসরকারিভাবে বিক্রি করতে পারব। আর মূল্যের ক্ষেত্রে সরকারই একটি ফর্মুলার মাধ্যমে যেকোনো ওষুধের আমদানি মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য করে সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এক্ষেত্রেও তাই হবে। এখানে অতি-মুনাফার কোনো সুযোগই নেই।
আর আমরা যদি উল্লেখযোগ্য ভ্যাকসিন বেসরকারিভাবে আনতে পারিও, তাহলে তো সরকারি কর্মসূচির ওপর অনেক চাপ কমে যাবে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা অর্থ ব্যয় করে টিকা কিনবে। অনেকে হয়তো সরকারি কর্মসূচির জন্য ৬-৭ মাস অপেক্ষা করতে চান না। অনেকেই আবার সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতাল পছন্দ করেন। তাই আমি মনে করি, যারা সমালোচনা করছেন তারা স্রেফ সমালোচনা করার জন্যই করছেন। দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে করছেন না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সালমান এফ রহমান : আপনাকে ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকেও ধন্যবাদ।
এসএ/