অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কতটা হুমকি করোনা ভাইরাস!
প্রকাশিত : ১২:১৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১০:২৪, ১৬ মার্চ ২০২০
চীনে মারাত্মক আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসে আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত ৭৫ হাজারেরও বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা বাড়লেও কিছুটা কমতে শুরু করেছে আক্রান্তের সংখ্যা।
করোনায় চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ তাদের নাগরিকদের নিয়ে যতটা চিন্তিত তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় অর্থনৈতিক ধসের শঙ্কা। যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
করোনায় আক্রান্ত চীন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। দেশটিতে এখন প্রাণহানির সঙ্গে অর্থীনৈতিকভাবে ধসের মুখে পড়েছে। করোনা মোকাবেলায় দেশটি এখন পর্যন্ত ৩৩ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। তারপরও নিয়ন্ত্রণের বাহিরে ভাইরাসটি। সময় যত গড়াচ্ছে লাশের মিছিল ততই বাড়ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে মরণঘাতি এই ভাইরাস যে রুপ নিয়েছে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ওপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ।
সম্প্রতি দুবাইয়ে গ্লোবাল উইমেন’স ফোরামে দেয়া ভাষণে এ কথা জানান আইএমএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা।
তিনি বলেন, ‘বড় ক্ষতির আশঙ্কা করা হলেও তারা এখনো আশা করছেন প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পরিমাণ ০.১ থেকে ০.২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই পতনের পর ভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে খুব দ্রুতই আবার অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতো হতে শুরু করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন জর্জিভা।’
তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব কতটা গুরুতর হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে ভাইরাসটিকে কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে তার ওপর।’
বাংলাদেশে আমদানিকৃত সকল কিছুর প্রায় ৯০ ভাগই আসে চীন থেকে। কিন্তু করোনার আঘাতে সব যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উন্নয়ন ও ভ্রমণকেন্দ্রিক যোগাযোগের পরিসর অনেক বড়। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ।
কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে পণ্য জাহাজিকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে। যা কবে শেষ হবে তা এখনও অজানা।
যেগুলোর আমদানি করা পণ্য এই মুহূর্তে দেশে আসছে না, সেগুলো এক মাস আগেই বুকিং করা। অনেক দেশ চীনের সঙ্গে আকাশপথে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশও চীনের নাগরিকদের আগমনী ভিসা বন্ধ করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের হিসাবে, ফেব্রুয়ারির প্রথম আট দিনে আমদানি কমেছে প্রায় ৩৭ ভাগ। গত জানুয়ারিতে কমেছে প্রায় ২১ ভাগ। উদ্যোক্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রফতানি দুদিকেই পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব।
মেশিন, কাপড়, কেমিক্যালসহ তৈরি পোশাক খাতের অনেক কাঁচামাল আসে চীন থেকে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশটি থেকে আমদানির পরিমাণ এখন নেই বললেই চলে। যা আছে তা চলতি মাস পর্যন্ত খুব ভালভাবেই চলবে বলে ব্যবসায়ী ও সরকারের দেয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে। তবে এর প্রভাব পড়তে পারে আসন্ন রমজানে।
এনবিআরের হিসাবে, জানুয়ারিতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা পাওয়া পণ্য আমদানি হয় প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার টন। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৮ হাজার টন কম। সময়মত কাঁচামাল না আসায় রফতানি ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় উদ্যোক্তারা। চীনের চলমান পরিস্থিতিতে বেড়েছে কাঁচামালের দামও।
এনবিআরের হিসাব মতে, ফেব্রুয়ারির আট দিনে চীন থেকে এসেছে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার টন পণ্য। যা আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় প্রায় ৮১ হাজার টন কম। জানুয়ারিতে কমেছে এক লাখ ৭৮ হাজার টন, আমদানি হয় ছয় লাখ ৭৩ হাজার টন পণ্য।
তবে আশা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে চীনের কিছু ক্রয় আদেশ বাংলাদেশে আসতে পারে। কিন্তু কাঁচামালের ঘাটতির কারণে এ সুযোগ কতটুকু কাজে লাগানো যাবে, তা নিয়ে শঙ্কায় উদ্যোক্তারা।
এছাড়া একক দেশ হিসেবে চীনে রফতানি হয় ৬৫ শতাংশ চামড়া ও চামড়াপণ্য। এখন করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেশের দ্বিতীয় এ রফতানি খাতের সামনে সংকট তৈরি করেছে। চীন থেকে যেসব ঋণপত্র, রফতানি আদেশ ও পণ্য সরবরাহ আদেশ পাওয়ার কথা তা আসেনি।
১০০ কনটেইনার চামড়াজাত পণ্য চীনে রফতানির অপেক্ষায় আছে। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে বড় অংকের আর্থিক ক্ষতির আশংকা করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ন্যায় এশিয়ার এ সমৃদ্ধে দেশটির ওপর নির্ভরশীল আরেক উন্নত দেশ জাপান। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ভূখণ্ডগত বিরোধ চলতে থাকা সত্ত্বেও জাপানের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকাংশে চীনের উপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে।
চীন হচ্ছে জাপানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। জাপানের অনেক কোম্পানির চীনে কারখানা আছে, যেখানে তৈরি পণ্য কেবল জাপানেই ফিরে আসছে তা নয়, অন্যান্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এর বাইরে জাপানের পর্যটন খাতের ৮০ শতাংশের বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল।
চীন থেকে আসা পর্যটকের স্রোত সজীব রাখছে জাপানের ভোগ্যপণ্য ও হোটেল ব্যবসায়। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবে সবকটি খাত এখন চরম সংকটের মুখে।
সূর্য্যদয়ের দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই জাপানির মৃ্ত্যু হয়েছে। আক্রান্তের দিকে থেকে চীনের বাহিরে শীর্ষে। ফলে নাগরিকদের সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত নিয়ে বড় সংকটের আশঙ্কা করছে জাপান। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।
বিশ্বব্যাংক আশা করছে, বৈশ্বিক উৎপাদন গত বছরের ২ দশমিক ৪ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি বছরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। ২০১৯ সালে বৈশ্বিক উৎপাদন ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। একইভাবে অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের মতে, চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুস্থির থাকলেও তেমন অসাধারণ কোন কিছু ঘটবে না।
গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে জানান, সীমিত বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপ এবং সম্পদের মূল্য বৃদ্ধি নীতি নির্ধারকদের সমস্যায় ফেলবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাদের নেয়া উদ্যোগের সুফলগুলোয়।
উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের কথা উল্লেখ করে বলেন, দেশটির অর্থনীতি দিন দিন মন্থর হয়ে পড়ছে। তার ওপর নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অভাবনীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশ। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে বন্ধ রয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক বহু কোম্পানির কারখানা।
চীনে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা জারি করেছে বহু দেশ। এ অবস্থায় ২০২০ সালে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নামবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা গত ৩০ বছরে কখনই হয়নি। একইভাবে মন্থরতা দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও। পাশাপাশি বৈশ্বিক বাণিজ্য অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের বেশি সম্প্রসারণ করতে কষ্ট করতে হবে ইউরোপের বেশকিছু দেশকে। এতে করে সময়ের সাথে বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাস বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।