ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

করোনায় ধুঁকছে বিশ্ব অর্থনীতি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:০৩, ১ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১০:২৩, ১৬ মার্চ ২০২০

বিশ্ব অর্থনীতিতে কাঁপন ধরিয়েছে করোনা ভাইরাস। ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যটন ক্ষেত্রে চীন যেমন ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তেমনি এর প্রভাব পড়ছে বহু দেশেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রাদুর্ভাব দৃশ্যমান। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য, উন্নয়ন ও ভ্রমণকেন্দ্রিক যোগাযোগের পরিসর অনেক বড়। চীন থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ রয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পণ্যের কাঁচামাল আমদানির সঙ্কট দেখা দিলে রফতানিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীদের একটি অংশ চীনের বদলে বিকল্প দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানির খোঁজখবর নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এ পরিস্থিতিতে চীনের বিকল্প বাজার খুঁজতে তাগিদ দিয়েছেন এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ওপর জোর দিতে বলেছেন।

প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে (কভিড-১৯) মৃতের সংখ্যা। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৫৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিন ১০৯ জনসহ ২ হাজার ৯৭৯ জনের প্রাণ হারিয়েছেন এ ভাইরাসে। 

এর আগে ২০০৩ সালে পৃথিবীতে আতঙ্ক তৈরি করেছিল সার্স। ঐ রোগে ৮ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন ৭৭৪ জন। সেই সময়ে বৈশ্বিক জিডিপির ৪ শতাংশ আসত চীন থেকে। তখনই বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় বলে অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছিলেন। আর গত বছর বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের অবদান ছিল ১৬ শতাংশ। সুতরাং সার্সের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। 

করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই বৈশ্বিক জিডিপিতেও এর প্রভাব পড়বে। কারণ বর্তমানে বিশ্বের মোট উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ আসে চীন থেকে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, চীনে করোনা ভাইরাস আতঙ্কে অধিকাংশ বড়ো কোম্পানির কারখানায় উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়েছে। আরও দুই মাস উৎপাদন বন্ধ থাকলে বিশ্ব প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে বড়ো বিপর্যয় দেখা দেবে।

এদিকে আকস্মিকভাবে বিক্রি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা অ্যাপল। আমেরিকার জেনারেল মোটরস নিজ দেশে যত গাড়ি বিক্রি করে, তার চেয়ে বেশি হয় চীনে। তার উৎপাদনও কমেছে। জাপানের টয়োটারও একই অবস্থা। বিশ্বের বৃহত্তম অনলাইন রিটেইল শপ আমাজনের মজুদে টান পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহু দেশে।

এসবের একটিই কারণ- চীনে মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি এখন যে প্রশ্ন সবার মনে উঁকি দিচ্ছে, তা হচ্ছে- এর অর্থনৈতিক প্রভাব কী হবে?

বিশ্ব অর্থনীতির জন্য করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি চীন ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা- যা হবে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর সর্বনিম্ন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি। বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা তাই যথার্থই বলেছেন, বিশ্ব এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে তার নাম করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব। অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।

চলতি শতাব্দীর শুরুতে চীন বিশ্ব অর্থনীতির ৮ শতাংশের মালিক ছিল। এখন বেইজিং নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব অর্থনীতির ১৯ শতাংশ বা প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। করোনা ভাইরাস দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে, তার উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকস।

বৃহস্পতিবার তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়, করোনা ভাইরাস এশিয়ার বাইরে ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হবে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি (১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন) ডলারের, যা বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের ১৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইন্দোনেশিয়ার জিডিপির সমান ক্ষতি হবে এতে। করোনার কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের ৬ শতাংশ থেকে কমে এবার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে। 

চীনের এক হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপর দেশটির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, এক মাসে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এক-তৃতীয়াংশ কারখানা তহবিলশূন্য হয়ে পড়বে। এ ছাড়া ৭০০ কোম্পানির ওপর পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা যায়, সেগুলোর ৪০ শতাংশই তিন মাসের মধ্যে তহবিলশূন্য হয়ে যাবে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও করোনার ধাক্কা এড়াতে পারবে।

চীন শুধু সারা বিশ্বে পণ্য সরবরাহই করে না। চীনের ১৪০ কোটি মানুষ এখন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, ফ্যাশনেবল পোশাক আর বিদেশ ভ্রমণেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে থাকে। দেশটির মানুষের আয় দেড় যুগেরও কম সময়ে বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০০৩ সালে চীনাদের বার্ষিক গড় আয় ছিল ১৫০০ ডলার। গত বছর তা পৌঁছায় ৯০০০ ডলারে। ইন্টেল ২০১৯ সালে চীনে পণ্য বিক্রি করে আয় করেছে ২০০০ কোটি ডলার, যা ওই বছরে কোম্পানির মোট আয়ের ২৮ শতাংশ। মোবাইল ফোনের শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোয়ালকমের আয়ের ৪৭ শতাংশ আসে চীন থেকে। ২০১৯ সালে চীনে চিপ বিক্রি করে কোম্পানিটি আয় করেছে ১২০০ কোটি ডলার। অক্সফোর্ড ইকোনমিক্স বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন বড় খেলোয়াড়।

আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সমিতি (আইএটিএ) জানিয়েছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের কারণে এবার ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। এবার বিমান সংস্থাগুলোর যাত্রী ১৩ শতাংশ কমে যাবে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। আইএটিএর সিইও অ্যালেক্সান্দ্রে ডি জুনিয়াক এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এ বছরটি কঠিন যাবে। করোনার কারণে প্রতিদিন ১৩ হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হচ্ছে। শুধু চীন নয় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত সাত বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেবা খাতের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে জানুয়ারিতে সেবা খাতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম খুবই কমেছে।

ক্ষতির মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি:

বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এক প্রতিবেদনে বলেছে, তৈরি পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, কম্পিউটার, পাট সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিকস পণ্য, কাকড়া, কুঁচে, চশমাসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নানাবিধ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু সংযোগ, পায়রা বিদ্যুত প্রকল্প, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ, ঢাকা-বাইপাস সড়কসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যহত হতে পারে। ঔষধ শিল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে এই সমিতির নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা বলছেন, এই সংকট যদি আরো দু’মাস চলতে থাকে তাহলে এক অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি হবে এই শিল্প। 

ট্যারিফ কমিশন বলছে, ওভেন পোশাকের ৬০ শতাংশই আসে চীন থেকে। আর নিট পোশাকের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকেই আমদানি করা হয়। তৈরি পোশাক খাতের ৫০ ভাগই চীন নির্ভর।  বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক মনে করেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য আগামী ৩ থেকে ৪ মাস খুবই সংকটজনক।

দেশের শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং নিত্য ব্যবহার্য নানা পণ্যের বড় উৎস চীন। ওষুধের কাঁচামালের একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে। গত এক সপ্তাহে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামালের দামও বাড়ছে।

কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতও ক্ষতির মুখে পড়ছে। প্রতি মাসে চীন থেকে এ খাতে ৯০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করত বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশেরও বেশি আসে চীন থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৮৩ কোটি ডলার।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি