করোনায় সতর্কতা জরুরী
প্রকাশিত : ১৫:২১, ১৫ মার্চ ২০২০
গত রোববার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়াতে পারে।
শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে এসেছে, বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলো আশঙ্কার কথা জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এর আগে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশই করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করতে পারছে না। বাংলাদেশে রোগী শনাক্ত হওয়ায় আমাদের সম্মিলিতভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে একে প্রতিরোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে চীনে করোনাভাইরাসের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলো দেশের মানুষকে সচেতন করে সতর্ক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে চলেছে- গণমাধ্যম সেখানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আকাশপথে ও নানা উন্নয়ন সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা কার্যক্রম এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন আক্রান্ত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বিমান যোগাযোগ রয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার অস্বাভাবিক নয়।
ইতোমধ্যে সরকার বিমান ও স্থলবন্দরগুলোতে স্ট্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, কোয়ারেন্টাইনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে, আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট চার লাখ ৯৪ হাজার ৭০৫ জনকে স্ট্ক্রিনিং করা হয়েছে। গত শনিবার পর্যন্ত দেশে ১১১ জনের নমুনা (মুখ ও নাকের লালা) পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রস্তুতি হিসেবে রোগী শনাক্তকরণ থেকে শুরু করে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা পর্যন্ত ধাপ সঠিকভাবে বাস্তবায়নে সম্মিলিত কন্ট্রোলিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে রোগ শনাক্তকরণ কিট, ল্যাবরেটরি, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ও অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধের যেন সংকট না হয়, সেদিকে সরকার তৎপর রয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে ৩১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে করোনা প্রতিরোধে কুয়েতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের কোনো দেশই ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. টেড্রোস আধানাম এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ, বাণিজ্য, পরিবহন, তথ্য প্রভৃতি মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজে নামতে হবে। জাতিসংঘের সদস্য দেশের সরকারগুলোর উদ্দেশে টেড্রোস আধানাম বলেন, 'রোগ শনাক্তের সক্ষমতা বৃদ্ধি করুন। হাসপাতাল প্রস্তুত রাখুন। অত্যাবশ্যক সামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করুন।' তিনি বলেন, আমরা সবাই যে পর্যায়ের হুমকির মধ্যে আছি, কিছু দেশের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও কাজকর্ম তার সঙ্গে খাপ খায় না। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন এ ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল।
সর্বশেষ (সোমবার সকাল) করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১,১০,০৭৪ জন, মৃত্যুর সংখ্যা ৩,৮৩০ জন, সুস্থ হয়েছেন ৬২,২৮০ জন, আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ১০৯। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ রোগী কম ঝুঁকিপূর্ণ, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ১৪ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ৬ শতাংশ, সরাসরি চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ৯৪ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চীনে ১১ জানুয়ারি উহান শহরে প্রথম খবর শোনা যায়। চীনের জনসংখ্যা ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রায় ১৪৪ কোটি। এর মধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮০,৭৩৫ জন। এই জনবহুল দেশে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সে রকম নয়। চীনে প্রকোপটি অপ্রস্তুত অবস্থায় শুরু হয়েছে। চীন দ্রুত সার্বিক ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছে, যে কারণে এখন প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যদি আমরা পরামর্শ মেনে চলি, তাহলে আমরাও এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব; সবার সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি। কোনোক্রমেই এখন ধারণাভিত্তিক আগাম ভয়াবহতা প্রচার করা যাবে না। সামাজিক মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারী আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য প্রচার করা উচিত হবে না। করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস, যাকে করোনাভাইরাস বলা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরে এটিকে কভিড-১৯ নামকরণ করেছে।
উপসর্গ- জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, সর্দি, মাংসপেশি বা গাঁটে ব্যথা। বয়স্ক রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। যেসব করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের রোগ, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার বা রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। যেভাবে বিস্তার ঘটে- মূলত হাঁচি-কাশির সময় বাতাসের মাধ্যমে; আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে; ভাইরাস আছে এমন কোনো কিছু জায়গা বা আসবাবপত্র স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে মুখে, নাকে বা চোখে হাত লাগালে।
প্রতিরোধের জন্য করণীয় :ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে; হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখতে হবে পরিস্কার রুমাল, টিস্যু পেপার বা হাত দিয়ে; ঠান্ডা বা ফ্লু আক্তান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে সতর্ক থাকতে হবে; মাছ-মাংস-ডিম খুব ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে; বন্যপ্রাণী বা গৃহপালিত পশুপাখিকে খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না; প্রয়োজনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে; সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে; ঘনবসতি এলাকায় পিছিয়ে থাকা মানুষকে সরকার-সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিশেষ সহযোগিতা করতে হবে; ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে; যতটা সম্ভব ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে হবে।
চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে খুব সাধারণ। পর্যাপ্ত বিশ্রাম; প্রচুর পানি পান করতে হবে; উপসর্গ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থা :গুজব বা মিথ্যা তথ্য প্রচার থেকে সামাজিক মাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে। জনগণের জন্য সব তথ্য বা নির্দেশনা সরকারের একটি নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রচার বা সরবরাহ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়