করোনাতঙ্ক: জ্বর-কাশির রোগীদের স্পর্শ করছেন না ডাক্তার
প্রকাশিত : ১৬:৪০, ২০ মার্চ ২০২০
দেশের বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা করোনা ভাইরাসের কারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঠাণ্ডা-সর্দি, জ্বর-কাশির কোনো রোগীকে তারা স্পর্শ করছেন না। সংক্রমিত নয়; কিন্তু জ্বর, সর্দি বা কাশির সমস্যায় ভুগছেন- এমন রোগীকেও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন।
কোনো কোনো ডাক্তার জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেবেন না বলেও লিখে রেখেছন। বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের কারণে জ্বর বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত অনেক রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এসব রোগী সরকারি হাসপাতালে রেফার করছে। এতে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা চিকিৎসা করছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন রাজধানীর এবং দেশের জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকরা রোগীদের সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আলোক হাসপাতাল, কিংস্টোন হাসপাতাল, ডা. আজমল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে কোনো রোগী এলে সরকারি হাসপাতালে রেফার করা হয়।
মিরপুর ১২ নম্বর কিংস্টোন হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইমার্জেন্সি ডাক্তারদের বলা আছে- জ্বর, সর্দি, কাশি ও হাঁচি নিয়ে কোনো রোগী এলে সরকারি কুর্মিটোলা হাসপাতালে যেন রেফার করা হয়।
ডা. আজমল হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডা. রকিবুল হাসান বলেন, যদি এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে কেউ আসে, কাউন্সেলিং করে পর্যাপ্ত মেডিসিন দিয়ে সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। যেহেতু করোনা ভাইরাস শনাক্তের কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই, তাই আমরা রিস্ক নিই না।
করোনা হোক বা না হোক সর্দি, কাশি কিংবা জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে গেলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না দিয়েই রোগীকে ফিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এসব উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলে সন্দেহ হলেই রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কয়েকদিন ধরে জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হাবিব নামে মিরপুরের এক রোগী জানান, জ্বর, সর্দি থাকায় চিকিৎসা নিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা না করেই করোনা রোগী বলে ফিরিয়ে দেন। তাদের এমন মন্তব্য শোনার পর রোগীর মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. নাজমুল হাসান জানান, আমাদের এখানে একটি কর্নার করা হয়েছে যেখানে রোগীকে প্রাথমিকভাবে দেখে যদি মনে হয় করোনা তাহলে অন্য জায়গায় রেফার করি। এখানে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক বলেন, তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে তারা এসব রোগীকে চিকিৎসা দেবেন না।
এদিকে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাউকে আইইডিসিআর’র হটলাইন নম্বর দেখিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অন্তত ৬-৭ জন রোগীর স্বজন এমন অভিযোগ করেন।
এ সময় হাসপাতালের ভেতরে জরুরি বিভাগের রিসেপশনিস্টের চেয়ারে বসা পারভেজ ও সাইমন রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার কথাও বলেন রোগী ও স্বজনরা। হামিদুল তার সাড়ে ৩ বছরের শিশু ছেলে হোসাইন ও আরেক শিশুর পিতা হাসিজুম শেখ তার ৫ বছরের শিশু মেয়ে হাবিবাকে কোলে নিয়ে মুগদা জেনারেল কলেজ ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান।
রিসেপশনিস্টের কাছে যাওয়া মাত্রই বলেন, আজকে চলে যান, শনিবার আসবেন। এ সময় শিশুর দুই পিতা শিশুদের খুব ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর- এ কয়েকদিন কি করব। শিশু রোগীর পিতা হামিদুল যুগান্তরকে বলেন, আমার বাচ্চাটার ঠাণ্ডা ও জ্বরের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রামপুরা বনশ্রী থেকে আসলাম। চিকিৎসাসেবা না পেয়ে চলে যেতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের রিসেপশনিস্ট পারভেজ বলেন, করোনা ভাইরাস রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। ঠাণ্ডা, কাশি, গায়ে ব্যথা রোগীর এমন উপসর্গ থাকলে ভর্তি নিচ্ছি না।
চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাস ঝুঁকিতে হাসপাতালে গিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ জ্বর ও সর্দি-কাশির রোগীরা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল এমনকি প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার-চিকিৎসকরাও করোনার উপসর্গ মনে করে এসব রোগী থেকে দূরে থাকছে।
খুলনার দুটি সরকারি হাসপাতালে সর্দি-কাশি-জ্বরের কোনো রোগী ভর্তি করছে না চিকিৎসকরা। করোনা সন্দেহে এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ১৫ তারিখের পর থেকে কোনো সর্দি-কাশি এবং জ্বরের রোগী ভর্তি করা হয়নি। শুধু হাঁপানি রোগে আক্রান্তদের ভর্তি করা হচ্ছে।
সিলেটে করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর এখন সর্দি-কাশির রোগীদের এড়িয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে চিকিৎসাবঞ্চিত সাধারণ রোগীরাও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বা সন্দেহজনক রোগী চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ এখনও নেই। হাসপাতালে চালু হয়নি হাঁচি-কাশি, সর্দি-জ্বরের রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসাসেবা ও নিরীক্ষা কক্ষ। যদিও সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা দাবি করেন, এসব রোগীর চিকিৎসায় ২ দিন আগে আলাদা সেবাকক্ষ খোলা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের বিভিন্ন প্রাইভেট চেম্বারের সামনে সর্দি-কাশির চিকিৎসা হয় না এমন নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন কয়েক চিকিৎসক। নোটিশে লেখা আছে ‘হাঁচি-কাশি, নিউমোনিয়া, সর্দি-জ্বরে আক্রান্তরা মোবাইল ফোনে রোগের লক্ষণ জানিয়ে ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে পারবেন।’
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা হাঁচি-কাশির সাধারণ রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। করোনার ভয়ে জেলার উপজেলার হাসপাতালগুলোতে জ্বর, কাশি ও ব্যথা নিয়ে এলে তাদের আগের মতো চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সর্দি, কাশি এবং জ্বরের রোগীদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে।
কুমিল্লায় জ্বর কিংবা হাঁচি-কাশি নিয়ে হাসপাতালে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও মিলছে না চিকিৎসা সেবা। প্রাথমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত সব ধরনের ওষুধ সংকট দেখা দিয়েছে। প্যারাসিটামল, এন্টিহিস্টামিন এবং এলাট্রল জাতীয় ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
এছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চাঁদপুর, পাকুন্দিয়া, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীরা কোনো ধরনের সেবা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।