করোনাশঙ্কা: পত্রিকা বিক্রি কমেছে ৫০ ভাগ
প্রকাশিত : ২০:১৮, ২৬ মার্চ ২০২০
দেশের জনপ্রিয় সংবাদপত্র
মহামারী আকার ধারণ করা মরণঘাতী করোনা ভাইরাস ইতোমধ্যে তার থাবা বিস্তার করেছে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে। প্রাণ নিয়েছে ২১ হাজার ২৮৩ জনের। এমনই পরিস্থিতিতে ভাইরাসটি কাগজের মাধ্যমে ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় বাসা এবং অফিসে বিপুল সংখ্যক পত্রিকার সাবস্ক্রিপশন বাতিল করা শুরু করেছেন গ্রাহকেরা।
শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই সংবাদপত্র বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানাচ্ছে ঢাকা ভিত্তিক সংবাদপত্র হকারদের সংগঠন সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। সমিতির প্রধান অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, "অনেক বাসাই লকডাউন করে দিয়েছে, কাউকেই তো ঢুকতে দিচ্ছে না। দুধ, কাজের লোক কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না।"
ইকবাল হোসেন আরও বলেন, অনেকে ফোন দিয়ে বলছে যে- পত্রিকা দিয়েন না এবং এটা একদম হুট করেই। এমনকী একজন বন্ধ করলেই আরেকজনের মাথায়ও এটা কাজ করে যে, তারাও বন্ধ করে দেয়।
যাতে অর্ধেকটাই কমে গেছে পত্রিকার বিক্রি। হকাররা আগে যেখানে দিনে ৩০ লক্ষ টাকার পত্রিকা বিক্রি করতেন, সেখানে এখন করোনাতাঙ্কের মধ্যে বিক্রি ১৫ লক্ষ টাকায় নেমে এসেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সমিতির জানাচ্ছে, ঢাকায় পত্রিকা হকার রয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার, আর করোনা আতঙ্কের মধ্যে এদের অনেকের হাতে এখন কোনো কাজ নেই বললেই চলে।
দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোরও গোটা দেশে মূদ্রণ কমানো হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো। গত বুধবারের (২৫ মার্চ) হিসেব অনুযায়ী, পত্রিকাটির প্রায় ৭০ হাজার কপি কম বিক্রি হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পত্রিকাটির সার্কুলেশন বিভাগের প্রধান এ বি এম জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের হকাররা কাজে আসতে পারছে না, স্কুল-কলেজ, অফিস বন্ধ, পাঠক কই পাবো।"
এই হলো রাজধানীর চিত্র। ঢাকার বাইরের চিত্র তো আরও খারাপ। আব্দুল খালেক নামে বগুড়ার একজন হকার, যিনি বিভিন্ন বাসায় দৈনিক ৭০০ পত্রিকা বিলি করতেন, ২৫ মার্চ তিনি বিলি করেছিলেন মাত্র ২০০ কপি। আর আজ অবশ্য একটিও নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বগুড়ার একজন সাংবাদিক বলেন, "মানুষ এখন ভয়ে আছে, মনে করছে সবকিছুতে ভাইরাস, তাই ভরসা করতে পারছে না।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের এখানে ৩০০ হকার আছে, যাদের মধ্যে অর্ধেক আজ পত্রিকা বিক্রি বন্ধ করেছে।"
বগুড়ার মতো দেশের অন্য জেলাগুলোতেও পাঠকদের মধ্যে প্রবলভাবে করোনা আতঙ্ক কাজ করছে। যেমনটা দেখা গেছে কক্সবাজারেও। শহরটির এই বাসিন্দা সোনিয়া আফরিন ইশিতা, যিনি পত্রিকা বন্ধ করেছেন পাঁচদিন হলো। তিনি বলেন, "একটা পত্রিকা তো কত মানুষের হাত ঘুরে আসে। তাতে জীবাণু থাকতে পারে। সেই ভাবনা থেকে পত্রিকা নেয়া বন্ধ করেছি।"
তবে এতে কিন্তু খবর জানা বন্ধ হয়নি তার। বললেন, "প্রাত্যহিক জীবনে পত্রিকা না রাখার কোনো প্রভাব পড়েনি আসলে সেভাবে। কারণ অনলাইনেই বেশিরভাগ সময় খবর পড়া হয়।"
এমনিভাবে রাজশাহী জেলার সিফাত তাসনিম জানান, শুধু হকার না, বরং বিভিন্ন হাত ঘুরে বাসায় পৌঁছায় বলে তার পরিবার এখন ছাপানো পত্রিকা কেনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, "হকারের হাতের ছোঁয়া লাগবে, সে তো বাইরে থাকে। শুধু হকার না, সেটা বিভিন্ন হাত থেকে তারপর আমাদের বাসায় পৌঁছে, যা এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে একেবারেই উচিত না। তাই সবদিক বিবেচনা করেই বন্ধ রাখা হয়েছে আপাতত।"
ইশিতা, তাসনিমের মতো বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন বরিশালের সদরের বাসিন্দা ফাতিমা তানজিম ও সিলেটের বাসিন্দা আদিব হাসানও। যদিও আদিবের বিষয়টি একটু উল্টো। তিনি পত্রিকা রাখতে চান কিন্তু হকারই তাকে বলে দিয়েছে- ৩১ মার্চ পর্যন্ত পত্রিকা দেয়া হবে না।
ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকার সুস্মিতা মিশুও জানান যে, বুধবার থেকে তাদের পত্রিকা হকার নিজে থেকেই পত্রিকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। উত্তরার বাসিন্দা নুসরাত পারুলও পত্রিকা নেয়া বন্ধ করেছেন। তিনি বলেন, "পুরো মাসের বিল দিয়ে ১৯ তারিখ থেকে পত্রিকা বন্ধ করেছি। বলেছি ৩১ মার্চ পর্যন্ত না দিতে।"
এদিকে, বৃদ্ধ বাবার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বাসায় পত্রিকা রাখা বন্ধ করেছেন সৈয়দা নুরুন নাজিয়া।
"আমার বাবার ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার। পত্রিকা যেহেতু অনেক হাত ঘুরে আমার হাতে আসছে এবং এটাকে আসলে ডিজইনফেক্ট করার উপায় নেই, তাই আমি অফ করে দিয়েছি।"
রাজধানীর আরেক বাসিন্দা ইফতিয়ার আহমেদ আজমাইন বলেন, "শুনেছি পত্রিকায় নাকি ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে না, তবুও হকার অনেক স্থানে চলাফেরা করে, সেই ভয় থেকেই পত্রিকা বন্ধ।"
আরেক অধিবাসী ফারাহ জেবিন শাম্মী বলেন, "যে হকার পত্রিকা নিয়ে আসবে সে কি রিস্ক ফ্রি? সে কতগুলো বাসায় পেপার বিলি করে? যেহেতু আমার কাছে অপশন আছে .. পত্রিকার অনলাইন ভার্সনেই তো সব পেয়ে যাচ্ছি।"
এদিকে, চলমান করোনা আতঙ্কের মধ্যে 'পত্রিকা ঝুঁকিপূর্ণ' কিনা, এমন প্রশ্ন উঠছেই। এ বিষয়ে গবেষকরা অবশ্য বলছেন 'কাগজের পত্রিকা ঝুঁকিপূর্ণ নয়'। পত্রিকাগুলোর পিছনের পাতায় বা অন্যান্য পাতাতেও বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বিজ্ঞাপন আকারে ছেপে দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে এ বি এম জাকারিয়া বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন পত্রিকার পেছনে আলাদাভাবে লেখা রয়েছে পত্রিকার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। তিনি বলেন, "আমরা হকারদের গ্লাভস দিচ্ছি, মুখে পরার মাস্ক দিচ্ছি, শুধু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কমাতে।"
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা নোয়াব হকারদের মধ্যে ৩ হাজার হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ২৩ হাজার মাস্ক ও ২৩ হাজার গ্লাভস বিলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংগঠনটি এই বলে একটি বিবৃতিও দিয়েছে যে, ছাপানো পত্রিকা করোনা ভাইরাস বহন করে না।
তাই এসব বিষয় মাথায় রেখেই ছাপানো পত্রিকা বাদ দিতে রাজী নন অনেকেই। যেমনটা জানান শাহরিয়ার আমিন নামে ঢাকা মেডিকেলের একজন চিকিৎসক। পত্রিকা রাখা বন্ধ করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, "পেপার তো রাখি আগে থেকেই, বন্ধ করলাম না। পড়ি না অবশ্য বেশি, আর ওরা বারবার বলে কাগজ দিয়ে করোনা ছড়ায় না।"
বিজ্ঞাপন দেখেই পত্রিকা রাখছেন ফুয়াদ পাবলো ও রায়হান আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি। তারা জানিয়েছেন, এখনো পত্রিকা রাখছেন, তবে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কার বিষয়টি তাদেরকে কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
আরেক বাসিন্দা সাদিক ইভান বলছেন, "বাসায় ইংরেজি ও বাংলা দুটোই রাখতাম। তবে ইংরেজিটা বন্ধ করে দিয়েছি। বাংলাটা বাধ্য হয়েই রাখতে হচ্ছে। নানু অনলাইনে পড়তে পারে, কিন্তু তাতে নাকি মজা পান না। পাকিস্তান পিরিয়ড থেকে পড়ে অভ্যস্ত তো। ছাপা পত্রিকা উনার লাগবেই।" সুত্র-বিবিসি।
এনএস/