কেমন আছে চীন ফেরত বাংলাদেশিরা?
প্রকাশিত : ১০:৩৯, ১৭ এপ্রিল ২০২০
চীনে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তখন দেশটি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশের বাসিন্দারা।
এর মধ্যে চীনে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশিও ফিরে এসেছিলেন দেশে।
গত পহেলা ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে ফিরেছিলেন তিনশোর বেশি বাংলাদেশি যাদেরকে পরের দুই সপ্তাহ আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছিল।
এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ফিরেছিলেন চীনের অন্যান্য শহরে থাকা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি।
কিন্তু এখন যখন বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে, তখন কেমন আছেন চীন থেকে দেশে ফেরা সেই সব বাংলাদেশিরা।
গত ২৮শে জানুয়ারি স্বামী আর সন্তানের সাথে চীনের সাংহাই থেকে দেশে ফেরেন তাহেরা তমা।
তিনি জানান, অনেকটা পরিবারের সদস্যদের পরামর্শ আর অনুরোধেই দেশে ফেরেন তিনি।
তবে গত ২৫শে মার্চের একটি ঘটনার পর তার দেশে ফিরে আসার কারণে বার বারই অনুতাপ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ওই দিন বাসার পাশে একটি ফার্মেসিতে বাচ্চার ডায়পার আর ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। সে সময় ফার্মেসির গেইটে এক ব্যক্তি তার উপর হাঁচি দেয়। তাহেরা তমা জানান, মাস্ক পড়া থাকলেও কোন লাভ হয়নি। বরং তার হাঁচিতে মাস্কটিই প্রায় ভিজে গিয়েছিল।
এর পর বাসায় গিয়ে কয়েক বার গোসল করেও লাভ হয়নি। পরের দিন থেকেই শুরু হয় শুকনো কাশি, সর্দি। জ্বর ছিল না কিন্তু শরীরে ব্যথা ছিল। সাথে ছিল শ্বাসকষ্ট।
এসব লক্ষণ নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে গেলে সেখানকার চিকিৎসক লক্ষণ দেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছাতেও বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় তাকে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সেখানে গিয়ে তিনি হাত ধোয়ার জন্য পানিও খুঁজে পাননি।
তিনি জানান, অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষা করাতে পারেননি তিনি। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত হটলাইনে ফোন করেও তিনি কোন ধরণের সেবা না পাওয়ার কথা জানান।
‘হটলাইনেও বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু সংযোগ পাওয়া যায় না অথবা বিজি এরকম আরকি।’
"এখন এমনভাবে আছি, করোনা যদি হয়েও যায় তাহলে আমি জানি যে ট্রিটমেন্টটাও পাবো না। সেলফ সারভাইভ যতক্ষণ করা যায় আরকি," তিনি বলেন।
তিনি মনে করেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় চীন থেকে বাংলাদেশে না এলেই ভাল করতেন তিনি।
"দিনে আমার ১০০ বার মনে হয় যে কেন আসলাম।"
তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা তাকে বলে-কয়ে নিয়ে এসেছে কিন্তু চীনে তার বিশ্ববিদ্যালয় বা সহপাঠিরাও আসতে না করেছিল।"
চীনে থাকার সময় স্বাস্থ্য সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, "একবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এসেছিল।"
তাহেরা তমা মনে করেন যে, চীনে থাকলে অন্তত স্বাস্থ্য সেবাটা ঠিক-ঠাক পেতে পারতেন তিনি।
এখন চীনে আবার ফেরাটাও অনিশ্চিত হয়ে গেছে বলে জানান তিনি। তাদেরকে জানানো হয়েছে যে, চীনে যারা ফিরতে চায় তারা যেন সেদেশের সরকারের অনুমতি ছাড়া না যায়।
"এই অবস্থায় মনে হয় না আমাদের আর ফিরতে দেবে। চীনে আসলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোন বিদেশিকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।"
শারীরিক অবস্থার আগের চেয়ে কিছুটা ভাল হয়েছে তার। পরিচিত চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাচ্ছেন তিনি।
গত পহেলা ফেব্রুয়ারি চীনের উহান থেকে আরো তিন শতাধিক বাংলাদেশির সাথে দেশে ফিরেছিলেন শামীমা সুলতানা। পিএইচডি ডিগ্রি নিতে পড়াশুনা করতে চীনে গিয়েছিলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই।
তবে স্বামীর পড়াশুনা আগে শেষ হওয়ার কারণে তিনি আগেই দেশে চলে আসেন। আর উহানে দুই মেয়ের সাথে আটকা পড়েন শামীমা সুলতানা।
তিনি বলছেন, দেশে না ফিরে চীনে থাকলেই ভাল করতেন কিনা এই প্রশ্নটি সম্প্রতি তার মনে বার বারই উঁকি দিচ্ছে।
এ প্রশ্নের উত্তরও খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে তার মতে, চীনে থাকা বা দেশে ফেরা দুটি সিদ্ধান্তই তার জন্য সমান।
"বিষয়টি আসলে আমার জন্য ফিফটি-ফিফটি," তিনি বলেন।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে দুই সন্তানের এই মা বলেন, দুই মেয়ে নিয়ে বিদেশে একা থাকাটা তার জন্য প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করছিল। দেশে ফিরে তিনি এর থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
তবে তিনি এটিও মনে করেন যে, চীনে থাকলে তার অন্তত উন্নত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হতো।
তিনি বলেন, "স্বাস্থ্য সেবার কথা ভাবলে মনে হয় যে বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে অসুস্থ হলে তো আর চিকিৎসা পাবো না। কিন্তু ওখানে থাকলে সেটা পেতাম।"
তবে এরকমটা মনে করেন না উহান থেকে ফেরা আরেক বাংলাদেশি ফারজানা ইয়াসমিন। তিনি মনে করেন, দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটিই তার জন্য সঠিক ছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ভালবাসেন বলেই ফিরে এসেছেন তিনি।
"আমার কখনো মনে হয় না যে কেন আসলাম। কারণ যাই হোক নিজের দেশ।"
স্বাস্থ্য সেবা বা অন্য যেকোনো দিক থেকে চীনের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি
এমবি//