করোনা প্রতিরোধে যেসব খাবার জরুরি
প্রকাশিত : ১৬:৩৫, ২৩ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৮:১১, ২৩ এপ্রিল ২০২০
করোনা প্রতিরোধে জরুরি যেসব খাবার
রোগীর হাঁচি-কাশিতে ছড়ায় করোনা। এখনো আসেনি কোনো প্রতিষেধকও। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকৎসা বিষয়ক কোনো গুজবে কান না দেয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। তারা বলছেন, করোনার কোন চিকিৎসা না থাকলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তা প্রতিরোধ সম্ভব। এ সময়টিতে রোগ প্রতিরোধ করে এমন খাবার বেশি বেশি গ্রহণের পরামর্শ তাদের।
করোনা ভাইরাস আক্রান্তের শুরুর কেন্দ্রস্থল চীনের উহান। চীনের গন্ডি ছাড়িয়ে করোনা হানা দিয়েছে সব মহাদেশই। যেখানে প্রতিমুহূর্তেই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। পাশাপাশি ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিস্কারে বসে নেই গবেষকরা। দেশে দেশে চলছে গবেষণা। এই দুর্যোগের সুযোগে গুজবের ডালপালা মেলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কাচা রসুন খেলে করোনা হবে না বা চা খেলে করোনামুক্ত থাকা যাবে- এরকম কোনো কথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলেই জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, যেহেতু এখনো কোনো প্রতিষেধক আসেনি, তাই রোগ প্রতিরোধের দিকেই বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, রসুন, পিয়াজ, গোল মরিচ, সবুজ মরিচ এগুলোর প্রত্যেকটা জিনিসই কিন্তু আমাদের প্রয়োজন। স্পেসিফিক আমি এখানে শুধু লেবুই খাবো- সেটা না, এই ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের সবকিছুই প্রয়োজন।
বিজ্ঞানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, তাই করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন খাবার নিয়ে যেসব গুজব হচ্ছে তাতে কান না দেয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের যেমন প্রয়োজন প্রোটিন, যেমন প্রয়োজন ভিটামিন বি-৬, বি-১২, তেমনি প্রয়োজন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ এবং ই, আবার ভিটামিন সি তো অবশ্যই। এসবগুলো মিলিয়েই আমাদের করোনা প্রতিরোধ করতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যে সুষম খাবার দরকার, ব্যালেন্স ডায়েট দরকার সবগুলোই কাজে লাগবে।
অর্থাৎ শরীর সুস্থ রাখতে যেসব খাবার জরুরী সেসব খাবারই খেতে বলছেন চিকিৎসকরা। তারা মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে, ভিটামিন-ই ও ভিটামিন-সি জাতীয় শাকসবজি খেতে হবে বেশি। তাই প্রতিদিনের খাবারে টমেটো, লেবু, জাম্বুরা, মাল্টা, পেয়ারা, পেঁপে, কালো জিরা রাখুন। এসবে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
চিকিৎসকদের মতে এসময়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ যেসব খাবার বেশি করে খেতে হবে। যেমন - আপনি বেশি বেশি সবজি খেতে পারেন। এর মধ্যে লেবু, করলা (কোয়ারসেটিন, কেয়েমপফেরল, বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ), বেগুনি বা লাল বাঁধাকপি, বিট, ব্রকোলি, গাজর, টমেটো, মিষ্টি আলু, ক্যাপসিকাম, ফুলকপি খেতে পারেন। এছাড়া শাকের মধ্যে পালংশাক এবং অন্যান্য সবুজ শাক খাওয়া উচিৎ।
ফলের মধ্যে - কমলালেবু, পেঁপে, আঙুর, আম, কিউই, আনার, তরমুজ, বেরি, জলপাই, আনারস ইত্যাদি খেতে পারেন। মসলার মধ্যে আদা, রসুন, হলুদ, দারুচিনি, গোলমরিচ রাখা যেতে পারে। এছাড়া সিমের বিচি, মটরশুঁটি, বিচিজাতীয় খাবার, বার্লি, ওটস, লাল চাল ও আটা এবং বাদাম তালিকায় রাখুন।
এছাড়া ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবার রোগ প্রতিরোধে খুব সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে গাজর, টমেটো, কুমড়া বেশি করে খান। মধু ও দারুচিনি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। যাদের শরীর দুর্বল তারা মধু খেলে উপকার পাবেন।
আমলকীর সঙ্গে অল্প আদা ও খেজুর বেটে চাটনি তৈরি করে খাওয়া যায়। ভিটামিন-সিতে ভরপুর আমলকীর এই চাটনি শরীরের জন্য দারুণ উপকারী। সারা দিনে প্রচুর পানি পান করুন। এ ছাড়া ভেষজ চাও খেতে পারেন। টক দইতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ অন্যান্য খনিজ। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে দারুণ কার্যকর। টক দইয়ে ভালো কিছু ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, যা দেহের জীবাণু দূর করতে সাহায্য করে।
এদিকে, বাংলাদেশি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল মতে, সব থেকে ভালো হলো- করোনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করা। কেউ যাতে করোনায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত না হন, সহজে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
ড. বিজন শীল জানান, যেকোনও ধরনের গলা খুশ খুশ বা কাশি দেখা দিলেই আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না। ওটা করোনা না করোনা নয়, এ নিয়ে চিন্তা করার কোনও দরকার নেই। বরং ওই মুহূর্ত থেকে যে কাজটি করতে হবে, তা হলো আদা (জিঞ্জার) ও লবঙ্গ (ক্লোব) একসঙ্গে পিষে সেটাকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার সঙ্গে কিছুটা চা দিয়ে ওটা এক কাপ মতো নিয়ে গড়গড়া করে খেতে হবে। দিনে অন্তত তিন-চারবার এক কাপ করে এটা খেতে হবে। এর ফলে গলার ভেতরের কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। এতে কোষগুলো শক্তিশালী হবে। কোষগুলোর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোষগুলো সমর্থ হবে কোভিড-১৯ ভাইরাস যদি আক্রমণ করে, তাকে প্রতিরোধ করতে।
যাদের গলা খুশ খুশ করে না বা কোনও কাশি দেখা দেয়নি, তারাও এটা নিয়মিত দিনে দুইবার অন্তত দু’কাপ খাবেন। তাতে তাদেরও ইমিউনিটি বাড়বে। এর পাশাপাশি যাদের জোগাড় করা সম্ভব, বিশেষ করে যারা গ্রামে আছেন, তারা এখন নিমপাতা পাবেন। ওই নিমপাতা একটু পানি দিয়ে পিষতে হবে। পেষার ফলে যে সবুজ রঙের রসটি বের হবে সেটার সঙ্গে গরম পানি মিশিয়ে তা গড়গড়া করে খেতে হবে। এর ফলে গলার কোষগুলোয় রক্ত সঞ্চালন বাড়বে, ইমিউনিটি বাড়বে। যা অনেক বেশি সমর্থ হবে করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে পরাজিত করতে।
ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন ডাক্তারের আলোচনার মাধ্যমে জেনেছি করোনা আমাদের গলা থেকে ফুসফুসে গিয়ে আক্রমণ করে। এক পর্যায়ে ফুসফুসে পানি জমে যায়। তখন রোগী মৃত্যুর মুখে চলে যায়।
ড. বিজন শীল বলেন, করোনার এই যে তিনটি পর্যায় অর্থাৎ প্রথমে গলায় আক্রমণ করা। অর্থাৎ গলায় খুশ খুশ কাশি হবে। এর পরে এটা আমাদের ফুসফুসের ব্রঙ্ক অ্যালভিয়োলিতে চলে যায়। ব্রঙ্ক অ্যালভিয়োলিতে যাওয়া দ্বিতীয় স্টেজ। তৃতীয় বা শেষ স্টেজ হচ্ছে ব্রঙ্ক অ্যালভিয়োলিতে পানি জমানো। ড. বিজন শীলের পরামর্শ হলো, করোনাকে প্রথম স্টেজেই অর্থাৎ গলা খুশ খুশ অবস্থাতে দমন করতে হবে। আর সেজন্য তিনি মনে করেন তার ওই আদা, লবঙ্গ এবং চা থেরাপি আর নিমপাতা থেরাপি অনেক কার্যকর হবে।
এর পাশাপাশি তিনি ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন একগ্রাম পরিমাণ ভিটামিন সি খাওয়ার পরামর্শ দেন। এই ভিটামিন সি’র সঙ্গে অবশ্যই কিছুটা পরিমাণ জিঙ্ক থাকতে হবে। যতদূর খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বাজারে এ মুহূর্তে ভিটামিন সি ওইভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রীও তার ৩২টি সাবধানতার ভেতর এই ভিটামিন সি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ কারণে বাজারে যা ভিটামিন সি ছিল, তার প্রায় সবই এখন বিক্রি হয়ে গেছে।
ড. বিজন শীল বলছেন, এই ভিটামিন সি’র সঙ্গে জিঙ্ক থাকতে হবে। কারণ, ভাইরাসের ‘আর ডি ডি’কে ব্লক করে দিতে সমর্থ হয় জিঙ্ক। যার ফলে ওই ভাইরাস সহজে রোগীকে আক্রান্ত করতে পারে না। তাতে দেখতে পাই এই মুহূর্তে গণস্বাস্থ্য একটি ভিটামিন সি তৈরি করছে, যার সঙ্গে তারা জিঙ্ক দিচ্ছে। আমাদের স্কয়ার, বেক্সিমকো ফার্মা, ইনসেপ্টা, অপসোনিন এমনি অনেক বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি রয়েছে।
ড. বিজন শীল যেসব থেরাপির পরামর্শ সবই ভেষজ পদ্ধতির। এছাড়া তিনি দুই প্রকারের ভিটামিন খেতে বলছেন। এতে শরীরে ক্ষতি হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাই এ বিষয়ে যেহেতু তিনি বিশেষজ্ঞ তার পরামর্শ আমাদের এখন থেকে মানা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব সময় গরম পানি খাওয়ার জন্য। গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলেও উপকার পাওয়া যায়। আবার অনেকে তেজপাতা, কালোজিরা, রসুন, আদা, লবঙ্গ খাওয়ার কথা বলছেন।
দেশে প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে করোনা রোগী। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ইউরোপ আমেরিকা যেখানে পরাস্ত, সেখানে আমাদের দেশে কতটুকু চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে ড. বিজন শীলের মতো একজন অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শগুলো কাজে লাগালে আমরা হয়ত সুফল পেতেও পারি।
এনএস/