করোনায় ফ্লু’র প্রতিকার ও প্রতিরোধে ডাক্তারের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
প্রকাশিত : ১৬:২১, ১২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ১৬:২২, ১২ জুলাই ২০২০
করোনার তাণ্ডবে কুপোকাত সারা পৃথিবী। এরইমধ্যে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এখন প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না পুরো পৃথিবী।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনার সাথে ঋতুভিত্তিক ভাইরাল ফ্লু’র সংক্রমণ বাড়ায়, ঠান্ডা, সর্দি, জ্বর ও কাশিতে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। করোনার মতো লক্ষণ থাকায় সাধারণ এসব ফ্লু নিয়েই বহুগুণে আতঙ্ক বেড়েছে সাধারণ মানুষের। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঋতু ভিত্তিক এ সকল ফ্লু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ সকল ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণ চিকিৎসাতেই সেরে উঠেন।
ঋতু ভিত্তিক এ সকল রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ কেমন হবে এ নিয়ে একুশে টেলিভিশনের সাথে কথা বলেছেন গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি এণ্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শাকিল মাহমুদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের নিজস্ব প্রতিনিধি মো. রোকনুজ্জামান ।
একুশে টেলিভিশন: স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই করোনাকালীন সময়ে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, সব মিলিয়ে কেমন আছেন?
ডা. শাকিল মাহমুদ: রোগীরা আতঙ্কিত, আমরাও আতঙ্কিত। অনেক ডাক্তার মারা গেছেন, প্রায় ১২শ’র মতো ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং আমরাও আতঙ্কের বাহিরে না, আমাদেরও পরিবার আছে, সন্তান আছে। তারাও এই মুহূর্তে আমাদের নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেই আছে।
একুশে টেলিভিশন: এই সময়ে কী ধরণের রোগের লক্ষণ নিয়ে রোগীরা সাধারণত আপনাদের কাছে বেশি আসছে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: আমরা বেশি হুজুগে বিশ্বাসী, আতঙ্কে বিশ্বাসী। আমাদের স্বাস্থ্যজ্ঞান নাই, এ কারণে সাধারণ ঠান্ডা ,কাশি, জ্বর হলেও মনে করছি করোনা হয়ে গেছে। তাই মানুষ, ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথা এমনকি শরীর ব্যথা হলেও আমাদের কাছে আসতেছে। করোনার মতো এসব লক্ষণ নিয়েই তারা বেশি আসতেছে।
একুশে টেলিভিশন: আপনি যে রোগের কথা বললেন বিগত বছরের তুলনায় কী এ বছর রোগীরা এই সকল রোগের লক্ষণ নিয়ে আপনাদের কাছে বেশি আসছে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: হ্যাঁ, এই বছরে বেশি আসতেছে। এই বছর ঠান্ডা, কাশি হলেও মানুষ ডাক্তার দেখাচ্ছে। অন্য বছর যেটা হতো, ঠান্ডা, কাঁশি হলে মানুষ ডাক্তার দেখাতো না। এই বছর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে বেশি ডাক্তার দেখাচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন: করোনা এবং ঋতু ভিত্তিক এই রোগগুলোর লক্ষণ প্রায় কাছাকাছি, উভয় রোগের লক্ষণের মধ্যে এমন কোনো বিশেষ পার্থক্য আছে কি, যা দিয়ে এই দুটোকে সহজেই আলাদা করা যাবে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: এমন নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নাই। কোনটা করোনা, কোনটা সিজিনাল ফ্লু, কোনটা ভাইরাল ফ্লু, এইটা আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই বুঝতে হবে।
একুশে টেলিভিশন: বাসায় থেকে করোনা বা ঋতুভিত্তিক এই রোগগুলো প্রতিকারে কি ধরণের চিকিৎসা সেবা নেওয়া যেতে পারে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: করোনার ক্ষেত্রে যেটা হয় ৮০-৮৫ শতাংশ রোগীর কোনো লক্ষণই থাকে না। তারা সাধারণত ঠান্ডা, কাশি, জ্বর এমন রোগ নিয়ে আসে। তাহলে এই ৮০-৮৫ শতাংশ রোগীর কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ারই দরকার নাই। মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে যাওয়ার দরকার পড়ে। এই সময়ে হাসপাতাল কিন্তু ইনফেকশনের বড় ক্ষেত্র, সেজন্য সবার হাসপাতালে যাওয়ার দরকারও নাই।হাসপাতালে গেলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। মাত্র ৫ শতাংশ রোগীই হাসপাতালে যাবে যাদের নিবিড় পরিচর্চা দরকার। এখন সাধারণত সবার যেটা হচ্ছে যেটা সেটা ভাইরাল ফ্লু। সব ভাইরা্ল ফ্লু’র লক্ষণ প্রায় একই রকম, যেমন ঠান্ডা, জ্বর আসবে।
এগুলো হলে এন্টিহিসটামিন ও প্যারাসিটামল খাবে। শ্বাসকষ্ট হলে মন্টিলুকাস জাতীয় ঔষধ খাবে। গলা ব্যথা করলে প্যারাসিটামলের সাথে ব্যথানাশক খেতে পারে। আর এক্ষেত্রে যেটা করতে পারে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এন্টি-অক্সিজেন জাতীয় ভিটামিন খেতে পারে। যেমন- ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’,‘ই’এবং জিংক। জিংক জাতীয় খাবার খেতে পারে।
একুশে টেলিভিশন: বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখছি এই রোগগুলো থেকে মুক্তি পেতে এন্টিবায়োটিক খাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
ডা. শাকিল মাহমুদ: ঢালাওভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলছে যে এই ওষুধ খেলে এই রোগ সেরে যাবে, এই কথাগুলোর আসলে বৈজ্ঞানিক কোনও প্রমাণ নাই। ভাইরাসের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক খাওয়ার কোনো নিয়ম নাই। ৮৫ শতাংশ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা এমনিই ভালো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসা চলবে, পাশাপাশি রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে, টেনশন ফ্রি থাকতে হবে। শাক-সবজি বেশি খেতে হবে। গরম পানি দিয়ে গারগোল করতে পারে। সব রোগ প্রতিকারে খুব জরুরি ব্যাপার হচ্ছে ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা মানা।
একুশে টেলিভিশন: এ বছর অনেক মানুষ শ্বাসকষ্ট বা করোনার এই উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে , মূলত শ্বাসকষ্ট হওয়ার কারণ কি? এ থেকে রক্ষা পেতে কি ধরণের চিকিৎসা নেওয়া দরকার?
ডা. শাকিল মাহমুদ: অনেকেরই এলার্জি আছে। এলার্জিজনিত যে রোগগুলো আছে তার মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। এটি অ্যাজমা রোগীদের মতোই। কিন্তু শ্বাসকষ্ট হলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যায়। আতঙ্কিত হলে এটা বেশি বেড়ে যায়। এই রোগের অন্য সময় যে চিকিৎসা, এখনও ঠিক একই চিকিৎসা। এক্ষেত্রে ইনহেলার নিবে, মন্টিলুকাস ও ডক্সিসাইক্লিন জাতীয় ঔষধ খাবে, অক্সিজেন নিবে বা ডাক্তাররা যে পরামর্শ দেয় সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নেবে।
আর শ্বাসকষ্ট যদি বেড়ে যায়, তাহলে বাসায় একটি সস্তা জিনিস অক্সিজেন সেচুরেশক রাখতে পারে। অক্সিজেন সেচুরেশন যদি ৯২ এর নিচে নেমে যায় তাহলে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অক্সিজেন ও চিকিৎসা নিবে। ঢালাওভাবে সবার অক্সিজেন দরকার নাই।
একুশে টেলিভিশন: শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধের কোনো উপায় আছি কী-না?
ডা. শাকিল মাহমুদ: এক্ষেত্রে যেটা করবে সেটা হলো ঠান্ডা লাগাবে না, গরম পানি, আদা-পানি, লেবু-চা খাবে।
একুশে টেলিভিশন: এখন শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার লক্ষণীয়, এ অবস্থা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার যাবে কিভাবে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: বেশিরভাগ নিউমোনিয়ায় ভাইরাস জাতীয়। এক্ষেত্রে জ্বর আসবে, নাক দিয়ে পানি পড়বে, শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বাড়াতে হবে। শিশুর পুষ্টির লেভেল বাড়াতে হবে। বাচ্চার মাকেও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এবং বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এমন খাবার খাওয়াতে হবে। বাচ্চাকে যেন ঠান্ডা না লাগে তার জন্য সচেতন হতে হবে। সর্দি হলে এন্টিহিস্টামিন, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় সিরাপ খাওয়াতে হবে। শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী লেবুলাইজার করতে পারে।
একুশে টেলিভিশন: এখন অনেককেই উচ্চ রক্তচাপ বা এই জাতীয় রোগে ভুগতে দেখা যাচ্ছে, এর পেছেনে কারণ কি এবং সুস্থতা লাভের উপায় কি?
ডা. শাকিল মাহমুদ: এখন তো মানুষ বাসাতে বেশি থাকে, এতে করে কোলেস্টরেল বেড়ে যেতে পারে। খাওয়া দাওয়া বেশি হওয়ার ফলে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই তার প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং ওজন কমাতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে , খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রোটিন জাতীয় খাবার পরিমাণ মতো খেতে হবে ফ্যাট জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। সেই সাথে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। এভাবে রক্তচাপটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর ফলে তার অন্যান্য ঝুঁকিও কমে যাবে।
একুশে টেলিভিশন: এই রকম বন্দিদশায় ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীরা কিভাবে নিজেদের সুস্থ রাখবে?
ডা. শাকিল মাহমুদ: এই মুহূর্তে তাদের বাহির দলবেধে হাটার দরকার নাই। বাসার ছাদ বা রুমের ভেতরে হাটবে এবং ব্যায়াম করবে। এবং ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী যথারীতি ওষুধ চালিয়ে যাবে। এবং খাওয়া দাওয়া ক্যালরী হিসাব করে খাবে।
একুশে টেলিভিশন: করোনার প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি, স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বলছে দৃঢ় মনোবল ধরে রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চিকিৎসা নিলেই করোনাকে জয় করা সম্ভব, এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই….
ডা. শাকিল মাহমুদ: আমাদের স্বাস্থ্যজ্ঞান বাড়াতে হবে, আমাদের স্বাস্থ্যজ্ঞান নাই। সঠিক স্বাস্থ্যজ্ঞান বাড়াতে হবে, তা নিয়ে চর্চা করতে হবে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি ও বিভিন্ন মিডিয়াতে সঠিক জ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এভাবে পারিবারিক সামাজিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যজ্ঞান বাড়াতে হবে।
একুশে টেলিভিশন: সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন….
ডা. শাকিল মাহমুদ: বাঙালি খুবই আত্মঘাতী এবং সচেতন না । সুতরাং আত্মঘাতী জাতিকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। আত্মঘাতী হলে চলবে না, কারণ বিশাল দেশ, সরকারের পক্ষে সবকিছু একা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। আমি আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা না বাড়ালে এ ধরনের ভাইরাস, এ ধরনের মহামারি থেকে মুক্তি পেতে পারব না। সুতরাং স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এমবি