ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

পৃথিবীর সবচেয়ে বয়ষ্ক পুরুষ শ্রীমঙ্গলের রাম সিং!

বিকুল চক্রবর্তী, মৌলভীবাজার থেকে

প্রকাশিত : ১১:০৯, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গিনিচ বুক অব রেকর্ড অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে বয়ষ্ক পুরুষের বয়স ১১১ বছর। আর বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের মেকানীছড়ার রাম সিং গোঁড়ের বয়স ১৩৫ বছরেরও বেশি। তবে তার ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী বয়স ১১৯ প্লাস। এই হিসেবে রাম সিং গোঁড়ই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। 

এখন প্রয়োজন তার সমস্ত রেকর্ড গিনিচ বুক রেকর্ড নথিভুক্তকারীদের কাছে প্রেরণ।

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরা সীমান্তে একটি পাহাড়ী ছড়ায় পৃথক করা গ্রাম মেকানী ছড়া। যে গ্রামটি চিরসবুজ, শিতল ও শান্ত একটি গ্রাম। যার দিবসের প্রাণচঞ্চল্য মুহূর্তগুলো নিশি রাতের নিস্তব্দতার মতো। মানুষগুলোও প্রকৃতির মতো সরল। তবে আধুনিক যুগেও এই সরলা গ্রামের মানুষ পান করেন ছড়ার পানি ফুটিয়ে। 

এ গ্রামে রাতের আঁধারে আলোর সন্নিবেশ ঘটে কুপির বাতিতে। ৫/৭ কিলোমিটারের আগে নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। নেই মোবাইল নেটওয়ার্কও। অনেকটা আদি মানুষ হিসেবেই আছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা।

এমনই একটি সংবাদের তথ্য সংগ্রহে সেখানে যাওয়া। এ বিষয়ে এই গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তির সাথে দেখা করতে গিয়ে খোঁজে মেলে এই রাম সিং গোঁড়ের। 

রাম সিং হেঁটে হেঁটেই ঘরের বাইরে আসেন। কুশল বিনিময়ের পর তার বয়স জিঙ্গেস করতে তিনি বললেন, ১৩৫ বছর। এ কথা শোনার পর অনেকটা কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। তাঁকে জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো। 

জানতে চাইলাম ভোটার আইডি কার্ড আছে কিনা, বললেন আছে। দেখতে চাইলে তিনি চেয়ার থেকে উঠে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। আমিও তাঁর পেছন পেছন গেলাম। পুরান আমলের টিনের বাক্স বের করে তার তালা খুললেন। সেখান থেকে একটি ধুতির ভাজ থেকে বের করে আনলেন ভোটার আইডি কার্ডিটি। 

ভোটার আইডি কার্ডে তার জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ৬ আগস্ট ১৯০৫ সাল। তাঁর বাবার নাম বুগুরাম গোঁড়। আর মায়ের নাম কুন্তী গোঁড়। ভোটার আইডি নং- ১০২৪৯১৩৩৮৪।

আলাপ চারিতায় রাম সিং গোঁড় বলেন, তাঁর পিতার আদি ভূমি ছিল ভারতে। চা চাষের জন্য তার বাবা এবং দাদা এই এলাকায় প্রথম আসেন। তার দাদা ও বাবার হাতে প্রথম পুটিয়াছড়া চা বাগান সৃজন হয়। তার হাতে সৃজন হয় হরিণছড়া চা বাগান।

রাম সিং জানান, তিনি শ্রীমঙ্গলের প্রাচীন বিদ্যাপিঠ ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। তখন তিনি মৌলভীবাজার সড়কের কোন এক আচার্য্য বাড়িতে থেকে পড়তেন।

তিনি জানান, তার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর প্রায় ৬৫/৬৬ বছর বয়সে ২য় বিয়ে করেন। এই সংসারে তার ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ে জন্ম নেয়। আগের সংসারে শুধু একটি মেয়ে ছিল। আগের সংসারের মেয়ে ও পরের সংসারের বড় ছেলে ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। ছেলেমেয়ের ঘরের একাধিক নাতনী বিয়ে দিয়েছেন, তাদের সন্তানও ১৫/১৬ বছরের।

তার ছেলেমেয়ে, নাতি-পুতি, মেয়ের জামাই, নাতিন জামাই, পুত্রবধূ মিলিয়ে জীবিত সদস্য সংখ্যা ৭০ এর উপরে বলে জানান তিনি।  এখন সবাই আলাধা আলাধা থাকেন। তিনি থাকেন তার চতুর্থ ছেলে জগদীশ গোঁড়ের সঙ্গে।

তার নাতিনী মামনী গোঁড় জানায়, তার দাদা এখনও বেতের জিনিস তৈরি করতে পারেন। ঘরের টুকটাক কাজও করেন। এ সময় তিনি বাঁশ বেতের তৈরি নতুন একটি পাখা এনে বললেন, প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তাদের বিদ্যুৎ নেই। তাই দাদা কয়েকদিন আগে এই পাখাটি তৈরি করেছেন।

এ সময় চোখে পড়লো রাম সিং ধারালো দা দিয়ে পাখার জন্য বাঁশের কাঠি মসরিন করছেন। অতপর বড় একটি সুইয়ে নিজেই সুতা প্রবেশ করালেন এবং এটি দিয়ে পাখাটি সিলি করলেন। একশে’ ৩৫ বছর বয়সে এসেও তিনি এখনও কাজ করছেন। রাম সিং লিখতে-পড়তেও পারেন।

এ সময় পুত্র জগদীশ বললেন, টাকা-পয়সার অভাবে বাবাকে ফলমূল, হরলিক্স খেতে দিতে পারেন না। ডাক্তার বলেছে হরিলিক্স খাওয়ালে শরীরে শক্তি আসবে।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষক দ্বীপেন্দ্র ভট্টাচার্য্য বলেন, রাম সিং শ্রীমঙ্গলের একজন অতি প্রবীণ মানুষ। তিনি বলেন, আমার বয়স ৮০ বছর। ছোট বেলায় আমি পুরানবাজারে ত্রিপুরা রাজ্য ব্যাংকের ভগ্নাংশ দেখেছি। আর শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ১৯২৪ খ্রি. স্থাপিত হলেও প্রাথমিক শাখা স্থাপিত হয়েছে তারও অনেক আগে। যেহেতু ভোটার আইডি কার্ডে তাঁর জন্ম লেখা রয়েছে ১৯০৫ সাল, সে হিসেবেও তিনি ১১৯ বছরের। 

এ ব্যাপারে হরিণছড়া চা বাগানের ৮০ বছর বয়সী নিরেণ হাদিমা জানান, তিনি ১৯৬১ সালে হরিণছড়া চা বাগানের স্টাফ হিসেবে যোগ দেন। তখনই তিনি রাম সিং গোঁড়কে দেখেছেন বৃদ্ধ। ১৯৭১ সালে হরিণছড়া চা বাগান রক্ষায় রাম সিং গোঁড়ের ভূমিকা ছিল প্রবল। তিনি বলেন, স্টাফ বলতে আমি একা এবং শ্রমিক বলতে তিনি ছিলেন। রাম সিংকে অনুরোধ করে অনান্য বাগান থেকে শ্রমিক এনে পাতা তুলে বাগান রক্ষা করতেন। গাছসহ অনান্য মালামাল যাতে চুরি না হয় রাম সিং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা পাহাড়া দিতেন।

দীর্ঘায়ূ ধরে রাখতে রাম সিং গোঁড়ের প্রয়োজন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ভালো খাবার। তবে রাম সিং চান মরার আগে তার গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে তা দেখে যেতে। 

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি