ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ধর্ষককে ফাঁসাতে বিউটিকে খুন করে তার বাবা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৩০, ৭ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২২:৪৩, ৭ এপ্রিল ২০১৮

হবিগঞ্জের শায়েস্তগঞ্জে বিউটিকে রাস্তার পাশে খুনের পর তার লাশ ফেলে রাখা হয় হাওরে। গভীর রাতে মেয়েটির শরীরে ছুরি চালিয়ে ভাড়াটে খুনীরা যখন খুন করে তখন অদূরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করেন জন্মদাতা পিতা সায়েদ আলী।

বিউটির বাবা ছায়েদ আলীর জবানবন্দি উদ্ধৃত করে শনিবার নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা এসব তথ্য জানান।

বিউটি হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয় বাবুল মিয়াসহ আরো কয়েকজনকে। কিন্তু বাবুল নয় বিউটির বাবাই তাকে হত্যা করিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ।

এর আগে বিউটি ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বাদী ছায়েদ আলী আদালতে জবানবন্দি দেন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বর্ণনা করেন কিভাবে বিউটিকে নানার বাড়ি থেকে নিয়ে এসে খুনিদের হাতে তুলে দেন। জবানবন্দির পর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয় বলে জানান পুলিশ সুপার।

সংবাদ সম্মেলনে সুপার বলেন, স্বাধীনতার মাসে লাল সবুজের পতাকায় বিউটির হত্যা নিয়ে যে পোস্টটি সারাদেশে ভাইরাল হয়েছে, তদন্তে তার বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত এবং সাক্ষীদের জবানবন্দি উদ্ধৃত করে পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা বলেন, বিউটির ধর্ষণকারী বাবুল মিয়া অলিপুরে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার মা ইউপি সদস্য হওয়ায় এলাকায় তার প্রভাব রয়েছে। এর আগে বাবুল এক প্রবাসীর স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এর পর বিউটির ওপর তার দৃষ্টি পড়ে। গড়ে তোলেন প্রেমের সম্পর্ক, দেখান বিয়ের প্রলোভন। পরে অলিপুর এলাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিউটিকে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সেখানে নিয়ে গেলে খবরটি জানতে পারেন বিউটির মা হুসনা বেগম। তিনিও আরএফএল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। হুসনা বেগম এবং ছায়েদ সেখানে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসেন।

বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে এলাকায় সালিশের মাধ্যমে নিস্পত্তির চেষ্টা করা হয়। সালিশে বিউটিকে বিয়ে করতে বলা হলে বাবুল অস্বীকৃতি জানায়।

পুলিশ সুপার বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন বিউটির বাবা ছায়েদ। গত ৪ মার্চ মামলাটি শায়েস্তাগঞ্জ থানায় নথিভুক্ত এবং ১২ মার্চ বিউটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও আদালতে জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। বাবুল তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নিবে বলেও জবানবন্দিতে জানায় বিউটি।

পুলিশ সুপার জানান, এরপর বিউটিকে লাখাই উপজেলার গুণিপুর গ্রামে নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ সুযোগে ফন্দি আঁটেন ইউপি নির্বাচনে বাবুলের মায়ের কাছে হেরে যাওয়া আসমা আক্তারের স্বামী ময়না মিয়া।

গত ইউপি নির্বাচনে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন থেকে সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে নির্বাচন করে বাবুলের মা কলম চান বিবির কাছে ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার হেরে যান। এরপর থেকেই দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এরই জের ধরে বিউটিকে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনায় মামলায় সাক্ষী হন ময়না। তিনি প্রায়ই ছায়েদকে বোঝাতে থাকেন, বাবুল বিয়ে না করলে বিউটিকে কেউ বিয়ে করবে না। তার অন্য সন্তানদেরও বিয়ে হবে না। এর চেয়ে বিউটিকে মেরে বাবুল ও তার মাকে ফাঁসানোর পাশাপাশি প্রতিশোধও নেওয়া হবে।

এক পর্যায়ে ময়নার ফাঁদে ছায়েদ পা দেন। পরে ১০ হাজার টাকায় পেশাদার খুনি ভাড়া করে এবং তাকে আড়াই হাজার টাকা অগ্রীম দেন ময়না।

পুলিশ কর্মকর্তা বিধান ত্রিপুরা বলেন, ঘটনার দিন রাতে ছায়েদ, ময়না ও ভাড়াটে খুনি গুণিপুর গ্রামে গিয়ে বিউটিকে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে আসেন। পরে লাখাই উপজেলার হরিণাকোন গ্রামে ভাড়াটে লোক বিউটির হাত পা বেঁধে রাখে এবং ময়না ছুরি দিয়ে পাঁচটি আঘাত করে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যার পর বিউটির লাশ হাওরে ফেলে রাখা হয়।

পুলিশ সুপার আরো বলেন, মেয়ে হত্যার পর একজন বাবার যে অনুভূতি থাকে ছায়েদের মধ্যে তা ছিল না। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তার এবং ময়নার গুণিপুর গ্রামে উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ৫ মার্চ গ্রেফতার করা হয় ময়নাকে এবং পরদিন ছায়েদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে এখনও ভাড়াটে লোককে ধরা যায়নি। তাকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে গ্রেপ্তার করার পর অভিযোগপত্র দাখিল করে বিচার শুরু করা যাবে বলে জানান তিনি।

বাবুল মিয়া সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকলেও তার কারণেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।

এর আগে শুক্রবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে অন্যদের নাম জানান ময়না। আর শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ বিচারিক হাকিম তৌহিদুল ইসলামের আদালতে জবানবন্দি দেন ছায়েদ আলী।

এছাড়া সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বিউটির নানি ফাতেমা বেগম। শুক্রবার রাতে একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বাবুল। তিনি বিউটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিলেও হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন।

উল্লেখ্য, গত ১৭ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জের হাওরে বিউটির লাশ পাওয়া যায়। এসময় তার শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। পরে এ ঘটনায় ১৮ মার্চ বিউটির বাবা সায়েদ আলী বাদী হয়ে বাবুল ও তার মা কমলাকে আসামি করে মামলা করেন।

এরপর পুলিশ বাবুলের মা কলম চান ও বন্ধু ইসমাইল মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। প্রথম দফায় তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ ওঠলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জাকির হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় শায়েস্তাগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মানিকুল ইসলাম।

আর/টিকে


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি