ঢাকা, রবিবার   ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অভাব নিয়েই বেঁচে আছেন আনুরা, জোটেনি সরকারী ভাতা!

নাটোর প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৭:৩৪, ১৪ মার্চ ২০২০

কয়েক মাস আগেই ৬০ বছর পেরিয়েছে তার। বার্ধক্য পিছু ছাড়ছে না। তবুও দু-মুঠো ভাতের জন্য কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হতে হয়। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে বা অন্যের কাজ করে জীবন কাটছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের দেবনগর গ্রামের মরহুম ময়েন উদ্দিনের মেয় আনুরা বেগমের। কোন কিছুতেই পিছুটান নেই তার। ৪৬ বছর আগে বিয়ে হলেও ঘর টেকেনি একমাসও। ৩৫ বছর আগে বাবা মারা গেছেন। তার মৃত্যুর আগে মা মারা যান। তাই তার জীবন কাটছে একাকী। একদিন খাবার জুটলেও হয়ত দু’দিন অনাহারে কাটাতে হয়। বাবার রেখে যাওয়া এক চিলতে জমির ওপর খুপরি ঘর করে বসবাস করছেন আনুরা।
 

দুবেলা খাবার জোটাতেই তার হিমশিম খেতে হয়। তার ঘরে বাতি জ্বালানোর পয়সা জোগার করা তার পক্ষে দুরুহু। তাই রাতে অন্ধকারে সাপ পোকামাকড়ের সাথেই বাস করছেন গত ৩৫ বছর ধরে।

স্থানীয়রা জানায়, স্বজনহারা এই বৃদ্ধার বয়স্ক বা বিধবা ভাতা কোনটিই জোটেনি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিসহ জনপ্রতিনিধিদের নজর পড়েনি এই অসহায় বৃদ্ধার প্রতি। এলাকাবাসীর জিজ্ঞাসা আর কত বয়স হলে আনুরার ভাগ্যে জুটবে সরকারী ভাতা।
 
দেবনগর গ্রামের বাসিন্দা ও তকিনগর স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, প্রায় ৪৬ বছর আগে চৌদ্দ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী রহিমানপুর টিকরপাড়া গ্রামে আদরের মেয়ে আনূরার বিয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা-মা। কিন্তু স্বামীর পরিবারের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পারায় বিয়ের এক মাসের মাথায় সংসার ভেঙ্গে যায় আনূরা বেগমের। এর পর অনেক সম্বন্ধ এসেছে কিন্তু এক মাসের মাথায় প্রথম সংসার ভেঙ্গে যাওয়ায় অভিমানে আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। এখন বার্ধক্য জেঁকে বসায় জীবন যুদ্ধে আর পেরে উঠছেন না তিনি। কোন উপার্জন নেই। খাবার কেনার সামর্থ নেই, রাতে আলো (প্রদীপ) জ্বালানোর তেল কেনারও টাকা নেই। প্রকট আত্মসম্মানবোধের কারনে ভিক্ষাবৃত্তিও করেন না বা কারো দেয়া কিছু হাত পেতেও নিতে চাননা। 

ফলে দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে তার। রাতে অন্ধকারেই বসবাস করতে হয় তাকে। রাতে সাপ-পোকামকড় এখন আনুরা বেগমের সঙ্গি। রোগ ব্যাধী হলে গাছালি বা স্থানীয় এক ডাক্তারের দেয়া ঔষধই তার বেঁচে থাকার ভরসা। তাকে একটি বিধবা বা বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থাকরে দিলে শেষ জীবনে হয়ত তাকে আর কষ্ট করতে হতনা। ওই বৃদ্ধার মুখে শুনেছেন,বয়স্ক ভাতার জন্য তিনি মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছেও গিয়েছেন। 

মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন,বৃদ্ধা আনুরা যে বাড়িতে বসবাস করেন,সেই বাড়িতে চলাচল পথে প্রতিবেশি আকালি বেড়া দিয়েছেন। ফলে এই বৃদ্ধ বয়সে এখন কষ্ট করে বেড়া ঠেলে ঘরে যেতে হয় আনুরাকে। বিষয়টি স্থানীয়দের পিড়া দিলেও প্রতিকার হচ্ছে না।

অপর প্রতিবেশি রবিউল ইসলাম বলেন, বৃদ্ধা আনুরার আপন বলতে আর কেউ নেই। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া বাড়ির দুই শতাংশ জমি ছাড়া আর কিছুই নেই তার। আজ পর্যন্ত বিধবা ভাতা বা সরকারী কোন সহায়তা জোটেনি তার। আত্মসম্মানের চিন্তায় মানুষের বাড়িতে তিনি ভিক্ষা করেন না। অন্যের জমিতে ফসল কাটার পর পড়ে থাকা এবং ইদুরের গর্ত থেকে ধান বা গমের শীষ কুড়িয়ে জমা করে তাই দিয়ে বাকিটুকুও চালিয়ে নেন। মানুষের জমিতে মুগ কালাই ও মটরের ফল উঠিয়ে যে সামান্য টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে সারা বছর তেল, লবন কেনেন। ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে নেই কোন খাবার ও পানির ব্যবস্থা। প্রকৃতির কাজ সারাও নেই কোন সুবিধা। সামান্য টাকায় এসবের পর কেরোসিন কেনার টাকা থাকে না। তাই অন্ধকারের মধ্যেই রাত কাটিয়ে দেন। এমনকি রাতে ঘরে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। এভাবে অন্ধকার ঘরে সাপ-পোকা মাকড়ের সাথেই রাত কাটে আনুরা বেগমের। আনুরা বেগমের জন্য সরকারি সহায়তার দাবি জানান তিনি। 
আনুরা বেগম বলেন,তিনি মেম্বার চেয়ারম্যানদের কাছে কয়েকবার গিয়েছেন,তারা প্রতিবারই বলেছেন হবে। আর যেতে মন চায়না। ইঁদুরের গর্তে যা পাই তাই সেদ্ধ করে খাই। কষ্ট হলেও অন্যের কাছে কিছু  হাত পেতে নিতে লজ্জা করে। গতর খাটিয়ে যা পাই তা দিয়েই দিন পার করছি। বৃদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,আমার এই সুখটাও কেড়ে নিতে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে প্রতিবেশী আকালি। আমার ঘরে যাওয়ার রাস্তায় বেড়া দেয়ায় বেড়া ঠেলে ঘরে যেতে কষ্ট হয়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, ওই বৃদ্ধা বয়স্কভাতা পাওয়ার যোগ্য। অনলাইনে আবেদন করা আছে। বছর চারেক আগে বিপ্লব নামে স্থানীয়  এক শিক্ষকের দেওয়া এক বান্ডিল টিন ও তিন হাজার টাকায় কোন রকমের একটি ঘর করেছেন। ওই বৃদ্ধার ঘরে যাওয়ার রাস্তায় বেড়া দেয়ার বিষয়টি তিনি জানেননা। যেই বেড়া দিয়ে থাকুকনা কেন তা অপসারন করা হবে।
ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুষ কুদ্দুস বলেন, এব্যাপারে ওই বৃদ্ধা তার কাছে কখনও আসেননি। খবরটি জানার পর ওই ওয়ার্ডের মেম্বারকে বলেছি খবর নিতে। এবারের বরাদ্দেই তাকে সরকারি ভাতার আওতায় আনা হবে।  আর চলাচল পথে বেড়া দেয়ার বিষয়টিও খোজঁ নিতে বলেছেন ইউপি সদস্যকে। 

বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেছেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনায় তার জন্য যতটুকু করা সম্ভব তা করা হবে। আর যাতায়াতের পথে বেড়া দেয়ার বিষয়টি দেখা হচ্ছে। অবৈধ হলে তা অপসারন করা হবে। 

কেআই/আরকে
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি