জিপিএ-৫ কাঁদাচ্ছে মেধাবী তানিয়াকে
প্রকাশিত : ১৯:৫১, ৪ জুন ২০২০
তানিয়া খাতুন- ছবি একুশে টেলিভিশন।
এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও দরিদ্রতার কাছে হার মেনে হাসির পরিবর্তে কান্নাই সাথী হয়েছে এক মেধাবী ছাত্রীর। নাম তানিয়া খাতুন। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার প্রতি অন্যরকম আগ্রহ। বাবা তৈয়ব আলী মন্টু, পেশায় দিন মজুর। আর মা আছিয়া খাতুন গৃহিণী।
দরিদ্রতা বারবার তানিয়ার পড়ালেখার প্রতিবন্ধিকতা তৈরি করলেও পিছু হটেনি সে। অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছিলো সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ির পাশে পরচুলা তৈরির কারখানায় কাজ করত। নিজের লেখা-পড়া, পোশাক আর হাত খরচের টাকা জুগিয়েছে এই কাজ করেই।
হতদরিদ্র বাবার কাছ থেকে তানিয়া নেয়নি একটি টাকাও। উপরন্তু মাঝে মধ্যে পরিবারকে সহায়তা করেছে সে। আর এভাবে নিজের মেধা, শ্রম আর অধ্যাবসায় দিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তানিয়া।
কিন্তু অর্থাভাবে হয়তো এখানেই থামিয়ে দিতে হবে পড়ালেখার পথচলা। সামাজিকতা রক্ষার্থে চাপে পড়ে হয়তো সাজতে হবে কিশোরী বধূ। অদম্য মেধাবী তানিয়ার লেখাপড়ার ইচ্ছে দরিদ্রতার হাত ধরে ছিকেয় তুলে রাখতে হবে। তাই জিপিএ-৫ পেয়েও কাঁদতে হচ্ছে এই কিশোরীকে।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চড়ইকোল গ্রামের দিনমজুর তৈয়ব আলী মন্টুর মেয়ে তানিয়া। চড়ইকোল উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে।
দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট তানিয়া। বাবা তৈয়ব আলী কৃষিকাজ ও দিনমুজুরী করেন। মা গৃহিণী। বড় ভাই আতিকুর রহমান ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করেন। ছোট ভাই সুজন হোসেন অটোভ্যান চালক। দুই ভাই বিয়ে করেছেন। সবাই একসাথে থাকলেও নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের। তাই প্রতিদিন সময় বের করে বাড়ির পাশে পরচুলার কারখানায় কাজ করে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই চালিয়েছেন তানিয়া।
কিন্তু এতো কষ্ট করে ভাল ফলাফল করেও কান্না থামছে না তার। লেখাপড়ার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কুলহারা ভাসা পানার মতো নিজেকে অসহায়ত্বের সারিতে দাঁড় করিয়েছে তানিয়া। কারণ দারিদ্র পরিবারের পক্ষে তার লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব নয়।
তানিয়ার সাথে কথা বলতেই চোখে ছলছল জল নিয়ে কষ্ট ভরা কণ্ঠে জানায়, রেজাল্ট নিয়ে কখনও টেনশন হয়নি তার। সে জানতো জিপিএ-৫ পাবে। ভবিষ্যতে বুয়েটে পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখে তানিয়া। এজন্য এইচএসসিতে ভাল কলেজে পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করতে হবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বড় বাঁধা দরিদ্রতা। টাকার অভাবে হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে লেখাপড়া। আর এটা ভেবে জিপিএ-৫ পেয়েও দিনরাত কাঁদছে সে।
তানিয়ার ভাষায়, ‘রাজশাহীতে যেকোনো একটি ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া ও প্রতিমাসের খরচ চালানোর সামর্থ আমার বাবা-মা ও ভাইদের নেই। তারা এতো টাকা দিতে পারবে না বলে জানিয়েছে। তাহলে কি আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না? এখানেই আমার জীবন থেমে যাবে?’ বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকে তানিয়া।
বাবা তৈয়ব আলী ও মা আছিয়া খাতুন বলেন, ‘আমাদের সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। সবার মতো স্বপ্ন আছে, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের অর্থ নেই। আমরা চাই আমাদের মেয়ে অনেক বড় হোক, অনেকদূর লেখা-পাড়া করে মানুষের মত মানুষ হোক, কিন্ত তাকে পড়ানোর মতো টাকা নেই। বাড়িটুকু ছাড়া নেই কোনো জমি। এখন সরকার অথবা সমাজের বিত্তবান ও দয়ালু মানুষ যদি কেউ সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের মেয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে।’
চড়ইকোল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস রঞ্জন তলাপাত্র বলেন, ‘তানিয়া খুবই মেধাবী ছাত্রী। ভাল রেজাল্ট করা তার জেদ ছিল। তার ফল সে পেয়েছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু তার বাবা দরিদ্র হওয়ায় সে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে এ পর্যন্ত এসেছে। এখন অর্থাভাবে তার লেখাপড়ার জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, এটা দুঃখজনক। সরকার বা সমাজের বিত্তবান কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে তানিয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।’
এআই/এনএস/
আরও পড়ুন