ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

মুন্সিগঞ্জে চলছে নৌকা তৈরির ধুম

সিরাজদিখান সংবাদদাতা

প্রকাশিত : ২১:৪৩, ১২ জুন ২০২০

বর্ষার আগমণকে ঘিরে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে পানি। নদ-নদী ভরে উঠছে এবং তা ছাপিয়ে পড়ছে বিলগুলোতে। গ্রামের চারপাশে বর্ষার থইথই পানির আগাম পূর্বাভাসের সাথে সাথে গ্রামগঞ্জের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বর্ষায় কোথাও যেতে নৌকাই একমাত্র ভরসা। তাইতো বর্ষাকাল না আসতেই জ্যৈষ্ঠ মাসেই শুরু হয়ে গেছে বর্ষাকালের আয়োজন। এলাকায় কারিগরদের মহাব্যস্ততা, বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি হচ্ছে নানা রকম নৌকা। পানি আরেকটু বেশি হলে আরো কদর বাড়বে এসব নৌকার। তাই বসে নেই নৌকা তৈরীর কারিগররা। চলছে নৌকা তৈরী ও মেরামতের ধুম।

গ্রাম এলাকায় মৌসুমি ডিঙ্গি নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মাঝি ও কারিগররা। বর্ষার পানি বাড়ার সাথে সাথে আশ-পাশের গ্রামে গৃহস্থলি কাজে এবং খেয়া পারাপারে ও গো-খাদ্যের জন্য কোষা ও ডিঙি নৌকার কদর বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আর এর সুবাদে সিরাজদিখানের ইছাপুরা বাসস্ট্যান্ডের দূর্গমন্দিরের পাশে এই করোনাকালেও গড়ে উঠেছে ডিঙি ও কোষা নৌকা তৈরী ও বিক্রির অস্থায়ী বাজার। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন ক্রেতারা তাদের পছন্দসই নৌকা এখান থেকে কিনে থাকেন। 

ইছামতি, ধলেশ্বরী নদী ঘেরা সিরাজদিখান উপজেলার প্রায় অর্ধেক অংশ বর্ষা শুরু হওয়ার সাঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত হয়ে থাকে। বর্ষা মৌসুম এলেই এ এলাকার মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার করে থাকে। উপজেলার নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা নৌকার মাধ্যমে স্কুলে যাতায়াত করে থাকে। বর্ষার শুরুতেই এলাকার মৌসুমি জেলেরা নৌকা দিয়ে রাত-দিন মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উপজেলার নিচু এলাকার বাসিন্দারা নৌকার মাধ্যমে খেয়া পার হয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম ও স্কুল, কলেজ, হাট বাজারে পারাপার হয়ে থাকে।

সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার ইছাপুরা, মধ্যপাড়া, রশুনিয়া, সিরাজদিখান বাজার, বালুরচর বাজার, গোডাউন বাজার, তালতলা বাজার, মধ্যপাড়া বাজার, ভাড়ারিয়া বাজার, মাছ ধরার ও চলাচলের উপযোগী নৌকা অথবা ট্রলার তৈরির ধুম পড়েছে। কেউ তার পুরানো নৌকা অথবা কাঠের ট্রলারটিকে মেরামত করছেন। কেউ নতুন নৌকা তৈরী অথবা আবার কেউ কেউ মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত নৌকা রং ও আলকাতরা দিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করছেন। এভাবেই মহাব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।

জানা গেছে, এ বছর সিরাজদিখানে কয়েক হাজার নতুন নৌকা নির্মিত হচ্ছে। উপজেলার সিরাজদিখান, ইছাপুরা, রাজানগর, বালুরচর, কালীনগর, কষ্ণনগর, চরবয়রাগাদী, পাইনারচর, শেখরনগর, ভাড়ারিয়া, মধ্যপাড়া, খারশুল, চিত্রকোট ইউনিয়নজুড়ে বেশকিছু নৌকার ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এসব গ্রামে প্রায় বাড়িতেই বর্ষাকালে যাতায়াতের অন্যতম বাহন হিসেবে রয়েছে একটি করে নৌকা। এক সময় বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকায় পাল তোলা নৌকা চলতো। বিভিন্ন হাট-বাজারে মালামাল আনা নেওয়ার জন্য গয়না, ডিঙ্গি ইত্যাদি নৌকার ব্যবহার হতো।

তবে সম্প্রতি সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের কারণে দিনদিন নৌকার ব্যবহার কমে যাওয়ায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত কারিগরদের জন্য টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে নৌকা তৈরি করে আসছেন উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের কৃষ্ণ মন্ডল। ৫৫ বছরের এ কারিগর জানান, হঠাৎ করেই বর্ষার পানি বেড়ে যাওয়ায় নৌকা বিক্রিও বেড়ে গেছে। বর্তমানে চাম্বল ও কড়ই কাঠ দিয়েই নৌকা তৈরি করে থাকেন। যেগুলোর দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ৮ হাত থেকে ১২ হাত পর্যন্ত। তবে কারো প্রয়োজনে তার চেয়েও কয়েকগুণ বড় নৌকা চুক্তিতে তৈরি করেন তিনি। 

কৃষ্ণ মন্ডল জানান, ৮ হাতের একটি নৌকা বাজারে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ১০ হাতের নৌকা ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন তিনি। দিনে ১০ থেকে ১২টি নৌকা বিক্রি করা সম্ভব হয়। একেকটি নৌকা বিক্রি করে খরচ বাদে হাতে থাকে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা।

এই কাঠমিস্ত্রি আরও জানান, কেবল বর্ষা এলেই তিনি নৌকা তৈরি করে থাকেন। বছরের বাকি সময় তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। বর্ষা আসতেই এ বছর তিনি চাম্বল ও কড়ই কাঠের সঙ্গে রুয়া, বাঘা, বাটাম আর সানি কাঠ দ্বারা গড়ছেন একেকটি নৌকা। 

বসতঘর নির্মাণের কাজ করে থাকেন মধ্যপাড়া গ্রামের কারিগর শম্ভু মন্ডল। জীবনের ২৫ বছর ধরেই বর্ষা এলে বসতঘর ছেড়ে নৌকা তৈরি করেন তিনি। এক সময় ভালো ভালো সব কাঠ দিয়ে নৌকা করা হলেও এখন তিনি নৌকায় তৈরি করছেন মেহগনি, চাম্বল ও কড়ই কাঠে। নৌকা তৈরিতে কাঠ ছাড়াও মাটিয়া তেল, আলকাতরা, তারকাটা, গজাল, পাতাম ইত্যাদির দরকার হয় বলে জানিয়েছেন শম্ভু মন্ডল। 

তিনি আরো জানান, দুইজন কারিগর মিলে দিনে মাত্র দুটি নৌকা তৈরি করতে পারেন। ৮ হাত থেকে শুরু করে ১২ হাত পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের নৌকাও তৈরি করে থাকেন তিনি। যেগুলো বাজারে বিক্রি করে নৌকাপ্রতি ৪শ থেকে সাড়ে ৪শ টাকা লাভ হয় তার।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি