ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

ঠাকুরগাঁওয়ে মা ও দুই সন্তানের মৃত্যু জনমনে সন্দেহ বাড়াচ্ছে

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি 

প্রকাশিত : ২০:১০, ১৭ অক্টোবর ২০২০

ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ভরনিয়া শিয়ালডাঙ্গী গ্রামে গত বৃহস্পতিবার মা ও দুই সন্তানের মৃত্যু রহস্য জনমনে সন্দেহের জাল ছড়াচ্ছে। এলাকার লোকজনের মধ্যে দুই ধরণের মতামত পাওয়া গেলেও খুনের সন্দেহ কেউ উড়িয়ে দিতে পারছেন না।  

প্রশাসন, পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা, স্থানীয় লোকজন সুরতহাল দেখে কেউই এটিকে এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা বলতে পারেননি। তবে পুলিশ বলছেন ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ঘটনার দিন ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও ঘটনার একদিন পর তাদের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হেফাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
 
এদিকে তিনজনের মৃত্যুর ব্যাপারে শনিবার পর্যন্ত কেউ মামলা করেনি। পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে। শুক্রবার  রাতে পারিবারিক গোরস্থানে ৩  জনের লাশ দাফন করা হয়।

উল্লেখ্য, শিয়ালডাঙ্গী গ্রামের আকবর হোসেনের স্ত্রী আরিফা আক্তার( ৩২) তার মেয়ে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী  আঁখি আক্তার( ১০) ও ছেলে আরাফাত (৪) এর মৃতদেহ গত বৃহস্পতিবার ভোর ৬ টার দিকে তাদের বাড়ির পাশে একটি ডোবায় পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন পানি থেকে লাশ তুলে আনার পর তিনজনের মুখে বিষের গন্ধ পায়। এরপর থেকে পুলিশ, সিআইডি, র‌্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে তদন্ত কাজ করছেন। শনিবার ওই ডোবার পানি ছেঁকে ফেলা হয়েছে। তদন্তকারীরা ডোবা থেকে দু’টি বোতল আর একটি সেন্ডেল আলামত হিসেবে পেয়েছেন। এছাড়া ঘটনার রাতে শিশু আঁখির খাতা থেকে একটি চিঠি উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন রাণীশংকৈল থানার ওসি জাহিদ ইকবাল। সেই চিঠি তিনি দেখাচ্ছেন না বা এ ব্যাপারে ক্যামেরার সামনে কথাও বলছেন না।

তবে তার মতে উদ্ধারকৃত চিরকুটে গৃহবধু আরিফা লিখেছেন, ‘আহারে জীবন, সংসারের অভাব, অশান্তি আর ভালো লাগে না। আমি একাই চলে যেতাম, কিন্তু আমি একা গেলে আমার বাচ্চারা মা মা বলে হাহাকার করবে। এ জন্য ওদের নিয়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে আমরা মারা যাওয়ার পর, আমাদের তিনজনের কবর এক সাথে দিও।’ 
   
চিরকুটের আরো লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি নিজেই আত্মহত্যা করিলাম। এটা সত্যি একশ বার, একশবার, একশ বার।’চিরকুটে নিহত আরিফার স্বামী আকবরকে উদ্দেশ্য করে লেখেছেন- ‘স্বামী তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমার বিয়ের মোহরানা মাফ করে দিলাম। তুমি ভালো থেকো। শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে উদ্দেশ্য করে লিখে গেছেন- ‘আপনাদের সঙ্গে অনেক খারাপ আচরণ করেছি, এজন্য মাফ চাই। 

এদিকে আরিফার ভাই চিঠি উদ্ধারের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি চিঠিটি দেখেছি। সেটি আমার বোনের লেখা নয়। এটি সৃষ্টি  করা একটি কাগজ। তিনি তার বোনের হত্যার বিচার চান।

এলাকার অনেকে আকবরের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলেও মৃত্যুর রহস্য তাদের এলোমেলো করে দিচ্ছে। তাদের মতে, বিষ খেলে মানুষ ছটফট করবে বাঁচার চেষ্টা করবে চিৎকার চেচামেচি করবে। কিন্তু পাশের প্রতিবেশিরাও কোন চিৎকার চেচামেচির শব্দ শোনেননি। তারপর বিষ খেলে ৩ জন মানুষ ডোবায় পড়ে কিভাবে ? তাছাড়া ডোবায় তেমন পানি নেই। যারা ঐ পানিতে নেমেছেন তাদের মতে সেখানে কোমর পানি ছিল। কোমর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও অস্বাভাবিক।

এই তিনজনের মৃত্যু রহস্য নিয়ে শনিবার দিনভর শতশত মানুষ ঐ বাড়ির সামনে জড়ো হয়। তারা ভিড় করে নানা জল্পনা কল্পনা করেন। তবে তারা পরিস্কার করে কিছু বলতে রাজি হননি। অনেকেই তিন জনের মৃত্যু খুন হতে পারে ভেবে অযথা এ বিষয়ে জড়াতে চাননা। তবে ঐ গ্রামে একটি মহল বিষয়টি নিয়ে আপোষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে গুঞ্জন শোনা যায়।   

এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘উদ্ধার করা চিঠিটি আরিদার নিজের লেখা কি না তা নিশ্চিত করতে আমরা যাচাই করছি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি।’

নিহত আরিদার স্বামী আকবর আলী বলেন, ‘অভাব অনটনের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-বিবাদ হয়েই থাকে। গত মঙ্গলবার বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। এর পরে গত বুধবার সন্ধ্যায় আমার বাবার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত লেনদেন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটির শেষে আমার স্ত্রী আরিদা বলেছিল, তোমার এত ঋণ পরিশোধ করবে কিভাবে। এত ঋণ আমার ভাল লাগে না। আমি তোমার বাড়িতে থাকবো না। তবে আমি যেখানে যাই ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’

আকবর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সে এভাবে আমাকে ছেড়ে আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চলে যাবে, তা বুঝিনি।’
ধর্মগড় ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মাইনুদ্দিন হোসেন ও স্থানীয়রা জানান, আরিদার স্বামী আকবর ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কোভিড-১৯ এর কারণে বেশ কয়েক মাস ব্যবসা বন্ধ ছিল। বর্তমানে তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। এতে সংসারে অভাব দেখা দেয়।

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রকিবুল আলম চয়ন বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে আরিফা বেগম ও তার দুই সন্তানের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদনের জন্য সংগ্রহকৃত নমুনাগুলো রাজশাহীর ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হবে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। এরপর মত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।’

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি