৪৯ বছরেও সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি বেনাপোল স্থলবন্দর
প্রকাশিত : ২২:৫৭, ২ নভেম্বর ২০২০
স্থলপথে আমদানি, রফতানি বাণিজ্য ও রাজস্ব আয়ের দিক দিয়ে বেনাপোল বন্দর সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি বন্দরটি। রহস্যজনক কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে না। ফলে বন্দরে আমদানি পণ্য চুরি, দুর্বৃত্তদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বার বার ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডসহ নানান অপ্রীতিকর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এপথে আমদানিতে নিরৎসাহিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলছেন, সিসি ক্যামেরা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ালেও বন্দর কর্তৃপক্ষের গরিমশিতে তা আজও থমকে রয়েছে। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, খুব দ্রুত সিসি ক্যামেরা স্থাপন হবে। এতে বন্দরের নিরাপত্তা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বেনাপোল বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ওয়্যারহাউজিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। ভৌগলিক কারণে এটি দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরে পরিনত হয়েছে। পরে মংলা বন্দরের অধীনে এর কার্যক্রম চলত। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এটি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অধিনেই পরিচালিত হয়ে আসছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এপথে প্রথম থেকে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি। দেশে স্থলপথে যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয় তার ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে শুধু বেনাপোল বন্দর দিয়ে। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্য হয়ে থাকে। যা থেকে সরকারের রাজস্ব আসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমদানি পণ্য ও কর্মকর্তা-কর্মীচারিদের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজ পর্যন্ত এবন্দরটিতে স্থাপন হয়নি।
নানা অজুহাতে পার করছে ৪৮ বছর। ফলে বন্দর অভ্যন্তরে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি পণ্য পাচার, নাশকতামূলক বন্দরের
পণ্যগারে অগ্নিকান্ড, ককটেল বিস্ফোরণ এমন কি নিরাপত্তাকর্মী হত্যার মতোও ঘটনা ঘটছে। তবে সিসি ক্যামেরা না থাকায় এসব ঘটনার রহস্য উৎঘাটন ও অভিযুক্তরা সব সময় থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এতে ব্যবসায়ীরা লোকসান ও আতঙ্কের মধ্যে পড়ে এবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
বেনাপোল বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আমদানি পণ্য প্রবেশদ্বারসহ দুই কিলোমিটার বন্দর এলাকা জুড়ে কোথাও কোনো সিসি ক্যামেরা আজ পর্যন্ত স্থাপন করা হয়নি। প্রয়োজন ছাড়া বন্দরের মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও অবাধে বহিরাগতরা প্রবেশ করছেন। বন্দরের অভ্যন্তরের সড়ক ও পণ্যাগারের (শেড) বেহাল দশা। চুরি হওয়া আমদানি পণ্য কেনা বেচার জন্য বন্দরের সামনেই নামে-বেনামে শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের ধারণা, এসব অব্যবস্থানা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করায় ২০১১- ১২ অর্থবছর থেকে এখানে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শুল্ক হাউজের রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, বন্দরে বারবার আগুন আর ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে ব্যবসায়ীরা কিভাবে এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি করবেন? আশ্বাসে থমকে রয়েছে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ।
রফতানিকারক তৌহিদুজ্জামান জানান, ডিজিটাল দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরে সিসি ক্যামেরা থাকবেনা এটা হয়না। সিসি ক্যামেরা যেমন আমদানি পণ্যের নিরাপত্তা বাড়ায় তেমনি সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদেরও নিরাপত্তা দেয়।
শার্শা উপজেলা দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান লিটু জানান, বেনাপোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর আজ পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি এটা দুঃখজনক। অথচ বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। রয়েছে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত এসি ওয়ারহাউজসহ আরও অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। যার একটিও আধুনিক সুবিধা নেই বেনাপোল বন্দরে। প্রতি বছরে ৫ ভাগ করে মাসুল বৃদ্ধি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে লোকসানের মুখে পড়ে ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্য কমিয়ে দিচ্ছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সিসি ক্যামেরা এখন কোন প্রসাধনী জিনিস না। বন্দর কর্তৃপক্ষ বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন পর্যন্ত এবন্দরে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়নি। প্রতিটি বৈঠকে উন্নয়নের ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখানে নেই কোন নজরদারি। ফলে পণ্য চুরি, অগ্নিকান্ডসহ নানান ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন।
ইন্দো বাংলা চেম্বার অব কর্মাসের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা লাগাতে বন্দর কর্তৃপক্ষের গরিমশি বুঝিনা। এটা সরকারকে দেখতে হবে।
বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুল জলিল জানান, খুব দ্রুত বন্দরে সিসি ক্যামেরা বসবে। এতে বন্দরের যেমন নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে তেমনি কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে।
উল্লেখ্য, গত ১০ বছরে বেনাপোল বন্দরে বড় ধরনের ৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে এক দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বন্দর পণ্যগার থেকে ১০টি ককটেল উদ্ধার ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অকশনের মালের সাথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমদানিকৃত মালামাল। বন্দরে সিসি ক্যামেরা না থাকায় অগ্নিকান্ডের ও পণ্য চুরির কোন রহস্য বা দুর্বৃত্তরা শনাক্ত হয়নি।
কেআই//
আরও পড়ুন