ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাবা, চাচা বা ফুফা নয়, হত্যাকারী স্বয়ং মা!

বাগেরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৮:৫৬, ২৮ নভেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২১:০৭, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২

শিশু সোহানা ও ঘাতক মা শান্তা আক্তার পিংকি

শিশু সোহানা ও ঘাতক মা শান্তা আক্তার পিংকি

সকল জল্পনা কল্পনা ও নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে খুলল বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে চাঞ্চল্যকর শিশু হত্যার জট। বাবা, চাচা ও ফুফা কেউ নয়, মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকিই হত্যা করেছেন তার ১৭ দিন বয়সীয় শিশুকন্যা সোহানাকে। 

সেই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন নির্মম হত্যার শিকার শিশুটির মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকি (২২)। শনিবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে বাগেরহাট জেলা পুলিশ সুপার এসব তথ্য জানান।

এদিকে হ্যত্যার মূল রহস্য উদঘাটন হওয়ায় স্বস্তি ফিরে এসেছে এলাকাবাসীর মধ্যে, একইসঙ্গে তারা বিস্মিতও হয়েছেন। অন্যদিকে নিজের ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে শিশুটির বাবা সুজনের মুক্তি দাবি করেছেন সুজনের মা-বাবা।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, প্রথম থেকেই আমরা সোহানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখেছি। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পরিবারের সঙ্গে কথোপকথন ও বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করি। আমাদের ধারণা ছিল, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিবারের কেউ জড়িত রয়েছে। আমরা শিশুটির বাবা সুজন খানকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ এবং রিমান্ড আবেদন করি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে সুজনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। সুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আমাদের মনে হয় যে, নবজাতকের মা ও বাবাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। 

সেই মোতাবেক দুইজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে শিশুটির মা আমাদের কাছে হত্যার বর্ণনা দেন। নিজেই শিশু সন্তানকে হত্যা করেছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। 

পুলিশ সুপার আরও বলেন, পরবর্তীতে শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) বিকেলে বাগেরহাট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ খোকন হোসেনের সামনে শিশুটির মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকি হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, যা আদালত রেকর্ড করেছেন। 

একইসঙ্গে সকল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলেও জানান পুলিশ সুপার পঙ্কজ চন্দ্র রায়।

এদিকে, ঘটনার নেপথ্য রহস্য উন্মোচন করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোরেলগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) ঠাকুর দাস বলেন, হত্যার শিকার শিশুটির বাবা সুজন ও মা শান্তা আক্তার ওরফে পিংকি দুইজনেরই আগে বিয়ে হয়েছিল। পিংকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার বনগঞ্জ গ্রামের মোঃ ইউনুছ শেখের মেয়ে। ২০১৭ সালে একই এলাকার উজ্জল ভুইয়া নামের এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেখানে পিংকির একটি মেয়ে রয়েছে। 

কিন্তু দুই বছর না যেতেই ২০১৯ সালের দিকে পিংকির সাথে তার বর্তমান স্বামী মোরেলগঞ্জ উপজেলার গাবতলা গ্রামের সুজন খানের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরে পিংকি তার নাম পরিচয় ও বিয়ের বিষয় গোপন করে সুজনের কাছে চলে আসেন। সুজনের বোনজামাই এনামুলের ঢাকাস্থ বাসায় বিয়ের পরে ২০ দিন থেকে সুজনের সঙ্গে তার বাড়িতে আসেন পিংকি। কিন্তু পূর্বের বিয়ে ও সন্তানের কথা এই স্বামী ও তার পরিবারের কাছে গোপন রাখেন পিংকি। 

ওসি ঠাকুর দাস আরও বলেন, আমরা মামলার সূত্র ধরে পিংকির বাবার পরিবার, পিংকির পূর্বের স্বামী-সন্তান ও কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সুজনের পূর্বের স্ত্রী ও শান্তা আক্তার পিংকির পূর্বের স্বামীসহ বিভিন্ন পারিবারিক ঝামেলার জন্য পিংকি তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন, এমনটি ধারণা করা হয়।

ওসি আরও বলেন, পরে জিজ্ঞাসাবাদে পিংকি আমাদের আরও জানিয়েছেন- ঘটনার রাতে ঘুমানোর পরে তার শরীরে প্রচণ্ড জালা-পোড়া শুরু হয়। এসময় নিজের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের খাল, বাগান ও পুকুরের পাড়ে দৌড়াদৌড়ি করেন। এক পর্যায়ে ঘরের সামনের পুকুরের ঘাটে জামরুল (লকট) গাছের নিচে শিশুটিকে ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন শান্তা আক্তার পিংকি। পরবর্তীতে রাত দেড়টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সন্তানের জন্য কান্নাকাটি শুরু করেন তিনি।

এদিকে প্রতিবেশী মরিয়ম বেগম, খলিলুর রহমান, হাসি বেগমসহ কয়েকজন বলেন- শিশুটির হারিয়ে যাওয়া ও মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে আমরা খুবই চিন্তিত ছিলাম, কিভাবে ঘটনা ঘটল এসব চিন্তা করে। তবে এখন জানতে পারলাম সোহানার মা-ই হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন হওয়ায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। এ ধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য এই ঘটনার কঠোর শাস্তি দাবি করেন তারা।

হত্যার শিকার নবজাতক সোহানার দাদা ও মামলার বাদী আলী হোসেন বলেন, আমার সন্তান সুজন খান নির্দোষ। আমি তার মুক্তি চাই। আমি নাতিও হারালাম, আবার ছেলেও জেলে- এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

সুজনের মা নাসিমা বেগম বলেন, আমাদের আদরের ধন সোহানাকে হারিয়েছে। আমাদের চোখের পানি এখনও শুকায়নি। আমরা সুজনকে হারাতে চাই না। আমি সুজনের মুক্তি চাই।

সুজনের বোন রজিনা বেগম বলেন, শান্তা ভাবি আমাদের বাড়িতে আসার পরে বেশ কয়েকবার অস্বাভাবিক আচরণ করে বেহুশ হয়ে পড়তেন। আমরা তাকে স্থানীয় ওঝা-কবিরাজও দেখিয়েছি। সে আমাদেরকে বলেছিল তার সাথে জ্বীন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ নভেম্বর রাতে মোরেলগঞ্জ উপজেলার গাবতলা গ্রামে বাবা সুজন খান ও মা শান্তা আক্তারের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিল ১৭ দিন বয়সী শিশু সোহানা। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তারা দেখেন যে, শিশুটি সেখানে নেই, কোথাও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না, হারিয়ে গেছে। 

পরেরদিন ১৬ নভেম্বর ভোর থেকে পুলিশের একাধিক টিম শিশুটিকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করলেও কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিল না পুলিশ। ওইদিন রাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মোরেলগঞ্জ থানায় মামলা করেন শিশুটির দাদা আলী হোসেন খান। 

এর দুইদিন পর বুধবার ভোরে ফজরের নামাজের পর নিজ ঘরের সামনের পুকুরে নাতির মরদেহ ভাসতে দেখেন আলী হোসেন। পরে পুলিশ শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য বাগেরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি