এইডসের ঝুঁকিতে হিলি স্থলবন্দর
প্রকাশিত : ১৮:০৭, ৩০ নভেম্বর ২০২০
এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তের দিক থেকে ভারতের অবস্থান রয়েছে প্রথম। দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে গড়ে প্রতিদিন দু' থেকে আড়াই'শ পণ্যবাহী ট্রাক দেশে প্রবেশ করে। যার মধ্য দিয়ে ৪ থেকে ৫'শ চালক ও সহকারি দেশে প্রবেশ করে। একইভাবে হিলি ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট দিয়ে ৭ থেকে ৮শ যাত্রী যাতায়াত করে থাকেও যদিও করোনার কারণে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
দেশে প্রবেশের সময় এসব ট্রাকের চালক, হেলপার ও পাসপোর্ট যাত্রিদের কোন স্বাস্থ্য ও রক্ত পরিক্ষার ব্যবস্থা নেই। এদিকে এইচআইভি এইডসের সংক্রামন রোধে কয়েকটি এনজিও হিলিতে কাজ করলে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২টি। এতে করে হিলি স্থলবন্দরসহ সীমান্তবর্তী এলাকা এইচআইভি এইডসের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এইচআইভিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৩৭৪ জন। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯১৯ জন। আর এ যাবত পর্যন্ত এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১ হাজার ২৪২ জন, যার মধ্যে শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই মৃত্যু হয়েছে ১৭০ জনের।
হিলিতে কর্মরত এনজিও সূত্রে জানা গেছে, হিলিতে ১৪ থেকে ১৫ জনের মতো এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন, যার মধ্যে ২০১৯ সালেই তিনজন মারা গিয়েছেন, যারা তিনজনই হিজড়া জনগোষ্ঠি, আর বাকিদের চিকিৎসা চলছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী মুশপিকুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমরা যতটুকু জানি তাতে করে এইচআইভি এইডসে আক্রান্তের দিক থেকে ভারতের অবস্থান প্রথম। আর আমরা হিলিতে যারা বসবাস করি তারা বাংলাদেশ ও ভারতের নিকটতম সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছি। প্রতিদিন হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে দু' থেকে আড়াই'শ পণ্যবাহী ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করে যার মাধ্যমে ৪/৫শ জন চালক ও হেলপার দেশে প্রবেশ করে। তারা এখানে অনেক সময় রাত্রিযাপন করেন সেই সাথে ভাসমান যৌনকর্মী ও হিজড়াদের সাথে মেলামেশা করেন।
হিলি স্থলবন্দরে পণ্য নিয়ে আসা ভারতীয় ট্রাকচালক অনিল কুমার ও সঞ্জয় বর্মন বলেন, এইচআইভি এইডস একটি মারাত্মক রোগ, এটি পরিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। কি ভারতে কি বাংলাদেশে আমরা যে ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে আসছি চালক ও সহকারীরা তাদের কোন পরিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তবে পরিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমরা সুরক্ষিত থাকতাম কারণ আমাদের মাধ্যমে হয়তোবা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসতে বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে এই রোগ যেতে পারে। তাই আমাদের দাবি এই ধরণের রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
হিলি স্থলবন্দরের ভাসমান যৌনকর্মী নিশাত আরা ও ইসমত আরা বলেন, আমরা পেটের দায়ে টাকার বিনিময়ে এই কাজ করে থাকি। আমরা কিছুটা বাড়তি টাকার লোভেই ভারতীয় ট্রাকের চালক ও হেলপারদের সাথে যৌনকর্মে মিলিত হই। সেই সাথে হিলিতে বাহির হতে মানুষজন আসে তাদের সাথে আমরাও যৌনকর্মে মিলিত হই। আমাদের এইচাইভি এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে তারপরেও আমরা পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এই পেশায় লিপ্ত রয়েছি। সমাজ তো আমাদের মেনে নেয়না, আমরা এই কাজ থেকে সরে আসতে চাই কিন্তু আমাদের তো কোন সুযোগ সুবিধা নেই, সুযোগ সুবিধা পেলে এই পেশা থেকে সরে আসতাম।
হিলিতে এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে কর্মরর্ত লাইট হাউজ হিলির দুটি সাব ডিআইসি সেন্টারের কো অর্ডিনেটর মোস্তাফিজুর রহমান ও আরিফুর রহমান বলেন, হিলি একটি সীমান্ত এলাকার কারণে অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠি বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায় বা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। তেমনি হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশো পণ্যবাহী ট্রাকের মাধ্যমে ৪/৫শ জন চালক ও হেলপার দেশে প্রবেশ করে। তারা এখানে রাত্রি যাপনসহ যৌনকর্মীদের সাথে যৌনমেলামেশায় লিপ্ত হন। এর উপর সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারনে মাদকসেবীদের বেশ আনাগোনাও রয়েছে এখানে। এতে করে এইচআইভি এইডসে আক্রান্তের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে হিলি। হিলিতে লাইট হাউজের দুটি ইউনিট এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে কাজ করছে।
এর মধ্যে একটি হিজড়া ও পুরুষ সমকামি জনগোষ্ঠিকে নিয়ে, অপরটি কাজ করছে যৌনকর্মীদের নিয়ে। আমরা এইচআইভি প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের কাজ করে যাচ্ছি, কিভাবে এইচআইভি ছড়ায় এসম্পর্কে সচেতন করছি, সেই সাথে নিরাপদ যৌন মেলামেশার পরামর্শ প্রদান, সামাজিকভাবে সচেতন করতে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে সচেতনতা মুলক সভা করছি। তবে আগে মধুমিতা, পিএসটিসি, ওয়াল্ডভিশনসহ অনেক এনজিও এইচআইভি প্রতিরোধে কাজ করলেও এখন তারা আর কাজ করছে না। তাই আমাদের কাছে তথ্য আছে তাতে করে হিলি অবশ্যই এইচআইভি এইডসে আক্রান্তের ঝুকির মধ্যে পড়বে।
হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান বলেন, যেকোন সীমান্তবর্তী এলাকা এইচআইভি এইডসের ঝুকি সব সময় একটু বেশিই থাকে। এরপরেও হিলি একটি স্থলবন্দর অনেক সময় পাশ্ববর্তী দেশ থেকে এইচআইভি রোগী আসতে পারে যার কারণে এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। এখানে বেশ কিছু এনজিও কাজ করছে তাদের পাশাপাশি আমরাও কাজ করছি, যেকোন রক্তগ্রহণ ও প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই এইচআইভি এইডস রোগ আছে কিনা সেটি পরিক্ষা করে দেখা হয়। এনজিওদেরকে বলা হয়েছে ইতিমধ্যেই যাদের এই রোগ আছে তাদের যেন ঠিকমতো কাউন্সিলিং করা হয়, চিকিৎসা দেওয়া হয়, তারা যেন এই রোগ অন্য কোথাও ছড়ানোর সুযোগ না পায়। তাদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি অন্যান্য মানুষকেও এবিষয়ে সচেতন করা হয়। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে যে সমস্ত চালক ও সহকারি
দেশে প্রবেশ করছে তাদের পরিক্ষার ব্যবস্থা নেই তবে করোনার প্রকোপ কেটে গেলে তাদের পরিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেআই//
আরও পড়ুন