ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

পদ্মা নদীরক্ষা বাঁধে ভাঙন

ফারুক আহমেদ চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ 

প্রকাশিত : ২২:০৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের ছয়রশিয়া থেকে হড়মা পর্যন্ত পদ্মা নদীরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বন্যা-পরবর্তী প্রায় ৩ মাস থেকে শুকনো মৌসুমেও পদ্মা নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে রক্ষা বাঁধ। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন পার করছেন প্রায় ১ কিলোমিটারজুড়ে পদ্মাপাড়ে বসবাস করা বাসিন্দারা। নদী ভাঙনের কারণে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে ফসলি জমি ও বসতবাড়ি। শুষ্ক মৌসুমে হঠাৎ পদ্মা নদীর এমন আগ্রাসী ভাঙনে ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দোকানঘর, মসজিদ, গোরস্তানসহ বসতবাড়ি ও হাজারো একর ফসলি জমি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা-তীরবর্তী হড়মা ঘাট এলাকায় থাকা নদী রক্ষা বাঁধের ১ কিলোমিটারের মধ্যেই প্রায় ১৫-২০টি জায়গা ব্লকসহ নদীতে তলিয়ে গেছে। মাত্র ৩ বছরেই বাঁধ তলিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।

বিগত কয়েক বছরে ১০-১২ বার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে ষাটোর্ধ্ব আনোয়ার হোসেনকে। অনেক আশা নিয়ে বাঁধের পাশে বাড়ি করেছেন গত বছর। তবে রক্ষা বাঁধ তলিয়ে যেতে শুরু করায় নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ব্লক বিছানো ৩ বছর হলো, তাতেই তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে রাত-বিরাতে ব্লকগুলো খসে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে থাকবো আমরা? রক্ষা বাঁধ থাকলেও যে অবস্থা, না থাকলেও একই অবস্থা আমাদের।

হড়মার দানেশ আলীরটোলার আমজাদ আলীর ছেলে মো. টিপু সুলতান জানান, মরা নদীর মুখ থেকে হড়মা ঘাট পর্যন্ত অন্তত ২০ জায়গায় এমন ভাঙন শুরু হয়েছে। বাঁধ ভেঙে এই এলাকার সবকিছুই অনেক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এখানকার মানুষ এখন নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। সত্তর বছর বয়সী প্রবীণ আজহার আলী জানান, বারবার বাড়ি ভাঙছি, বারবার নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছি। জমিজমা হারিয়ে অন্যের আম বাগানে ১০ হাজার করে ভাড়া দিয়ে বসবাস করছি।

দিনমজুর সাত্তার আলী বলেন, নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়েছি। এই মুহূর্তে কোন জায়গা-জমি নেই। পরের জায়গায় বসবাস করছি। এতো কম সময়ে কিভাবে ভাঙল? অব্যশই কাজে গাফেলতি আছে, তাই বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ‘ভাঙন শুরু হলেই চোখে পানি চলে আসে' এমনটা জানিয়ে মেসের আলীর স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, নদীর পানি ভরপুর ছিল তখনও ভাঙন ছিল না। অথচ এখন ভাঙন হচ্ছে।

ভাঙনকবলিত এলাকার রহিমা বেগম বলেন, ৩ মাস আগের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে মনের চাপা কষ্ট আর বুকভরা বেদনা নিয়ে অন্যের জমিতে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কুঁড়ে ঘরে বসবাস করছিলাম। ওই সময়ের ভাঙন থেকে রেহাই পাওয়া ১২ শতাংশ জমিতে টমেটোর চাষও করেছিলাম। অসময়ের হঠাৎ ভাঙনে নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে আমার শেষ সম্বলটুকু। এখন আমার দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই। এই ভাঙন আমার জীবনে প্রথম নয়, এর আগে ও আরো তিন বার ভেঙেছে, তবে এবার নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

পদ্মা পাড়ের এক গ্রাম্য চিকিৎসক জানান, ভাঙন মৌসুমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা নদী শাসনের আশ্বাস দিলেও তার কোন বাস্তবায়ন নেই। যে কারণে প্রতি বছর পদ্মা নদীর ভাঙনে বসতি ও আবাদি জমি নদী গর্ভে চলে যায়।

দেবীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, নদীর পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমের মতোই অসময়ে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি, খুব দ্রুতই কাজ শুরু হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে মন্ত্রী ও সচিব বরাবর কয়েক দফা ডিও লেটার দিয়েছি। চরবাগডাঙ্গা ও দেবীনগর এলাকার নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৫৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ খুব দ্রুত সময়ে শুরু হবে বলে জানান তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান জানান, হড়মা ঘাটের নদী রক্ষা বাঁধ তলিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো, সেখানকার ভিন্ন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। পদ্মা-মহানন্দার মোহনা ও অতিরিক্ত গভীর হওয়ায় এমনটি হতে পারে। বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কয়েক দফা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। 

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি